ব্যক্তিগত গদ্য : অজিত বাইরী

 

ব্যক্তিগত গদ্য      

অজিত বাইরী

   বাল্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। সে তো ঢেরদিন আগের কথা। ষাট দশকের শেষ দিকে কিংবা বলা যায়  সত্তর দশকের শুরু থেকেই। তারপর কত পথ পিছনে ফেলে এলাম। জীবনের নানা বাঁকে এসে কবিতাও দিক বদল করেছে; কিন্তু মূলস্রোত বয়ে গেছে নদীর ধারার মতো অবিচ্ছিন্ন। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে একটা-না-একটা সংযোগসূত্র রয়ে গেছে।

   মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন এই বয়েসেও উঁকি দেয় মনের কোণে 'কেন লিখি'? আকাশ-ভরা তারার ভিড়ে যে উত্তরটি অধিক সমুজ্জ্বল মনে হয়,তা হল লিখে আনন্দ পাই। সুখ ও দুঃখকে আস্বাদন করার আনন্দ । এরই টানে অক্ষরের উপর মমতা জন্মায়। লেখা কলমে না এলে শরীর-মনে অবসাদ নামে। মন বিস্বাদে ভরে যায় । আবার যখন লেখা আসে স্বর্গসুখ অনুভব করি।

   লেখার জন্য এত কাঙালপনা! তবু কিছু অভিমান জড়ো হয় বুকে। সেই অভিমান বশে কলমটিকে সরিয়ে রাখি, পরক্ষণে আবার টেনে নিই কাছে। সে আমাকে ছেড়ে যাবে না কোনদিন। সেই শব্দ প্রতিমাকে কৈশোরেই চিনেছি। সেই আমার নিয়তি। অনেক উপেক্ষা, উদাসীনতাকে সইতে সইতে খুচরো পাতার মতো কিছু অভিমান বুকে নিয়ে এত দূরে আসা। বাকি জীবনটা সে যদি আঁকড়ে থাকে, সেই হবে জীবনের চরম সার্থকতা ।

   স্মৃতিচারণ আমি ভালোবাসি । বাল্যে মাতৃবিয়োগ আমাকে করছিল একা। একাকিত্বের অভিমান ছিল আমার সব সময়ের সঙ্গী। কখনও নদীতে নেমে স্বচ্ছ জলের মধ্যে বালির পিরিচ থেকে ঝিনুক, 1গুগলি কুড়োতাম। কখনও ভিজে বালি জড়ো করে মন্দির বানাতাম।নিজেকে নিয়ে  ছিল আমার একা একা খেলা।

   বাল্যকাল নিয়ে আমার কোন অহংকার নেই। সে জীবনের প্রতি কখনও আকাঙ্ক্ষা বোধ করিনি। বাল্যে মাতৃবিয়োগ আমাকে করছিল নিঃসঙ্গ । নির্জনতাকে আমি চেয়েছিলাম দুঃখে, দারিদ্র্যে, প্রিয়জন বিয়োগে। সকলের চোখের আড়ালে থাকতে ভালো লাগতো। আজও তাই। মনে পড়ে সেই কিশোরকে যে নদীর চরে জ্বলে উঠতে দেখেছিল চিতার আগুন। মার নশ্বরদেহ ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল । মার কোন ফটোগ্রাফ নেই, তবু সে-মুখ আজও আমি ভুলিনি। মনে মনে মার মুখের ছবি আঁকতাম। তা থেকেই একদিন রঙপেনসিল হাতে নিলাম। তারপর কলম।

   বিজন দুপুরে বড় মাপের জানলায় চোখ রেখে বসে থাকতাম। গভীর নীল নির্জন আকাশ আর তার বুকে ভাসমান চিল আমাকে কল্পনাবিলাসী হতে শিখিয়েছিল। ঐ কল্পনাবিলাসী মন আজও সঙ্গ ছাড়েনি। মাতৃবিয়োগের পর আমার আশ্রয় হয়েছিল দিদিমার কাছে । কন্যাশোকে তিনি দিনরাত চোখের জল ফেলতেন। সেই চোখের জলে সংক্রামিত হতাম আমি। আমার চোখেও জল আসতো। দিদিমা আঁচলের খুঁট দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে বলতেন, ছিঃ, ছোট ছেলের কাঁদতে নেই। আমি কাতর প্রশ্ন করতাম, তবে তুমি কাঁদো কেন?

   দিদিমার কাছে থাকার সময় সদরবাড়িতে কামরাঙা গাছটির নিচে আমার দিবাভাগের বেশি সময়টাই কাটতো। মাঝে মাঝে দিদিমার  কাছে ছুটে গিয়ে  কাঠকয়লার আগুন কল্কতে ভরে এনে  দাদুর হাতে দিতাম। গৌরবর্ণ দাদু তাঁর পিতলের গড়গড়ার নলটিতে মুখ দিয়ে ভুড়ুক ভুড়ুক টান দিতেন। আর তামাকের গন্ধে সারা সদরবাড়ি ম-ম করতো। কখনও  কখনও  পুকুরঘাটে তালগাছে ঠেস দিয়ে আমার বয়েসি ছেলেমেয়েদের তালপাতার বান্ডিল বগলদাবা করে পাঠশালায় যেতে দেখতাম। দিদিমার তাগিদে  শেষের দিকে আমিও গণেশমাস্টারের পাঠশালায় হাজির হয়েছিলাম ভুষোকালির দোয়াত, কঞ্চির কলম আর লেখার জন্য তালপাতার গোছা নিয়ে ।

   সেই দিদিমাও চলে গেলেন একদিন। আমি প্রকৃতই অনাথ হয়ে গেলাম। তারপর কত ঘাট-আঘাটায় ঠেক খেতে খেতে কত অভিজ্ঞতার আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে মোহনার কাছে এসে ঠেকেছি।

    কৈশোর কেটেছে চরম দুঃখে। গৃহভৃত্যের মতো অন্যের দাসখত খাটতে খাটতে অনেকগুলো বছর গেছে। তার মধ্যে পড়াশোনা । সে কাহিনি এখানে বিস্তৃত করতে চাইনা। এরপর চাকরি জোটাতেও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নানাবিধ কাজের মধ্যে  দিয়ে কয়েকটা বছর কাটিয়েছি । ইলেকট্রিক দোকানের সরঞ্জাম বিক্রি, রেশন দোকানে খালাসিদের সঙ্গে থেকে মাল ওঠানো-নামানো, কখনো-বা খাটালে ঘুরে ঘুরে মালিকের টাকার তাগাদা দিয়ে বেড়ানো। কত ধরণের কাজ সকাল থেকে রাত অব্দি। অবশেষে সরকারি চাকরি। চাকরি-জীবনেও নকশাল সন্দেহে পুলিশের নজরদারিতে থাকতে হয়েছিল দু বছর। ইমার্জেন্সির সময় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর জামাতা কবি সাংবাদিক জ্যোর্তিময় দত্তকে আশ্রয় দেবার অপরাধে ( তখন তাঁর বন্ধুরাও কলকাতায় বা অন্যত্র আশ্রয় দেননি। ) পুলিশি নির্যাতন সইতে হয়েছিল তিন বছর। এমনই ঘটনাবহুল ছিল জীবনের মধ্যভাগ ।  অবশেষে সরকারি দপ্তর থেকে উপ-প্রকল্প অধিকর্তা, কৃষি প.বঙ্গ পদ থেকে 2008 সালে অবসর গ্রহণ। এরই মধ্যে  কবিতাচর্চা, পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদি ।

   অন্তর্মুখী স্বভাব আমার আবাল্যের। পত্র-পত্রিকার দপ্তরে আনাগোনা,বিশিষ্টদের সান্নিধ্য পাবার লোভে দরজায় ধর্না দেওয়া থেকে আমি দূরে থেকেছি। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নয়, স্বাভাবিকভাবেই যাদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছি, তাদের সঙ্গে মিশেছি  আন্তরিকভাবে। কাউকে শ্রদ্ধার আসনে, কাউকে ভালোবাসার আসনে বসিয়েছি।

    আমার এই অন্তর্মুখী স্বভাবকে অতিক্রম করতে চাই। যে আমাকে একা একা বসিয়ে রাখতো কামরাঙা গাছটির নিচে, যে আমাকে নিয়ে যেতো সির্জনের পাড়ে ( মামাবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী ) , শুকনো নদীর বুকে ঝুঁকে দেখতে বলতো গভীরতা। আমি চাইব না কবিতা থেকে দূরে যেতে। কবিতাই অন্ধকারে আলো। যখন বিষাদগ্রস্ত হই, একটি কাব্যগ্রন্থ  আমাকে পৌঁছে দেয় মানসিক ভারসাম্যে। দু একটি লাইন লিখে উঠতে পারলে অনেক অসুখ সেরে যায় । মায়ের হাতের স্পর্শ কেমন উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হয়নি আমার। সে কী কবিতার মতো শুশ্রূষাময়! রক্তে সঞ্চারিত হয়ে যাওয়া এক অমোঘ আরোগ্য!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ