দুইপাতা সাহিত্য পত্রিকা ৯১তম সংখ্যা ।।সম্পাদক: নীলোৎপল জানা

 মানসকুমার চিনি স্মরণ সংখ্যা

 দুইপাতা 
 ৯১তম সংখ্যা ।। সম্পাদক: নীলোৎপল     জানা
 প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৪
 Email: nilotpaljana1978@outlook.com
   ======================
    মৃত্যু: ১৭আগস্ট, ২০২৪
                   
কবি মানসকুমার চিনি, চেনা - অচেনা বন্ধুত্ব
সৌমিত বসু

      মানসকে প্রথম কবে দেখেছি আজ আর মনে পড়ে না। তবে পথচলতি রাস্তায় হঠাৎ করে মানুষ যেমন কলম কুড়িয়ে পায়, তেমনি তার সাথে আলাপে আমার বুক পকেটে একটা আনন্দ জমা হয়েছিল। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল সে আর পাঁচটা মানুষের মত স্বাভাবিক নয়। কবিতা তাকে বরবাদ করে দিয়েছে। বিশেষত একটা ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকা, কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়া এবং হেতু হীন মদ্যপানের প্রতি তার আসক্তি আমাকে  সাহায্য করেছিল তাকে এভাবে চিনতে। যদি একটি মাত্র কথায় মানসকে ধরার চেষ্টা করা যায় তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় "কবিতা অন্ত প্রাণ"। আর একটি মানুষ কবিতাগত প্রাণ হবে অথচ সংসার দু-হাত বাড়িয়ে তাকে অক্টোপাসের মতন গ্রহণ করবে, আদরে যত্নে ভরিয়ে তুলবে তার সংসারের উঠোন সেটা সম্ভবত বাংলা কবিতায় কখনো হয়নি। আগামী দিনেও হবে না। ফলে চলতি জীবন থেকে যেটুকু প্রাপ্তি তার চেয়ে অনেক কম, ছিঁটেফোঁটা হয়তো এসে পড়েছিল মানসের আঙ্গুলে। মূলত তার সাথে দেখা হতো কবিতা উৎসবে কিংবা লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় ,তাও অনুষ্ঠানের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের আড্ডা ,কথোপকথন । তা থেকেই বোঝা যেত মানস ক্রমাগত চেষ্টা করছে আকাশের ওপারের আকাশকে দেখার। একটা অগোছালো জীবন হাতের তালুর ওপর রেখে নেড়েচেড়ে দেখতে চাইছে তার কোনদিকটাতে কবিতা লেগে আছে, সূর্যাস্তের সময় তা কিভাবে রং পাল্টায়। বাংলা কবিতার প্রতিটি মানুষই অসফল। আমরা যাকে আপাতপ্রাপ্তি বলি তাও মূলত প্রাপ্তির চেয়ে যোজন যোজন দূর। সুতরাং একটা জীবন ঠিকঠাক তারে বেজে উঠল না বলেই যে সেই সুর কাউকে কাউকে মোহিত করেনি তা কিন্তু নয়।আমার বিশ্বাস, তরুণ কবিদের একটা বিরাট অংশ যারা বুক ঘষে ঘষে কবিতা লেখে তারা মনে মনে স্বীকৃতি দিয়েছিল মানসকে।। দুর্ভাগ্য, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চিত জীবন এসব বাংলা কবিতার গায়ে লেগে থাকা অক্ষরের মতো। এসব দেখেই ধীরে ধীরে বড় হয়েছে বাংলা কবিতার পাঠক। ফলে মানসকে আপন করে চিনতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। যতবার দেখা হয়েছে, অদ্ভুত হাসি হেসে কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করার পর  সে বাড়িয়ে দিয়েছে একটি এক ফর্মার বই , ১২/১৪ টি কবিতার সমন্বয়। আর নিচু গলায় বলেছে পড়ে দেখো, জানিও। হঠাৎ করে কাউকে না জানিয়ে মানস যে এতটা নদীর জলে নেমে গেল ওকে কি আর পাড়ে নিয়ে আসা যাবে? পড়ে থাকা যেসব স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া বন্ধু-বান্ধবদের, তাদের যেভাবে একটা তাকে তুলে রাখি , তেমনি সদ্য দুটি বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখলাম মানসকে। বন্ধু মানসকে প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল তোমাকে চিনি। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে তোমাকে আমার সেভাবে চেনাই হল না।

কথায় ও কবিতায় মানসকুমার চিনিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি


চেনা মানসের পদধ্বনি  

মধুসূদন ঘাটী

      মানসকুমার চিনি যখন মেচেদায় থাকতো তখন ওর বাসায় গেলে যে আড্ডা হতো তা শুধু কবিতার। ওকে কবিতা পাগল ভাবতাম। পরবর্তীকালে তাই সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল। ও কবিতা লিখতো খুব ছোটো পরিসরে। বলতাম, বড়ো কবিতা লেখো না কেন। ও বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিত, কবিতা ছোটো হলে সম্পাদকের ছাপার সুবিধে হয়। একটুখানি জায়গা ফাঁকা থাকলে আট-দশ লাইনের কবিতা ঢুকিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে। তারপর নিজে যখন সম্পাদনা করতাম, সত্যি কখনো কখনো ওরকম ছোটো কবিতা খুঁজতাম।

      মেচেদায় থাকাকালীন কবিতা পাগল মানস একসময় বই পাগল হয়ে উঠল। সামান্য অর্থ বাঁচাতে পারলেই নিজের পছন্দের বই কিনে বাড়িতে সাজাতো। তারপর একসময়  "কবিতার বাগান" বানিয়ে ফেলল মানস। আমার সব বই ওকে দিয়েছিলাম ততোদিনে যা বেরিয়েছিল।

      বাউন্ডুলে স্বভাবের মানস আশপাশের প্রায় সমস্ত কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত থাকতে। খুব হৃদয় খোলা বলেই কোনো অভিমান বা রাগ চোখে পড়ত না। তবে বেশ কয়েকবছর লেখ্য জীবন কাটানোর পর ওর ইচ্ছে জেগেছিল দেশ পত্রিকায় লিখবে। বেশ কয়েক বছর লেখা পাঠিয়েও যখন মনোনয়নের গণ্ডী পেরোতে পারল না, শুনেছি দপ্তরে গিয়ে নাকি আত্মহত্যার ঘোষণা করে বসেছিল। সত্যি সত্যি কয়েক মাসের মধ্যে ওর কবিতা বেরিয়েছিল দেশে। সত্যি জানি না তবে এটুকু জানলাম মানসের জেদের কাছে দেশ পত্রিকা নতি স্বীকার করেছিল।

      মানস যখন খড়্গপুরে চলে গেল তখন ওর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়সীমা দীর্ঘায়িত হতে থাকল। সেখানেও কবিতা বাগানের আহ্বানে একাধিক বার গিয়েছি। শেষবার দেখলাম ও বিধ্বস্ত। পারিবারিক কলহকে সামনে রেখেও ও যেভাবে কবিতা প্রাণ সত্তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সেটাই আশ্চর্যের।

    প্রায় ৩৫ টি কবিতার বই বেরিয়েছে। তাতে মানসকে চিনতে আমাদের কোনো ভুল হতো না। অজস্র কবিতায় নিজস্বতার ছাপ রেখে যেতে পেরেছে। ১৯৬৫ সালের ২৫ মার্চ জন্ম হলে কতোটুকুই বা বয়স, তবুও চলে যেতে হলো ওকে না ফেরার দেশে। কয়েকমাস আগে ও একটি চিঠি লিখেছিল আমাকে। কাছের জন ভেবেই হয়তো। লিখেছিল, একদম বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কেন সে উত্তর আর পাওয়া গেল না। ওর ফোন নম্বর জানা ছিল না।  কথা আর হলো না। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর কলকাতায় কাটালেও মেদিনীপুরের ডাকে ও ছুটে এসেছে। দেখা হয়েছে। ওকে ওর নিজস্ব দুঃখের বাইরে চেনা মানস হিসেবে পেতাম। সেই ভালোলাগাটুকু নিয়ে অপেক্ষায় থাকবো চিরাচরিত ওর পদধ্বনি শোনার। না ফেরার দেশ থেকে কেউ ফেরে না জানি। অথচ আজ খুব মনে পড়ছে, ও আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে যেন। উস্কো চুলের বিন্যাস থেকে বেরিয়ে আসছে মানস, আর কাঁধে ঝোলানো কবিতার বাগ থেকে বেরিয়ে পড়ছে ওর কবিতা। মানস, বাঁচতে ইচ্ছে না করলেও তুমি বেঁচে থাকবে আমাদের মনের মণিকোঠায়।

 

 

মানসকুমার চিনির কবিতা এক বিপন্ন নাথিংনেস

 তৈমুর খান

     নয়ের দশকের কবি মানসকুমার চিনি(১৯৬৫-২০২৪)এক ভাঙনকালকেই সূচিত করে সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন। আমাদের আত্মিক ভাঙন যখন চূড়ান্ত, আমরা যখন প্রত্যেকে নিজস্ব অশ্রুজলে বিছিন্ন দ্বীপ, মানবিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে চলেছি,তখন রাজনীতিতেও ফ্যাসিবাদের আমদানি ঘটছে, সমাজে নগ্ন ফ্যাশানের প্রভাবও বাড়ছে, প্রেমও তখন প্রমোদ-সঙ্গম দায় এড়ানো সহবাস। সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবল ভাঙা-ভাঙির খেলা। ভেঙে পড়ছে বার্লিন প্রাচীর, যুগোস্লাভিয়া, সোভিয়েত দেশ। আফগানিস্তানে ভেঙে ফেলছে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি। গুজরাটে জ্বলছে সাম্প্রদায়িকতার আগুন। সেই সময় চাকুরিবিহীন বেকার যুবক-যুবতীরা হতাশার বিষবাষ্প শোষণ করতে করতেই হাঁপিয়ে উঠছে। কবি এদেরই প্রতিনিধি হয়ে ‘নোনাবালি’ কাব্যগ্রন্থে লিখলেন:

“পৃথিবীর বাতাসে এখন

গভীর অসুখ—তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো

তোমাদের শ্বাসে ঢুকে যেতে পারে

চাঁদের কলঙ্ক, গ্রহণের বিষ আর মানুষের ক্ষুধা।

 

নদীও চর ভাঙে

চর ও প্রতীক্ষায় থাকে সঙ্গমের

গাছ বাকল খসাতে চায়

সময় আসেনি তো তার?

 

আমি সেই পাহাড়ে মাথা রেখে

ভূকম্পন অনুভব করি

যে কম্পনে আমি খুঁজে পাই

আবীর সিঁদুর আর তুষার।”

    কবিতাটির নাম ‘অনুভব’। এই অনুভবই তাঁর সমূহ কবিসত্তার আবির্ভাবে ঘোষিত হয়ে গেল। যে ভূকম্পন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তা তাঁর সমূহ জীবনবৃত্তকেই গ্রাস করল। তাই এই কাব্যের শেষ কবিতা ‘স্বদেশের মানচিত্র’-তে লিখলেন:

“আমার ভূগোলের মানচিত্র

ছিন্ন-বিছিন্ন করে দেখি

বিপন্ন স্বদেশের মানচিত্র।”

   বাঙালি সত্তার ভাগ দেশভাগেরই প্রভাব, সেখানে মানচিত্রও ছিন্ন-বিছিন্ন। তাই ইহজন্মে কবির আর শুদ্ধতা জাগেনি।পরজন্মের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে।বিষণ্ণ সকাল আর মায়াময় কুয়াশার ভেতর আত্মযাপনের নিবিড় কান্নাগুলিকে গুছিয়ে ক্ষুধা ও পরাজয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে হয়েছে। নিজেকে মনে হয়েছে একটি লাশ।

   কিন্তু পরবর্তী কাব্যভাবনায় যে মহাকালের সংগীত তিনি শুনতে চেয়েছেন তা কি শুনতে পাননি? ‘একক সংগীত সন্ধ্যায়’ কাব্যের ‘কালের সংগীত’ কবিতায় লিখেছেন:

“পথের ভেতর দেখি

ঘুঙুরের নিঃসঙ্গ শব্দ জেগে আছে

গতরাতে ফিরে গেছে নর্তকী

চাঁদের আলো কেটে কেটে, তুমি

            নতুন যুগের সন্ধানে—”

    নর্তকীর ফিরে যাওয়ার পরও চাঁদের আলো কেটে কেটে অগ্রসর হওয়া নতুন যুগের সন্ধান করা কবি শুধু কালের সংগীত ঝরে পড়তে দেখেছেন। চাঁদ চূর্ণ হয়ে ফিরে তাকিয়েছে। জীবনের পথ মসৃণ হয়নি। যুদ্ধ ভর্তি পথে তবুও ফুলের স্তবকে স্নান সেরে কবি তৈরি হয়েছেন। স্বপ্নের গহ্বরে তীব্র চাঁদ আলো জ্বেলে দিলেও মহাকাল শুধুমাত্র ধ্যানেই জাগ্রত হয়েছে। যদিও তা ‘ঘনকথা’ তবু ‘বিবাহসৃজনে’ মুগ্ধতা আনেনি,   ‘অগ্নিদগ্ধ প্রেমপত্র’ হয়ে গেছে। মগ্নচৈতন্যের ভেতর জীবনের বহুগামী রূপ এক অন্ধকার রিরংসায় পৌঁছে গেছে।

    সেখানে তখন আর প্রেম নয়, শরীর বিক্রির উদযাপন। জমাট তাঁবুর ভেতর পড়ে থাকা মনের তৃপ্তি। মানবসভ্যতার সেই ভোগচরিতার্থের সংকুচিত আয়না মরীচিকা হয়ে অক্ষরে ফুটে উঠেছে। দুঃখ নিয়ে বাঁচা শরীর দুঃখের আবর্তেই তার ক্রন্দন ও শূন্যতাকে, তার সন্ন্যাস ও বিছিন্নতাকে অনুধাবন করেছে।তাই শরীরের যৌনপুঁথি গোপন করেই ‘পথের পুরোনো ধুলো’ কাব্যে ‘স্মৃতি সন্ন্যাস’ কবিতায়  লিখেছেন:

“শিল্পশরীরে থাকে জীবন ও শূন্যতা

ভেতরে সন্ন্যাস, তবু পুনর্জন্ম ভেবে

ভবিষ্যৎবাণী মাঝে মাঝে ভুল হয়।”

    বিভ্রান্ত কবি ২০০৯ সালে দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদে যে প্রেমের মৃত্যু দেখেছেন, যে অসহায়তা তাঁকে ক্লান্ত করেছে তা দুর্মর এক অভিশাপ হয়ে উঠেছে। উলটপালট করে দিয়েছে জীবনের সমূহ লক্ষ্যকে। স্মৃতিময় দাম্পত্য জীবনের মুহূর্তগুলি অনুধাবন করতে করতেই ‘হলুদ তুলোট পাতা’কাব্যের ‘প্রকাশক’ কবিতায় লিখেছেন :

“পাগলের মতো পাণ্ডুলিপি সারা ঘরময়

সকালে কাজের মাসি এসে

সব ধুয়ে দেয়

 

ক্রমশ ফেটে যায় বুক

রক্তপাত চশমা দিয়ে দেখা যাচ্ছে

ওই যে বইপাড়ায়, সে একা বিষণ্ণ”



    সমগ্র পৃথিবীই কবির কাছে পাণ্ডুলিপি। সব পাণ্ডুলিপিই এলোমেলো। ফাটা বুক নিয়ে রক্তপাত দেখেন। এই রক্তপাত কখনো রান্নাঘরে আনাজপাতির ভেতর,কখনো হৃদয়ের ক্ষরণে। ঘরের নারীটি চলে গেছে বলে কবিও ঘরপোড়া গোরু। জীবন ঘা খেতে খেতে অন্ধ হয়ে গেছে। কবি তখন লিখেছেন:

“যাযাবর পাখি আমি

পোড়া ডালে আশ্রয় নিয়েছি

এখানে রক্তপাত নেই,দীর্ঘশ্বাস নেই”

    কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারেননি,চেতনার কুঠার সর্বদা রক্তাক্ত করেই চলেছে। ‘এ বড় কঠিন সময়, ভাবছে প্রাচীন পাখি’ বলি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন।

   মানসকুমার চিনির প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গেই যেন কবিতার দগ্ধরেণু উড়েছে। জীবন যতখানি পুড়েছে,শূন্যতা যতখানি শূন্য করেছে, অভিমান যতখানি অশ্রুর মালা পরিয়েছে—কবিতা ততই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষয় বহন করে এই সময় ও সভ্যতার কাছে তার স্বাক্ষর রচনা করেছে। কবির জীবনে কখনো স্থিরতা আসেনি। প্রেমের মহিমাও কবিকে জাগাতে পারেনি। মানবিক চৈতন্যের ধারক ও বাহক হয়েও তিনি চিরদিন বর্জিত নির্বাসিত হয়ে দূরে ছিটকে পড়েছেন। তাই কবিতাগুলিতে পূর্ণতার পরশ নেই। সর্বদা এক নেগেটিভ পৃথিবী,এক দুঃখময় আরতির আয়োজন তাঁর শব্দ ও বিশ্বাসভঙ্গতায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই লিখেছেন:

“মাটির ওপর কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনি”

     কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাণীও তিনি মানতে পারেননি।সুতরাং বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে। সমগ্র কবিচেতনায় বিচ্ছিন্নতা এমনই অমোঘ হয়ে উঠেছে যে, কোনো কোনো সময় কবি পৃথিবীরও কেউ নন এমনও মনে হতে পারে। চারিপাশে অগাধ শূন্যতা, বেঁচে থাকা বস্তুময় সম্ভার। জীবনও এক তামাশার পরাভব। সুতরাং তাঁর কবিতায় অর্থ বের করা এক বোকামির নামান্তর। স্বাভাবিকতা সেখানে যেমন অচল, তেমনি প্রচলিত পোস্টমডার্ন,ম্যাজিক রিয়ালিজম বা কিউবিজম-এর পথও তিনি মাড়াননি। নিজস্ব ভাঙনের পথেই আলুলায়িত হয়েছেন। ভাবনার বিচ্ছিন্নতাকে কবিতার আঙ্গিক করে তুলেছেন। বিছিয়ে দিয়েছেন অনুভূতি, ভাঙা হৃদয়, আত্মগত কারুণ্য এবং বিনম্র দৃষ্টি। ছিন্নভিন্ন বস্তুর পরিত্যক্ত স্তূপে নিজের মর্মান্তিক ধ্বংসকে উপলব্ধি করেছেন। সেগুলিই যেন তাঁর স্বরূপের অবিন্যস্ত অবয়ব। সুতরাং পার্থিব প্রকৃতির মোহানিয়া রূপের চিরাচরিত বর্ণনা তাঁর কবিতায় নেই। তার বদলে হৃদয়ের ছায়াই সেখানে পতিত হয়েছে। যে হাতে তিনি যাকে ছুঁয়েছেন, যে মুঠিতে তিনি যাকে ধরেছেন—সেই ছোঁয়া, সেই ধরা এক বিপন্ন নাথিংনেস্। এলোমেলো অপূর্ণ অসফলতার দীপ্তি নিয়ে নিষ্প্রভ এক জীবন।

    মানসকে প্রথম কবে দেখেছি আজ আর মনে পড়ে না ।তবে পথচলতি রাস্তায় হঠাৎ করে মানুষ যেমন কলম কুড়িয়ে পায়, তেমনি তার সাথে আলাপে আমার বুক পকেটে একটা আনন্দ জমা হয়েছিল। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল সে আর পাঁচটা মানুষের মত স্বাভাবিক নয়। কবিতা তাকে বরবাদ করে দিয়েছে। বিশেষত একটা ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকা ,কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়া এবং হেতু হীন মদ্যপানের প্রতি তার আসক্তি আমাকে  সাহায্য করেছিল তাকে এভাবে চিনতে। যদি একটি মাত্র কথায় মানসকে ধরার চেষ্টা করা যায় তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় "কবিতা অন্ত প্রাণ"। আর একটি মানুষ কবিতাগত প্রাণ হবে অথচ সংসার দু-হাত বাড়িয়ে তাকে অক্টোপাসের মতন গ্রহণ করবে, আদরে যত্নে ভরিয়ে তুলবে তার সংসারের উঠোন সেটা সম্ভবত বাংলা কবিতায় কখনো হয়নি। আগামী দিনেও হবে না। ফলে চলতি জীবন থেকে যেটুকু প্রাপ্তি তার চেয়ে অনেক কম, ছিঁটেফোঁটা হয়তো এসে পড়েছিল মানসের আঙ্গুলে। মূলত তার সাথে দেখা হতো কবিতা উৎসবে কিংবা লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় ,তাও অনুষ্ঠানের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের আড্ডা ,কথোপকথন । তা থেকেই বোঝা যেত মানস ক্রমাগত চেষ্টা করছে আকাশের ওপারের আকাশকে দেখার। একটা অগোছালো জীবন হাতের তালুর ওপর রেখে নেড়েচেড়ে দেখতে চাইছে তার কোনদিকটাতে কবিতা লেগে আছে, সূর্যাস্তের সময় তা কিভাবে রং পাল্টায়। বাংলা কবিতার প্রতিটি মানুষই অসফল। আমরা যাকে আপাতপ্রাপ্তি বলি তাও মূলত প্রাপ্তির চেয়ে যোজন যোজন দূর। সুতরাং একটা জীবন ঠিকঠাক তারে বেজে উঠল না বলেই যে সেই সুর কাউকে কাউকে মোহিত করেনি তা কিন্তু নয়।আমার বিশ্বাস, তরুণ কবিদের একটা বিরাট অংশ যারা বুক ঘষে ঘষে কবিতা লেখে তারা মনে মনে স্বীকৃতি দিয়েছিল মানসকে।। দুর্ভাগ্য, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চিত জীবন এসব বাংলা কবিতার গায়ে লেগে থাকা অক্ষরের মতো। এসব দেখেই ধীরে ধীরে বড় হয়েছে বাংলা কবিতার পাঠক। ফলে মানসকে আপন করে চিনতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। যতবার দেখা হয়েছে, অদ্ভুত হাসি হেসে কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করার পর  সে বাড়িয়ে দিয়েছে একটি এক ফর্মার বই ,১২/১৪ টি কবিতার সমন্বয়। আর নিচু গলায় বলেছে পড়ে দেখো, জানিও। হঠাৎ করে কাউকে না জানিয়ে মানস যে এতটা নদীর জলে নেমে গেল ওকে কি আর পাড়ে নিয়ে আসা যাবে? পড়ে থাকা যেসব স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া বন্ধু-বান্ধবদের, তাদের যেভাবে একটা তাকে তুলে রাখি , তেমনি সদ্য দুটি বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখলাম মানসকে। বন্ধু মানসকে প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল তোমাকে চিনি। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে তোমাকে আমার সেভাবে চেনাই হলো না।

প্রিয় মানস

অরবিন্দ সরকার

       প্রিয় কবি মানস কুমার চিনি হঠাৎই ১৬ ই আগস্ট আমাদের ছেড়ে চম্পট দিলেন। আলাপ তো দেখতে দেখতে বছর পঁচিশ তো বটেই। প্রথম দেখা হয়েছিল কলকাতায় বাংলা আকাদেমি চত্বরে। অল্প সময়ের মধ্যেই মনের ছোঁয়া পেলাম। বলল আজ বেশী কথা বলতে পারবো না ফিরতে হবে খড়্গপুর। পরিচয়ের আগেই ওর কবিতার সঙ্গে আমার সংযোগ।  পরের বছর হঠাৎই দেখা হয়ে গেল আবার কলকাতা বইমেলায়। লিটলম্যাগ এর স্টলে । একগাল হেসে হ্যান্ডসেক। কী আন্তরিকতা । এক মাথা চুল। কোঁকড়ানো। পরনে হায়োই শার্ট । বাঁদিকের কাঁধে সাইট ব্যাগ।  তখন মেলা বসতো ময়দান চত্বরে । 

       মানসের জন্য জন্ম পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানগোলা ব্লকের কলাবেড়িয়া গ্রামে ১৯৬৫ তে। কিন্তু অতি শৈশবে বেড়ে ওঠে নলপুরে হাওড়া জেলাতে। তারপর বাল্যকাল কাটে মেছেদা তে। পড়াশোনায় ভালো। ছোট বেলা থেকে লাইব্রেরী তে যাতায়াত। বই পড়ার ঝোঁক। আকর্ষণ কবিতার বই। মনে হয় তখনই কবিতার প্রতি টান অনুভব।   তারপর  স্থায়ী ভাবে খড়্গপুর। ১৯৮৮ সাল থেকে। অখন্ড মেদিনীপুরের কবিদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। তার তীব্র ঝোঁক ছিল লিটলম্যাগাজিন সংগ্রহ। নিজের জেলা সহ পশ্চিম বঙ্গের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত ছোট বড়ো সব পত্র পত্রিকা তিন হাজারের মত তাঁর সংগ্রহ শালায় ছিল পরম যত্নে। ঈর্ষণীয়। আমাকে যেতে বলেছিল বেশ কয়েক বার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারিনি।এখন খুবই আপশোষ হচ্ছে।সুস্নাত জানা দার বাড়ি তে। তাঁর বাবা প্রণম্য মালী বুড়োর সংগ্রহ শালায় ‌ । সুস্নাত দা পরে আরো বাড়িয়েছেন। মহিষাদলের হরপ্রসাদ দার লিটলম্যাগাজিন সংগ্রহ শালায় দুবার গিয়ে ছিলাম। তারিফ করতেই হবে অখন্ড মেদিনীপুর থেকে বহু মূল্যবান পত্র পত্রিকা বিভিন্ন  বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নিয়মিত বেরিয়েছে। এবং এখন বেরুচ্ছে। মোবাইলের দাপট সত্ত্বেও।  সম্পাদক নীলোৎপল জানা যেমন ওয়েব এবং প্রিন্ট দুটোই চালিয়ে যাচ্ছেন দক্ষতার সঙ্গে।

      ফিরে আসি মানসের কথায়। তমলুকে মামার চায়ের দোকানের আড্ডায় মানস কে বার তিন/চার যোগদান করেছে। হলদিয়া তে বার চারেক। প্রতি বারই দেখা হলে ওর নতুন বই হাতে দিয়ে বলতেন দাদা পড়বেন। বছর দুয়েক বর্ধমানে এক সাহিত্য সভায় এসেছিল ।গোটা চারেক কবিতা পড়েছিল। সবার ভালো লেগেছিল। শেষের দিকে বারো / চোদ্দ বছর কলকাতায় ছিল। ফোনে নিয়মিত কথা হয়। শেষের দিকে রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি পাঠাতো। একটা মেন্টাল ক্রাইসিসে ছিল। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করতাম ওর মানসিক শক্তি বাড়াতে। তবে ওর চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য কখন কাব্য চর্চায় ভাটা পড়েনি। নিয়মিত বই প্রকাশ করেছে। কবিতায় বরাবর নতুন কিছু দেবার চেষ্টা করেছে। একই বছরে চারটিও কবিতার বই প্রকাশ করেছে। ১৯৯০ সালে তাঁর প্রথম বই প্রকাশ হয়। আটত্রিশ টির উপর তার কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অন্যতম প্রিয় কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ।

      তাঁর চলে যাওয়া ভীষন কষ্টের। সহজ সরল জীবন যাপন। কাব্য চর্চাতেও  নিবিষ্ট। আমাদের এক কাছের বন্ধুকে হারালাম। মিষ্টি ব্যবহার ভোলবার নয়।


আমার মানস চিনি

সুনীল মাজি

 

মানসের সঙ্গে আমার পরিচয় বাইশ বছর আগে। সালটা ২০০২।  কাঁচা মাটির  দুর্গা প্রতিমার কাজ চলছিল তখন।  আগস্ট মাসের কোনও এক রোববার।

তখন তিনি থাকতেন বোগদা পোস্ট অফিসের পেছনে।

কোনও এক অনুষ্ঠান ছিল মানসের প্রতিবেশির বাড়িতে। সেখানেই প্রথম পরিচয়।

 অনিল ঘড়াইয়ের কাছেই  আমি এই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার জনা পঞ্চাশেক কবির নাম জানতে পেরেছিলাম। তিনি তাঁদের কবিতার চরিত্র নিয়ে নিজের মতো ব্যাখ্যা দিতেন।কবিতা-পাগল মানসের কথাও বলেছিলেন।  মানস প্রথমের দিকে বই প্রকাশে অনীহা ছিলেন। অনিল ঘড়াই মানস চিনিকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে উৎসাহিত করেছিলেন।

‘কবি এদিকে এস, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই!’

মানস চিনি গলার স্বরে ফিরে তাকিয়ে ‘অনিলদা’ ডাক দিয়ে এমন এক প্রাণ খোলা হাসি হাসলেন যে, মনে হলো অনেকদিন পর দুজনকে অমন পবিত্র হাসি হাসতে দেখলাম। একেবারেই ফুলের হাসি ছিল সূর্যমুখী। অনিল ঘড়াইয়ের সঙ্গে মানস চিনির যখনই দেখা হতো তাঁদের দুজনকেই সেই নিঃস্পাপ হাসতে দেখতাম।

অনিল ঘড়াই মানস চিনিকে ‘কবি’ ডাকতেন। এই ডাক ছিল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এক কথা-সাহিত্যিকের ডাক। কত বড় সম্মান তা অনুভব করি।

মানস আনখশির কবি ছিলেন। তাঁর পোশাক, তাঁর কথা বলা, তাঁর উদাসীন দৃষ্টি—সব কিছুই ছিল কবি সুলভ।

অনিল ঘড়াই সিগন্যাল  এন্ড টেলিকমিনিকেশন কলেজ থেকে পোস্টিং পেয়েছিলেন স্টেশনের কাছে টেলিফোন সেন্টারে।  পাশের বিল্ডিংটাই ছিল মানসের কোয়ার্টার। ততদিনে মানস ‘কবিতা বাগান’ তৈরি করেছিলেন মনের মতো করে।  দুটো বড়ো রুমের একটি বেড রুম।  অন্যটি লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে থরে থরে সাজানো থাকতো বাংলার প্রথম শ্রেণির লিটিল ম্যাগাজিনগুলি।  ব ই ছিল, তবে বলা ভালো এই কক্ষটি হয়ে উঠেছিল  লিটিল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালা। রুমের সামনে দীর্ঘ দুয়ার এবং বিস্তৃত উঠোন। বারান্দার সামনেই চেয়ার টেবিল সাজানো থাকতো।  আড্ডা দেওয়ার সু ব্যবস্থা ছিল । মিনিটে মিনিটে রেলের মুখ্য ঘোষক রণবীরদার মধুর কণ্ঠের ধারাভাষ্য ভেসে আসত। লাল বাড়ির সামনেই সবুজ শ্যামা দুর্বা ঘাস। অঘ্রানের সকালে ঘাসের শরীর ঘিরে মুক্তো শিশির। পেছনের গেট পেরিয়ে মানসের অফিস এক মিনেটের কম সময়। চারিদিকে অফিস বা সাইকেল স্ট্যান্ড। মাঝে একটাই  ফ্যামিলি কোয়ার্টার। কবির বাড়ি। কবিতা বাগান। কবিতা মোনালিসা।

তিনি নব্বই দশকের কবি। ছোট ছোট নিঃশ্বাস ধরতেন। একটা দৃশ্য।  এক চিলতে দাগ।  একটু বেজে ওঠা। খুব মৃদু উচ্চারণ।  এক আশ্চর্য ঈশারা। তিনি ছোট ছোট পাস খেলতেন। ড্রিলিং করতেন। চলমান মানুষ ও তাঁর ভাবনা। ভাবনার ছায়া। মানস সেই ছায়া দেখে বলে দিতেন মানুষের ভেতরের দিনরাত্রির কথা।

একসময় আনন্দ বাজার থেকে আজকাল দৈনিক খবরের কাগজে নাকি চিঠি লিখতেন। পত্র লেখক হিসেবে পরিচিত হচ্ছিলেন। এই শব্দখেলা তাঁকে টেনে নিয়ে এল বুকের নীল বিষাদের কাছে নতজানু হতে। তিনি আশীর্বাদ পেলেন মণীন্দ্র গুপ্ত আলোক সরকার শঙ্খ ঘোষের।  পশ্চিমবঙ্গের  এমন কোনও লিটিল ম্যাগাজিন ছিল না যেখানে তিনি কবিতা লেখেননি।  কবিতা ছিল তাঁর প্যাশন। এক নেশাঘোর স্বপ্ন। লিটিল ম্যাগাজিনের কবি ও কবিতা ছাড়া আমি কখনও অন্য কিছু আলোচনা করতে

কখনও শুনিনি। কয়েক শত কবির নাম ঠিকানা বলে দিতেন। তাঁর স্মরণশক্তি এতটাই তীব্র ছিল যে, কোনও ভালো কবিতা কোনও ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেলে সাল ও সংখ্যা উল্লেখ করতেন।

  মানস প্রচার বিমুখ ছিলেন একথা বলা যাবে না। কবিতার জন্যই তাঁকে দূর দূর লিটিল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও মেলায় দেখা যেত। তাঁর নির্দিষ্ট বন্ধু সার্কেল ছিল যারা কেবলই কবিতা অন্ত প্রাণ।

 লিটিল ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশ পেলে তাঁর মুখে তারা ফুটত। সেই আনন্দ ছিল দেখার মতো। তবে যেদিন দেশ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ পেল সেদিন মনে হলো  তিনি অনেক টিলা পেরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে উঠেছেন। বুকভরা রোদ নিয়ে সে কি ঝলমল রূপঐশ্বর্য!জীবনে এই এক অমল রোদ্দুরের খোঁজে কত কত সকাল বিকাল তিনি এই রেল শহরের বোগদার মণি শংকরী বুক স্টলে বসে থাকতেন। সাদা খামে কবিতা পাঠাতেন। ডায়েরিতে লিখে রাখতেন কাকে কোন্ সংখ্যার জন্য  লেখা পাঠালেন। মাটি রঙের পোস্ট কার্ডে বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণের আদান প্রদান হতো। আহা, জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর সে এক আশ্চর্য জীবন ছিল  মানসের। কত কত পাখির কলতান। রেলের হুইসেল বাজলেই পাখিরা আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়ত।

একদিন তিরবিদ্ধ পাখি হয়ে এই শহর ছেড়ে চলে গেলেন মানস। গার্হস্থ্য জীবনের দাউ দাউ আগুন নিয়ে কবিতা লিখলেন। শেষের সব লেখাই জত্যুগৃহের আর্তনাদ। জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো এই সময়েই তিনি লিখেছিলেন। মানসের  তিন দশকের কবিতা জীবনের  প্রথম দুই দশক ছিল শিল্পের জন্য কবিতা।  শেষের এক দশক ছিল জীবনের জন্য কবিতা। অনেক আকাশ অনেক  সমুদ্রের নির্জনতা ও শূন্যতা নিয়ে মানস ছিলেন। হাত কাঁপত। হাঁপাতেন। তবু কবিতায় অক্সিজেন কম ছিল না।

জীবনের শেষ সাত বছর কলকাতায় ছিলেন। দুটি দীর্ঘ চিঠি আমার কাছে অমৃত সম্পদ হয়ে থাকবে। যতদিন বাঁচব ততদিন অনিল ও মানসের স্মৃতি নিয়ে বাঁচব।

 

চেনা মানস, অচেনা মানস

আশিস মিশ্র

   ঘুম ভাঙলে ইদানিং বিছানায় কিছুটা সময় বসে থাকি। বুকের ভেতরে একটু খুটখাট হলেই মনে হয়, তবে কী..পুনরায় দৌড় শুরু হয়। হঠাৎ কমলের টেলিফোন। মানস চিনি নেই! খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাইনি, কেননা মানসের পথেই তো যেতে হবে একদিন। তারপর ফেসবুকে মানসের ছবি দেখতে দেখতে মনে হলো, ওর তো চলে যাওয়ার সময় হয়নি এখন!

   ছয়- এর দশকে জন্ম নেওয়া আমাদের অনেক কবি - সম্পাদক - শিল্পী - সাংবাদিক বন্ধু রয়েছে। কেউ কেউ শূন্যে মিলিয়ে গেছে! কেউ কেউ অসাধারণ কিছু কাজ করছেন, কেউ কেউ ভালো লিখেও মৃত্যুর পর আর এজগতে বেঁচে নেই! মানসকেও একদিন সবাই ভুলে যাবো, দু' চারটে স্মরণসভার পর। মৃত্যুর আগে ও পরে কবিজীবনের এই ট্র্যাজেডি আমাদের অনেকের জন্য শিরোধার্য হয়ে গেছে।

   ৮ -এর দশকের শেষে ও ৯-এর দশকে মানস সহ আমাদের কবিবন্ধুদের বেশ দাপট ছিলো। হঠাৎ হঠাৎ মেচেদার রেল কোয়ার্টারে মানসের কাছে চলে যেতাম। চায়ের আড্ডায় লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি নিয়ে কথা হতো। তখন মানস বিভিন্ন সংবাদপত্রে পত্রলেখক হিসেবে বেশ পরিচিত। তারপর তার কবিতার ভুবন জয়। দেখতে দেখতে ১ ফর্মা ২ ফর্মার কবিতার বই প্রকাশিত হতে থাকল। মেচেদা ছেড়ে মানস চলে গেল খড়গপুরে রেল কোয়ার্টারে। ঠিকানা না দেখে দূর থেকে বলে দিতাম, এটি মানসের চিঠি। তার সঙ্গে আমার কিছু  চিঠির আদান- প্রদান হয়েছে। তার দু' চারটে খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে।

    মানস তার মনের মতো একটি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গড়ে তোলে। অখণ্ড মেদিনীপুর জেলায় তখন সম্ভবত ওর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি প্রথম( এই তথ্য ভুল হলে বলবেন)। সন্দীপ দত্ত-র প্রেরণায় এই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে কলকাতার বাইরে। মানস যখন যেখানে থেকেছে তার বন্ধুবৃত্তের অভাব হয়নি। কত নাম বলবো? আর কত কবিসভার কথা বলবো? অনেক সভাতেই মানস সহ আমরা অনেকেই থেকেছি। মনে পড়ে একবারাই ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম ( বাজকুলের অদূরে)। আর খড়গপুরে ওর কোয়ার্টারে একবার। তখন ওর সাংসারিক টানাপোড়েন শুরু হয়নি। মানস বলে ডাক দিতেই সে দরজায় এসে দাঁড়ালো। এক গাল হেসে ভেতরে নিয়ে গেলো। ভাবলাম এবার বুঝি ও বাড়িতে তৈরি চা- টা খাওয়াবে। কিন্তু না,  মানস আমাদের দুই বন্ধুকে নিয়ে স্টেশনের কাছে এসে চা খাওয়ালো। বেশ কিছু সময় কথা হলো। তখন ওকে বেশ আফসোস করতে দেখেছি কবিতা নিয়ে। শুনলাম, পরে পরে মানসের জীবনে ছন্দপতন। ওর সব বইপত্র সে দান করে দিয়েছে, এবং কলকাতায় চলে গেছে। রেলের চাকরিতেও নেই।

     তার মধ্যেও ওকে বেশ উদভ্রান্ত অবস্থায় দু' একটি জায়গায় দেখেছি। হলদিয়াতে ডেকেছি। তবে ওর শরীরের অসুস্থতার জন্য হলদিয়ার কবিসম্মেলনে প্রতিবছর ডাকতে পারিনি। কেননা ও বেশি সময় আড্ডা দিতে পারতো না। বিশ্রাম নিতে হতো ওকে।

     একটা সময় এই কবিসম্মেলনে না - ডাকার জন্য ওর রাগ বা অভিমান হয়েছিল। যে কারণে ও একটি মুখবন্ধ খাম পাঠিয়ে দিত। তাতে ওর রাগ ও অভিমানের বিষয় ধরা পড়তো। সেই সব চিঠির উত্তর দিতাম না। কিন্তু কলকাতায় মুখোমুখি হলে চা খেয়েছি, আবার কখনো পরস্পর পরস্পরকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা হতো। ওর মৃত্যুর আগের কয়েক বছর ওর সঙ্গে তেমন অটুট বন্ধুত্ব ছিলো না। এর কোনো বিশেষ কারণ ব্যাখ্যা করা মুশকিল।

     তবুও মানস কলকাতায় থাকতে থাকতে তার লেখালেখির জগতকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এসব দূর থেকে বুঝতাম। বড়ো কোনো পত্রিকার শারদ সংখ্যায় তার কবিতা ছাপা হচ্ছে, বড়ো প্রকাশনা থেকে তার বই বেরচ্ছে --তার খ্যাতিতে আমরা অনেকেই আনন্দ পাচ্ছিলাম। কিন্তু মানস ভেতরে ভেতরে একেবারে যে একা হয়ে গেছিল, সেই 'একা মানসকে ' আমি ও আমরা অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছি!

     তার নিজের লেখালেখি নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি  বই নিয়েও এমন একজন মানুষকে ফেসবুকে বিরুপ মন্তব্য করতেও দেখেছি। সে-সব নিয়ে মানসের কিছু যায়- আসেনি। কেননা, যে কোনো মেদিনীসন্তানের কবিতার প্রবল পরিক্রমা, শহুরে কোনো কোনো বাবুকবির কাছে যে মান্যতা পাবে না --এটা জানা হয়ে গেছে। মানস মরে গিয়েও প্রমাণ করে গেলো, কবিতার আঙ্গিক, ভাষা ও বিষয়বস্তু সে তার নিজের মতো করে লিখে গেছে। হয়তো প্রবল প্রতিভাবান সে নয়, কিন্তু কবিতাপ্রাণ বটেই । এটাই 'চেনা মানস ' ; আর ' অচেনা মানস' - কে সে তার নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখত।


বেদনাবিদ্ধ যে কবি হাসতে হাসতে চলে যায় 

নিমাই মাইতি 

     সেই ১৯৮৫-৮৬সালে এক শীত সন্ধ্যায় মেদিনীপুর রবীন্দ্র নিলয়ে আমাদের পরিচয় এক কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে। আমি আর অনিল ঘোড়াই দাঁড়িয়ে গল্প করছি  হঠাৎ এক সৌম্য দর্শন কোঁকড়ানো চুল যুবক এসে পরিচয় দিয়ে বলল, আমি মানষ চিনি। খড়্গপুরে থাকি। একটু আধটু কবিতা লিখি। অনিল ও সায় দিয়ে বলল, উঠতি কবি। দেখেই ভালো লেগে গেল। সেই থেকে পরিচয়। যখন যেখানে দেখা হয়েছে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেছে ভালো মন্দ খোঁজ নিয়েছে। পরে পরে যখন গভীরতা বেড়েছে জীবন সংসারের অনেক অজানা কথা ও বলেছিল সেসব দুঃখের মর্মান্তিক। সে সব না বলাই ভালো।

      রেলে চাকরি করা সত্ত্বেও এমন একজন মানুষের জীবনে এত আঘাত বিপদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকা যে কি যন্ত্রনাময় মানষ বুঝি সবই নিয়ে এতদিন বেঁচে ছিল নিজের মধ্যে ক্ষত বিক্ষত হয়েও। পরে অবশ্য মাঝে মধ্যে বলত, নিমাইদা হয়তো বেশি দিন বাঁচব না।

     খড়্গপুরে থাকাকালীন কবিতা বাগান বলে একটি লিটিল ম্যাগ সংগ্রহশালাও করেছিল। পরে সব বইপত্র দানও করে দেয়।

     তার অধিকাংশ কবিতার বই এক ফর্মার।  শেষের দিকে দুটো পারফর্মার বই করেছিল গ্রন্থ পঞ্জি ও কবিতার বই নিয়ে। অকাতরে হাতে হাতে দান ও করেছে।

     শেষের দিকে কলকাতায় দাদার কাছে থেকে ও জীবনে সামান্য সুখ ও পায়নি। পারিবারিক অশান্তি রাতদিন পিছু তাড়া করে বেড়িয়েছে। তার অমলিন হাসিমুখের ভেতর যে কত ঝলসানো চাঁদের অন্ধকার লুকিয়ে ছিল হয়তো আমরা বাইরে থেকে তেমন কেউ উপলব্ধি করিনি। এত কম বয়সে তার চলে যাওয়া সত্যিই খুব দুঃখের। আজ সে নেই, অনেকেই আমরা শোকাহত। খড়্গপুর তথা বাংলা এক বলিষ্ঠ কবিকে হারালো। বাংলা সাহিত্য এবং আমরা ও তার কাছে ঋণী। তার আত্মার শান্তি কামনা করি। এছাড়া আর আমাদের কি বা দেওয়ার আছে।

         

কবি মানসকুমার চিনির মানবতা  কাব্য দর্শন

নবকুমার মাইতি

          "সাহিত্য জীবন সত্যের প্রকাশ।" টেনি বলেছেন-"Literature is the transcript of Societies." অর্থাৎ সাহিত্য সমাজের সারসংক্ষেপ। আর সেই জীবন সত্য অনুসন্ধানের জন্য ডুবুরির তৃষ্ণা নিয়ে পথচলা গুটিকয়েক কবি সাহিত্যিকের মধ্যে অন্যতম জীবন পথিক কবি,মেদিনীপুর জেলার মানস কুমার চিনি, আমাদের সবার প্রিয় মানসদা। কাব্য দর্শনের সব ক্ষেত্রে তিনি সাগর সিঞ্চন করে মুক্তো বা মনিকাঞ্চন তুলে আনতে পেরেছেন, কিনা সে বিচার করবেন নীরবধিকাল ও গবেষণালব্ধ কাব্য- প্রতিতী। তথাপি বলবো সাহিত্যের সুবিস্তৃত আকাশে মানস চিনি বহু মূল্যবান সৃষ্টি রেখে গেছেন, উজ্জল মণিম্ময় তার আভা,তার দ্যোতনা আমাদের মত অনেক কাব্য প্রেমিক অনুজপ্রতিম ও অগ্রজপ্রতিম লেখকদের জন্য তিনি আমৃত্যু নিরলস ভাবে কাব্য সাহিত্যের সাধন ক্ষেত্রকে ঋষিতুল্য প্রজ্ঞা নিয়ে সুবিস্তৃত করে গেছেন। আঞ্চলিক স্তর থেকে দেশ-বিদেশের বহু পত্র-পত্রিকায় তার স্বর্ণাক্ষর প্রমাণ ও প্রত্যয় রেখে গেছেন।

    কাব্য লক্ষ্মীর সেবার নিয়োজিত প্রাণ মানসদা একের পর এক অজস্র কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি চলমান কালের  দর্পণ ও সাহিত্য সংস্কৃতির বহুধা বিভক্ত দর্শন তুলে ধরেছেন ।তার রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থনোনাবালি, স্রোতের ছায়া, নতজানু, চিররাত্রি, পটুয়া পাড়ার ঈশ্বর, পথের শেষে দেখি, বিষন্ন প্রেমিকার বেহালা, ছিন্ন পদাবলী, আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন (২০২২) প্রভৃতি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লব্ধ প্রতিষ্ঠ পত্রিকা আনন্দবাজার তথা দেশ পত্রিকায় তার প্রকাশিত বহু কবিতা পাঠকদের মুগ্ধ করেছে।

    মানস চিনির কাব্য দর্শনে প্রতিভাত ছিল -হিরন্ময় আকাশ,  ঝিরঝিরে বাতাস, মানব মানবীর প্রেম, বিচ্ছেদ, হাহাকার, দুঃখী মেহনতি অন্ত্যজ মানুষের বেদনার যাপন চিত্র তাঁর সাধন লিপিতে তিনি সুনিপুণভাবে অঙ্কন করেছেন।ব্যক্তি জীবনেও তিনি আপনার জনের বিচ্ছেদ ব্যথায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন নিরন্তর পথ চলতে বারবার হোঁচট খেয়েছেন, দুঃখের অভিঘাতে মুষড়ে পড়েছেন কিন্তু পথ চলা বন্ধ করেননি। তিনি জানতেন উপনিষদিক ব্রহ্ম চিন্তার দর্শন- "চলমানতাই জীবন" তাই স্থবিরত্ব নয়,বাধা বিঘ্নকে অতিক্রম করে নিরন্তর পথ চলতে হবে। সৃষ্টির পথ, জীবনের পথ, মানবিকতার পথ ।

    কলেজে বি.এ.অনার্স পড়ার সময় কিশোর বয়সে মানসদার কাব্য কবিতা গল্প তথা তাঁর সুসম্পাদিত বিখ্যাত 'মোনালিসা' পত্রিকার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল বর্ষিয়ান কবি সাহিত্যিক তথা গীতিকার শ্রদ্ধেয় ক্ষিতীশ চন্দ্র সাঁতরা বাবুর সাহায্যেতারপরে ক্রমশ কলাবেড়িয়া, ভগবানপুর, ইলাশপুর, আনন্দ বিহার (পশ্চিমবাড়) থেকে খড়্গপুর, এগরা, দাঁতন,মেদিনীপুর তথা কলকাতার বহু সাহিত্য সভায় বরিষ্ঠ কবি ব্যক্তিত্ব হিসেবে বহু জায়গায় তার অন্তরমথিত কাব্য পাঠ  কাব্যালোচনা শুনেছি এবং ক্রমাগত ঋদ্ধ হয়েছি,সাহিত্যে অনুরাগ বেড়েছে,ক্রমশ আমার চিন্তা  চেতনার মধ্যে

।আজ প্রায় ৪০বছর ধরে সেই পথে হাঁটছি। একপ্রকার কবিতা পাগল মানুষ ছিলেন তিনি, কবিতাই ছিল তাঁর কাছে একমাত্র আশ্রয় ও প্রশ্রয়। নিজের চাকরি   জীবন খড়গপুর রেল কলোনির একঘেয়েমি ব্যস্ততম জটিল জীবন থেকে বারবার ছুটে এসেছেন কবিতার টানে, কবিতার সক্ষে,কাব্য লক্ষ্মীর উদাত্ত আহ্বানে ।


"নোনাবালি" কাব্যের পাষাণ প্রতিমা কবিতায় তিনি লেখেন তাঁর চিন্তন-

"গভীর রাতে নেমে আসে

 আমার চিন্ময়ী-

 আমি তার বন্দনা করি

 চরণে মাথা রাখি 

আর বলি-কেড়ে নাও 

আমার জ্বালা যন্ত্রনা  ভালোবাসা।

 চিন্ময়ী আমায় দেখে আর কাঁদে 

চিন্ময়ের ঝরে পড়া জলে আমি 

দেখি ক্ষমার নিঃশর্ত বাণী 

দুই হাতের পাপ ঢেলেছি সাগরে 

সমুদ্র মন্থনে উঠে আসে মাটি খড় তুষ 

আমি গড়ি পাষান প্রতিমা।"

"নোনাবালি" কাব্যের এই উচ্চারণেই তাঁর কাব্য নির্মাণের মূল শর্তটি এখানেই খুঁজে পাই কাব্য নির্মাণে যে সমুদ্রমন্থন তিনি করেছেন তা জীবন সমূদ্র জীবন ইতিহাস সময় তার চেতনায় অবিমৃশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছেনিরন্তর বিষাদের ভেতর নিজ স্বরূপকেই অন্বেষণ করেছেন সেখানে-

" চোখের ভেতর ভাঙ্গা দ্বীপ 

আলো পরে নিভে যায় 

নিজের ছায়ায়। " 

                 স্বাভাবিকের তুলনায় আমাদের প্রিয় কবি মানস কুমার চিনি একটু কম বয়সেই চলে গেছেন মানবিক জগৎ অর্থাৎ ধোলামন্দির রুপ পৃথিবী ছেড়ে অনন্ত অমৃত লোকের আহ্বানে,যা খুবই দুঃখের সৃজ্যমান কথা সাহিত্যের সারস্বত অঙ্গনে বেশ কিছুটা প্রাপ্তির অপূর্ণতায় রেখে গেলেন তথাপি বেদান্তের চিন্তা নিয়ে বলা যায়, তিনি (মানস বাবু)  দেহগত বা অবভাষিক ভাবে আপাতত প্রস্থান করলেও অগণিত কাব্যসাহিত্যপ্রেমী পাঠকের হৃদয়ে, তাদের মানষলোকে তাঁর  তাঁর সৃষ্টিসৃজন কর্মের অক্ষয় আসন পাতা থাকবে  সবশেষে শ্রদ্ধার মানুষ, মানবতার কবি মনসদার উদ্দেশে আমার সভক্তি প্রণাম জানিয়ে ইতি টানলাম। ওঁং শান্তি.....ওঁং শান্তি....ওঁং শান্তি......


 

কবিমানস 

অলক জানা 

      কু ঝিক্ ঝিক্ খড়গপুর রেলশহর এবং কবি মানস চিনি কোথাও যেন অনেকাংশে একাকার আলাদা করা যায় না। নয়ের দশকের শেষ কিংবা শূন্য দশকের শুরু থেকে মেদিনীপুরের পত্রিকা খুললেই কবি মানসদার কবিতা থাকবে, থাকতে পারে এমন বিশ্বাস মনে মনে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কবিতার মধ্যস্থতার আলাপটা হয়েই গেল মহিষাদলে হরদা, হরপ্রসাদ সাউ আয়োজিত কবি সম্মেলনে। কবিতাপ্রাণ মানুষটাকে তখন সত্যি বলতে বেশ ভালোই লাগত। বুঝতে পারিনি একটুও পারিবারিক আঙরা হুতাশে কবি মানস সতত দগ্ধ। অথচ মুখে স্মিত হাসির সরল রেখায় আড়াল করে গেছে সংসারিক কবিতার চির নির্বাসন। 

    সময়টা ২০০৩-৪ হবে, স্বর্গীয় প্রাবন্ধিক নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম দিন তিন-চারেক মানস চিনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আমিও অনেকটাই বোহেমিয়ান। হলদিয়া খড়গপুর মেদিনীপুর মহিষাদল তমলুক কলকাতা ইতিউতি ভবঘুরে আস্ফালন দেদার চলছে। হঠাৎ করেই এদিক সেদিক চলে যেতাম, অবশ্য এখন সেই উৎসাহ অন্তরে ইন্সটল করেছে বাইরে তার কোন প্রকট চিহ্ন নেই। মানসদা কোন একদিন বললেন, অলক একদিন আমার বাড়ি এসো। ট্রেন থেকে নেমেই আমার বাড়ি, অনেকগুলো বই দেবো তোমাকে। 

   একতলার রেল কোয়ার্টার। বই-পত্রপত্রিকায় ঠাসা। মুখমণ্ডলে অঢেল হাসির রসনা, কবি লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল ও আমাকে দেখে বারান্দায় বসালেন। ট্রেনবাস পেরিয়ে হলদিয়ার আপনজন অফিস থেকে আমি সবং থেকে লক্ষ্মীদা, কবি লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল কেবল একটা গোটা রবিবার কবি মানস চিনির সঙ্গে কাটাবো বলে দৌড়ে গেছি। কবিতার জ্বরে প্রায় ঘন্টা তিনেক অনায়াসে কাটার পর এক গ্লাস জল বা এক কাপ চা ছাড়াই মণিশঙ্করী বই দোকানের নিকট হোটেল দেখিয়ে মানসদা সেদিনকার মতো অতিথি আপ্যায়ন সারলেন। অবশ্য পরে জেনেছিলাম, তখন মানসদার সংসারটা একেবারে ভেঙে চৌচির। যাক এসব কথা, চা-জল নাই থাক বেশ কয়েকটি বই তো পাওয়া গেল! আপনজন পত্রিকায় পর পর কয়েকটি বইয়ের রিভিউ লিখেছিলাম আমি। বাহবা পেয়েছি, সঙ্গে আমার দু-তিনটে কবিতা গ্রন্থের অভিমত সহ বলতেন, অলক লিখে যাও। তখন ল্যান্ডফোন, প্রায় নিয়মিত আমাদের কথা হতো, সেই সঙ্গে কয়েক পাতা টানা রুলে লেখা নীল খামের অভিমানী চিঠি এখনো আমার কাছে গচ্ছিত। সে সময় অগ্রজ কবির তরফে এমন প্রাপ্তি আনন্দ হচ্ছিল বইকি। 

    রেলশহর খড়গপুর ত্যাগ, চাকরি থেকে ইস্তফা, মেয়ে আকাশলীনাকে নিয়ে কলতাতায় দাদার বাড়িতে আশ্রয়, কয়েক বছর পর মেয়েকে পাত্রস্থ করা সবই যেন মানসদার কবিতার আধার, হয়ে উঠল কবিতার নিজস্ব ভুবন। শরণার্থী শিবির, একক সংগীতের মতো বইয়ের পরতে পরতে কবি মানস চিনির দীর্ঘশ্বাস আমার মতো হয়তো অনেককে ব্যথিত করেছিল। ছোট ছোট অনু কবিতার আদলে তার পৌংক্তিমালা দর্শন ও চিত্রকল্পের বিন্যাসে আবিষ্ট। সতর্ক হয়েছিলাম, জীবন ও সংসারের চেয়ে কবিতা বড়ো নয়, বা হতে পারে না। কবিতা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অংশমাত্র। তবু জীবন ও আঘাত যাপনের দীর্ঘশ্বাস সঁপে মানসদা বারবার কবিতার অতল নীলে নিরন্তর ডুব দিয়ে সব হারিয়েও কোথায় যেন একটা জিতে যাওয়ার স্বাক্ষর রেখে চলার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাতে কতখানি সাফল্য তা আমার অজানা থাকলেও সময় সবটাই জানে।

কবি মানসকুমার চিনির প্রয়াণে শ্রদ্ধাঞ্জলি 

 ননীগোপাল জানা 

 

'জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে' 

এই অমোঘ সত্যের সিন্ধুতে দাঁড়িয়েও- কবি বলেছেন 'কবির মৃত্যু নেই'। কবি তাঁর  সৃষ্টির  মধ্যে,কবিতার সাজ ঘরে বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকবেন সদ্য প্রয়াত কবি মানসকুমার চিনি, তাঁর লেখা ৩৭টি কাব্যের অমৃত উদ্যানে।

 পূর্ব মেদিনীপুর জেলা, ভগবানপুর থানার কলাবেড়িয়া গ্রামে জন্ম।  পিতা -বলাই লাল চিনি।  মাতা- ঊষা রানী চিনি । কবি তাঁর  'ছিন্ন পদাবলি'তে যেমন লিখেছেন 'গান মেলার হাটে' - আমরা সুর মাখি আনন্দ উড়াই । তিনি এখন তাঁরই সেই গান মেলার হাটে।ইংরেজি 17.08.2024, প্রায় 58 বছর  ছিলেন আমাদের মধ্যে। ঐ স্বল্প সময়ে রেখে গেছেন অসংখ্য গুণগ্রাহী মানুষ জন। মানস বাবু বয়সে আমার অনুজ ভ্রাতৃ প্রতিম।  শেখর পাল (বাজকুল) সম্পাদিত 'সাথী' পত্রিকায় এক সময় লিখতেন। সম্পাদকের সঙ্গে কবি মানস চিনির বন্ধুত্বের সুবাদে ,মানস বাবুর লেখা কাব্যগ্রন্থ 'ছিন্ন পদাবলি' ও 'মানস চিনি ৬০' দু' খানি বই আমার হাতে এসেছে। কবি মানস বাবুর  আর এক বন্ধু  শিল্পী পার্থ সারথি দাসের সংগ্রহ থেকেও পেয়েছি দু'খানি কাব্যগ্রন্থ- ধ্বংসস্তূপের স্মৃতি ও ফকিরের দোতারা।

 ছিন্ন পদাবলি’ কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখেছেন -

'প্রয়াত যাদের কবিতা পড়ি সারারাত'- জীবনানন্দ দাশ ,সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নরেশ গুহ, বীরেন চট্টোপাধ্যায় ,বিনয় মজুমদার প্রমুখ ১৪ জন কবির কবিতা। অকৃপণ উদার মানসিকতার কবি মানস বাবু তাঁদের প্রতি উৎসর্গ করেছেন তাঁর 'ছিন্ন পদাবলি' ।

     এই কাব্যে 'কবি' কবিতাটিতে লিখেছেন -

কয়েক মাইল নিজস্ব শরীর

দু' এক ফোঁটা রক্ত

মিলে যেতেই কলম সচল ।

আরো লিখেছেন-

কবিরা অনেক কাগজ টেবিলে নিয়ে

শাসন করে আত্ম অক্ষর

প্রতিষ্ঠানের পথ চেনায় প্রতিভা ।

 

     শিক্ষক সুহৃদ ভৌমিকের অনুপ্রেরণায় কবিতা লেখা ১৯৯০ সালে ।'নোনা বালি' কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবিতা প্রাণ মানস কুমার চিনির দৃঢ় প্রত্যয় 'ভালোবাসাই কবি কে বড় কবি করে'। হাসিখুশি মানস বাবু মানুষকে ভালবাসতেন, ডুবে থাকতেন তাঁর 'কবিতা বাগানে' গ্রন্থাগারে।

 

     আকাশবাণীতে কবিতা পাঠের সুযোগ পেয়েছেন একাধিকবার।  ৩৭টি কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন অসংখ্য  ছোট্ট কবিতা ।তাঁর অসংখ্য পৃষ্ঠার কবিতা জীবন। সেই সকল কবিতার লাইন গুনে গুনে গুণ খোঁজার কষ্ট পরিকল্পনায় সময় নষ্ট করছি না।  বিশেষ বিশেষ কবিতায় শব্দ ব্রহ্ম প্রয়োগে পাঠক গণের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন কবি । তাঁর জীবদ্দশায়  তাঁকে দেখেছি মনে হয়, কারণ সাথী পত্রিকার সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিল আগে। পরবর্তী সময়ে আমিও 'সাথী' পত্রিকার  সাথে যুক্ত হয়েছি, লিখেছি। কিন্তু তেমন স্মরণে আসেনি। তাঁর প্রয়াণে ব্যথিত কবি সাহিত্যিক 'দুই পাতা' ও 'লোক পথ' পত্রিকার সম্পাদক কবি, সাহিত্যিক ডক্টর নীলোৎপল জানা মহাশয় বিশেষ সংখ্যায়  প্রয়াত কবির স্মৃতি চারণ করতে চান ।তাঁর হার্দিক আহ্বানে মানসকুমার চিনির  চারখানি কাব্য গ্ৰন্থ সংগ্রহ করে পবিত্র গঙ্গা জলে  গঙ্গা পূজা করছি।

     কবি মানসকুমার চিনির জীবনে ছিল   বিচ্ছেদ ।  তাঁর 'ফকিরের দোতারা ' কাব্যে বিচ্ছেদের সুরে জন্ম দিয়েছে এক সুন্দর কবিতা-

যদি স্বপ্ন উড়ে যায়

যদি জীবন পুড়তে পুড়তে

লোকালয়ে রেখে যায়

সম্পর্ক হারানোর শোক

তবে টবের চন্দ্রমুখী

তুমিও তাকিয়ে থেকো ।

      'অতল জীবন' কবিতায় তিনি লিখেছেন -

তুমি চোখের ভেতর প্রদীপ জ্বেলে

দেখে নিও চারপাশে। যেন কোন নতুন জীবন

শনাক্ত করে তোমার শরীর

‘ছিন্ন পদাবলি’তে 'অন্ধ' কবিতায় ফুটিয়েছেন জীবন দর্শন 

অন্ধ ভালবাসা গ্রহণের দিন

মৃত্যু শর্ত ছাড়া কিছুই বোঝে না।

 

অন্ধ রাত্রি বিমূর্ত ভাষা

যৌনতা ছাড়া কিছুই বোঝে না।

 

অন্ধ পথিক

তার কোনও দুঃখ নেই।

তৃতীয় চোখ দিয়ে

সে পৃথিবী চিনে নেয়।

 

      কবি মানস বাবুর 'কবি ও কবিতা ' কবিতায় পাঠকের মূল্যায়ন করেছেন যেভাবে -

কবিতা পড়ে যারা

তারা পাঠক, প্রণাম করি।

 

পাঠক যখন অন্ধ হয়

কবির তখন অনেক ভয়।

 

তারা পাঠক প্রণাম করি

যারা শেখায় অনুভূতি।

 

কবিদের জন্য লেখা তার 'খেরোরখাতা' কাব্যগ্রন্থে -

যখন লিখবে কবিতা নিবিড় ভাবে দিনের শেষে

জ্বালিয়ে রেখো মোমবাতি

হৃদয় অভিসারে ।

      পরিশেষে জানাই কবি মানস কুমার চিনির পরিচিতির ব্যাপ্তি আমার অজানা।  কবি মৃণাল ঘোষ কবি মানসকুমার চিনি কে লিখেছেন অনেক চিঠি যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে।  সারা জীবন মুসাফির কবি  আমাদের মধ্যে তার সাহিত্যের সম্পদ রেখে গেছেন। আর তার মধ্যেই থেকেছেন আমাদের অন্তরে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে জানাই শ্রদ্ধা।

------------------------------

ক্রমশ লেখা চলতে থাকবে; পরবর্তী সময়ে লোকপথ পত্রিকায় প্রকাশ হবে। *******

দুই পাতা পত্রিকার আরো খবর পেতে পেজটির  Follow বাটনে হাত দিন। তাহলে নতুন নতুন তথ্য বা পোস্ট আপনার কাছে পৌঁছে যাবে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ