সম্পাদক: নীলোৎপল জানা
দুইপাতা
৯২ তম সংখ্যা ।। প্রকাশ ৩১ অক্টোবর ২০২৪
মেল: nilotpaljana1978@gmail.com
কবিতা
এই হাত
প্রভাত মিশ্র
কবিতার পঙ্ক্তিতে লিখতে পারি না আর
'শুভ'
হাত কাঁপে, তপ্ত হয়ে ওঠে
এই হাত পুরুষের
এই হাত ধর্মের
এই হাত আমার রাষ্ট্রের
এই হাতে পৌরুষ লক্-লক্ করে
এই হাত এ-ভারতে শিশুকন্যাদের
গোপন কুঁড়িতে মধু আহরণ করে
আস্তিনে গোপন থাকে রাষ্ট্রক্ষমতা
এই হাতের আঙুল টেপে ভোটের মেশিন
কবিতার পঙ্ক্তিতে লিখতে পারি না আর
'শুভ'
হাত কাঁপে, তপ্ত হয়ে ওঠে
এই হাত পুড়ে যাক কাঁপতে কাঁপতে...
হারানো নোলক
সৌমিত বসু
এই যে তোমায় দু-হাত দিয়ে আপ্রাণ জাপটে রয়েছি
হঠাৎ যদি হলোম্যান হয়ে যাই,
তাহলে তো তুমি ফাঁক গলে পেছনে।
আমি ঘুরে যদি তোমাকে না পাই
তাহলে কি দু-হাত দিয়ে নিজেই ভরে নেবো ফাঁক?
না কি তোমায় খুঁজতে থাকবো এর ওর ছায়ার ভেতর।
আঙ্গুলের ফাঁক গলে যে জল নিচে পড়ে যায়
নলকূপে উঠে আসতে তার ঊনত্রিশ বছর লাগে
আমি জানি ;
শুধু জানিনা,জাপটে ধরার আগে
কিভাবে সমস্ত ফুটো
বুজিয়ে রাখতে হয়।
অংশু সমীপেষু
শঙ্খশুভ্র পাত্র
মনে পড়ে "অংশু সমীপেষু"? ছোটো কাগজের সাধ—
আমাকে উন্মনা করে৷ ছড়ার জগৎ থেকে ধ্রুব
অন্বেষণে মনোতোষ— মায়াবী হলুদ পোস্ট কার্ড
তোমার উঠোনে এসে খড়কুটো, বাস্তবিক শুভ৷
ফিরোজ কোথায় আজ? সবুজপল্লির সেই টান
কলতানে মুখরিত৷ স্মৃতিধার্য, অনুগত স্বর...
কে কবে ভুলেছে, ঋণ, হাওয়ায় এখনও অফুরান৷
গীতার ভূমিকা, ভূমা, সান্ধ্যদীপ, কবিতাবাসর
ছবি হয়ে আছে৷ কবি৷ সকলেই প্রণত পাঠক৷
আখরে শিকড় গাঁথি— ছলছল জলভর্তি ঘড়া...
পিপাসার্ত, প্রণয়াদি— আদিঘরে জমেছে নাটক৷
আঁখি-পাখি পল্লবিত— তবু কি আড়ালে থাকে ছড়া?
ছন্দে মৃদুমন্দ ফোটে— বুকের গহিনে তার স্বাদ
যেন "অংশু সমীপেষু"— মায়াবী হলুদ পোস্টকার্ড৷
ক্যানভাসের তুলিতে
পাপড়ি ভট্টাচার্য
একদিন খুঁজে পাব মাকে ঠিক
আমার ভালো লাগার সময় -অসময়
যা ক্যানভাসের তুলিতে আঁকা
ধূসর থেকে ধূসরতর হওয়া ছোটবেলা
ছেঁড়া ছেঁড়া পান্ডুলিপি সম বিবর্ণ দিনে
পুজোর থালায় সাজানো ফুলের মত রঙিন শৈশব
জানি ফিরে পাবোনা তবু আমার ক্যানভাসে
মা যে বসে আছেন কেমন হাসিমুখে।
বহুকালের পুরনো পৃথিবী খুব ক্লান্ত
একমাত্র আলোর দিশা তুমি মা-
নতুন শরৎ সূর্যোদয়ের আলো-পথে
ওই তুমি আসছো সাত রঙের পুষ্পক রথে
কবে যে কখন পার্থিব অপার্থিব একাকার
মায়ের আঁচলের লক্ষ কোটি তারার মাঝে
আমি বসে আছি।
এখন আকাশ আমার ক্যানভাস
আর অসামান্য ভালোবাসার তুলি তোমার হাতে।
আমার ঈশ্বর
অন্তরা সরকার
সম্মুখে জলস্ফীত নদী,
পাড়ে নামতেই পা ধরে টেনে তুলল সর্পিল বক্ররেখা।
চিৎকার করে বললো,
“উঠে আয়!তোর গায়ে অজস্র ক্ষতের দাগ।“
নিয়ে গেল তোমা হতে বহু দূরে।
অথচ -
মাইলস্টোনের প্রতিটি ফলকে তোমার নামাঙ্কিত অসংখ্য কবিতারা ফুল হয়ে ঝরে যায়,
ঝরে যায় নক্ষত্র।
সকল শূন্যতা কলসে ভরে দীপ জ্বেলে যাই ।
যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না,
কেবল বিরান বুকের দুই শ্বাসে টের পাওয়া যায়-
সেই আমার ঈশ্বর।
নিজেকেই জানিয়ে এসেছি
খুকু ভূঞ্যা
মানুষ মরে গেলে নিষ্পাপ হয়ে যায়
এখন কারুর সঙ্গে দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই
নীল অন্ধকারের ভেতর মৃতের সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা
কেউ কেউ রামায়ণ জানে
কেউ গীতা
কেউ বা কীর্তন গেয়ে যায় সারারাত
যে মেয়েটি নিরাপত্তার অভিযোগে গুলি খেলো
সে আমার প্রিয় সই
আমরা পাশাপাশি হাঁটি, মুখোমুখি গল্প করি
রাতে এক বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর অমর কাব্য লিখি
হয়তো তুমি বলবে মৃত্যু কখনো এত রঙিন নয়
হেরে যাওয়া পংক্তিমালার রাশি রাশি মনস্তাপ- ভুলে গাথা আবেগ
অথচ কেউ জানে না আমার মৃত্যুর কথা
শুধু নিজেকেই জানিয়ে এসেছি, শিউলি নিশিথে
দেখো ঝরার ছাপ পড়ে আছে ফুলের নাভিতে
ধর্মহীন
বিধানেন্দু পুরকাইত
মৃত্যুর কাছাকাছি এসেও
যে পাখিটা উড়তে পারে বুকে নিয়ে লোহার শলাকা
তার জন্যে কবিতা লিখতে চাই
যে নারীর সিঁথি
মুছে গেছে বন্যার জলে
কিংবা চিতায় পোড়ে সিঁদুরের রঙ
তার জন্যেও।
আগুনের কোন ধর্ম নেই
মানুষ এখন বুঝি ধর্মহীন জাতি।
মুক্তি
সুব্রত মাইতি
রক্তাক্ত তোমার চোখের রং
রাজপথে জ্বলছে মশাল,কালো পিচের
বুকে রাঙা রক্তে লেখা আমরা তিলোত্তমা।
রক্তচাপ শ্বাসরোধ হিংস্রথাবা
অবিশ্বাস্য বিভীষিকা -
ক্যানভাসে ছত্রাকের মতো আবছায়া
আঁকিবুঁকি রেখাচিত্র।
অনতিদূরে ভারসাম্য খুঁজতে লম্পটের বিধান
আস্ফালন, বিবেকের ঘরে বন্ধতালা
শূন্যের সাথে ঘুরপাক খাচ্ছি
রাত গড়াচ্ছে আকাশ নেমে এসেছে মাটির কাছে
ছায়া ক্রমশ বাড়ছে ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
আমি অমরত্ব চাই না মুক্তি চাই।
প্রাচীন গান
খগেশ্বর দাস
অন্তরীক্ষে গান বাজে
নিজেকে ইতিহাসের অংশ ভেবে খোঁজ করি
পূর্বপুরুষের প্রাচীন সংগীত
বিকেলের নির্জনতায় বকের পাখার ধবল
কেঁপে যায় সময়ের সুরে ।
নিমগ্ন প্রহরে আকাশে তারার বাতি
আলোছায়ার গোপনে অপূর্ণ ইচ্ছের খলবল
নদীর দূরত্বে ভাসে সোনালী সাম্পান
বীতশোক মগ্নতায় বাঁশবনে হারানো দুপুর
ঝিঁঝিঁর আঁধার সাঁঝে নূপুর বাজায় ।
আঁকাবাঁকা পথে নদীর অনুসরণ
মগ্ন জলে ঢেউ ছায়া ছায়া
দিকচক্রবালে কাঁপে অজানা সুদূর
ভসা ভাসা পুরোনো গানের সুর
নিশুতি রাতের ঘুমঘোরে ।
মেট্রোরেলে কামরার ঘ্রাণ
তৌফিক জহুর
আনন্দের দানাগুলো মুঠোয় নিয়ে হেঁটে যাই প্লাটফর্মে
নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে বিশ্বাসকে ছিটিয়ে দেই
ভবিষ্যতের কাঁথা সেলাই করি দাঁড়িয়ে- দাঁড়িয়ে
আনন্দ দানাগুলো সুইয়ে গেঁথে অপেক্ষা করি মেট্রোর
হুঁশ করে সামনে খোলে রঙিন দুয়ার
ভেতরে আলোর নাচন, গতির ঝড়ে ছোটে মেট্রো
চোখের ভাষাকে ভবিষ্যতের কাঁথায় মুড়ে রাখি
অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢোকে ট্রেন, তিনহাজার বছর আগে
বিশাল মাছের পেটে মনে হয় বন্দি আমরা
পরিত্রাণ দাও.. অন্ধকার থেকে আলোর কারিগর
সমাজ থেকে, সভ্যতা থেকে,জাতি-বর্ণ থেকে
অসহ্য যন্ত্রণায় এ এক দুরূহ সাধনা
মানুষ, মানুষ বলে মিশে যাই তোমাতে আমাতে
মেট্রোর কামরায় দুহাতে বিলিয়ে দেই মুঠো মুঠো আলো
আলোর রোশনিতে কামরায় ছোটে বেলীফুলের সুবাস
পকেটে করে মানুষেরা নিয়ে যায় বন্ধুত্বের নজরানা
মেট্রো এক অন্তহীন ক্লান্তিহীন পথচলা
সবাই ফিরে গেলে অপেক্ষায় থাকে আকাশ ভরা রোদ
পদার্থ বিজ্ঞানে অনু ভাঙলে অনুই পাওয়া যায়
আত্মায় মিশে যাওয়া চিরস্থায়ী অনুর নাম বন্ধুত্ব
পাখালির গান
মনোতোষ আচার্য
কালের সিঁড়ির ধাপে জমে আছে
মোমবাতিগুলো
দাবি জানাচ্ছে ভাষাহীন অন্ধকারে
পুরোনো জ্যোৎস্নার গন্ধে
জেগে ওঠে পাখালির গান
শীতল মাঠের ধান, হাওয়া যেন
অঘ্রাণের নদী
কুটুম্বিতার মতো আরাধ্য পাঁচালি…
ধূপছায়া শস্যখেতে শিশিরের তন্দ্রামগ্ন প্রেমে
চেয়েছি কাতর … কানে বাজে অহরহ
মেশিনের সাংকেতিক ধুয়ো
ফ্রেমবন্দী স্মৃতিরেখা শিকলের রক্তচিহ্ন বুকে
তুলে আনি মহাযাপনের সোনালি কোরক
ঝরে পড়া মানুষের সারা গায়ে
ফুটে ওঠে আগুনের চাঁপা…
অরণ্যের ডাক
অমিতাভ চক্রবর্ত্তী
উত্তপ্ত শরতের সোনা রোদ্দুর,
মুচকি হাসে রুপালি চাঁদ।
সাদা মেঘের সারিতে অনিয়ন্ত্রিত শব্দ রাশি,
এলোমেলো চিন্তারা জমাট বাঁধে না..
হিমশৈল্য গলে যায় চটুল চিৎকারে,
নদীরা দিচ্ছে হাঁক বানভাসি হয়ে..
ফিরে আসুক সেই অরণ্যের ডাক।।
হেমন্ত
জীবনকুমার সরকার
হেমন্তের পোয়াতি ধানের সংসারে
শিশির আসে অতিথির মতো
ফসলের মাঠ জুড়ে পড়ে থাকে
এক নিবিড় চুপ।
প্রতিটি ধানের শীষে জমে থাকা শিশির
বাংলার রূপ নিয়ে হেঁটে যায় বহুদূর—
মাঠে মাঠে হেমন্তের লুটোপুটি খোঁজে
সাদা পালকের বক
এ সময় প্রতিদিন মাঠের ধানক্ষেত থেকে
কুড়িয়ে আনি হেমন্ত আর জীবনানন্দ
এআই গণতন্ত্র
রবীন বসু
দেখুন কী মজার ব্যাপার
রামলালা চোখের পলক ফেলছেন
নেটদুনিয়ায় ছড়িয়েছে এই ছবি
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কামাল !
এবার তো দফারফা ! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায়
ধর্ম জেগে উঠবে ধর্মের চোখে
প্রতিষ্ঠিত হবে এআই গণতন্ত্র
রামলালা রাষ্ট্রপ্রধান হবেন
অনুগত জনগণ রামভক্ত হনুমান !
এইবার শঙ্খধ্বনি, এইবার জয় শ্রীরাম !
আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের চোখে
পলক পড়ে না !
নীলাঞ্জনা তুমি
নবকুমার মাইতি
ভালবাসার মোহ আমাকে আজও টানে
নিরাশার নির্মোক অন্ধকার দূরে গেছে কবে
আমার হৃদয় সৃষ্টি চেতনা ব্ৰহ্ম সাধন
সব জড়িয়েই তোমার অশরীরী অস্তিত্ব
নীলাঞ্জনা তুমি;
আমি হয়তো তোমার প্রেমে অন্তর্লীন কৃষ্ণ নই
তুমিও আমার আজন্ম বিরহী রাধা নও
জানি, তবু আমরা চির আপনারজন
আজও অবিরল তোমার চোখে ঝরে প্রেমাশ্রু
আমি নিদ্রাহীন মধ্যযাম, হয়তো বা অনন্ত রাত্রি
চলমান নদী যেমন মিলায় সমুদ্র গর্ভে
আমরাও মিলাব অতল প্রেম যমুনায়
চারিদিকে মুরলির ধ্বনি, পাখির বিচিত্র কলরব
ঐ দূর নীহারিকা, ভেসে আসে আজানের ধ্বনি।
গীতবিতান
অর্ণব সামন্ত
গীতবিতানের মতো চোখ রেখে আমি ফিরছি
দখিনের ব্যালকনি খুলে রাখো
দু'হাতে বিনুনি বাঁধো সামনে উথলে ওঠা ঢেউ , সমুদ্র
নোনা গন্ধে ভেসে যাচ্ছে সোঁদামাটির আগুন
তবু বৃষ্টিপাতের পরে চাষ হয়
বীজ বোনে , ফসলে ফসলে একাকার
ঠোঁটের আকুলতা হৃদয় আরশিতে
দ্যাখে হৃদয় , এ সম্পদ হারাবার নয়
কালের শেলফে তুলে রাখে সেই অপঠিত বই
পাতায় পাতায় যার রহস্য , আবিষ্কার
চাঁদের কাজলে যদি সূর্যের তেজ পড়ে
পরিবারের জন্ম হয় সৌর বা চান্দ্রিক
স্বরবিতানের কোমল গান্ধারে বসে কেউ
কেউ বা ঋষভে বসে টইটম্বুর রাশভারী
ফসলের গান ছুটে যাচ্ছে ফল্গুস্রোতের মতো ...
ব্রহ্মাণ্ডের মতো সীমাহীন
অমিত কাশ্যপ
ছাদের কার্নিসে এসে ঝুঁকে থাকে রোদ
তখন ভোরের সঙ্গে শিউলির গন্ধ
মা ভোরে স্নান সেরে সূর্য প্রণাম করেন
পবিত্র বাতাসে আশ্বিনের সে এক আকাশ
মা বলতেন, স্থির বলে কিছু নেই, ওই যে দূরের গাছ
লেগে আছে সকালের রোদ, বেলা বাড়ার সঙ্গে
রূপময়তায় ভরে যাবে তা, তেমনই
মনকেমন করা বিকেল, সন্ধে হাজির হবে শুদ্ধতা নিয়ে
জীবন মৃত্যু পযর্ন্ত সীমাবদ্ধ জেনেও আমরা কেমন আনন্দ করি
আনন্দের কোনো শেষ নেই, অনন্ত আকাশ দেখ আমাদের চাহিদার মতো, ব্রহ্মাণ্ড যেমন সীমাহীন
মা এখন ব্রহ্মাণ্ডে ভেসে যাচ্ছেন
ব্যর্থতা
আশ্চর্য জীবন
সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
নবীন ধানের শিসে ভরে গেছে হেমন্তের দিন,কর্তনের
কাল সমাসন্ন হলে বিবাগী শালিক ঠোঁটে বেজে ওঠে বিরহের গান।দু'একটা দলছুট ফিঙে ও টিঁয়া শেষ চিঠি পোষ্ট করে নিরুদ্দেশে যায়, বব ডিলানের সুরে ধান ভাঙার গান বাজে সুখা আঙিনায়।
আল ভাঙা পথে পথে মৃত ফড়িংয়ের লাশ পড়ে,
খিদেতে চাঁদ খাওয়া ন্যাংটো ছেলে মেয়ে স্কুলছুট খেলা নিয়ে মেতে ওঠে, ধান দুধ খায়।বিবাগী মাধব কাকা নব্য বাউল সেজে পথ-বাঁক ভাঙে, একতারার অভিনব তালে,বিবমিষা ক্ষুধার রাজ্য জুড়ে নবান্ন ঢালে।
কে তুমি বিষণ্ণ যুবতী আমার চোখের কোলে সাজিয়েছ ধানের পসরা, কত শোক বিসর্জনে মাতিয়েছ অশোক কাহিনি,চালগোলা বাটিতে আঙুল ডুবিয়ে মনে পড়ে বুঝি
সেইসব গূঢ় আলাপন,কৃষিতে রোপিত আজও আশ্চর্য জীবন !
দেখব কেমন ডানা
শিখা মল্লিক
দেখব কেমন ডানা মেলে মেলে আস
অপেক্ষায় আছি বেশ প্রস্তুতি অনেক
ভালো হলে ভালোবাসা নয়তো বিরোধ
ক্ষমার অযোগ্য হয়ে থাকবে ভুবনে।
দেখাও তোমার রূপ এইতো কাছেই
জনগণ অপেক্ষায় তবে ভয়ে ভয়ে
বেশিরভাগই মন্দ ফলাফল জেনে
গুছায় খেতের ধান স্নান সেরে ঘামে ।
অবিচলিত কেউ কি ? তাহলে আমিই
সানগ্লাস খুলে রাখি একটু উদাসী
হুঁশ আনে পাখিদের কিচিরমিচির
ঝড় কি উঠবে জোরে ? উপকূলে তুমি ?
বিরহ
গুরুপ্রসাদ যশ
আধখাওয়া এবং না খাওয়া
বিরহের সঙ্গে থাকতে থাকতে
দুচোখের তীরে ধূসর কালিমা
মাঝে স্বচ্ছ জলের হ্রদ
ডাক্তার বলেছিল
এভাবে চললে বুকে খনিজ ভাণ্ডার
গড়ে উঠবে, ওকে ছাড়তে হবে
একজনের সুখের কথায় তাঁকে ছেড়েছি
একা আমি কিভাবে বাঁচব!
আলো আর জোছনা
কৃপাণ মৈত্র
এক আঁচলা রোদ ওর মুখে ঢেলে দিয়ে
মা বলেছিল, ও নির্ঘাত নিরক্ষরের আলো।
বাগানের সেরা ফুলটা ওর মাথায় টোপর করে
দিয়ে বলেছিল, ও পরী
ব্যাবিলনের ঝোলা বারান্দার।
এক খাবলা চাঁদ পেড়ে ওর কপালে
টিপ দিতে দিতে বলেছিল, কৃষ্ণা তৃতীয়ার জোছনা।
চাঁদের কলঙ্ক কপালের কোণে
আঁকতে আঁকতে বলেছিল, কারো
কু-নজর লাগে না যেন, যা কলঙ্ক চাঁদে থাক।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হল, আলোর বাষ্পে
তাপিত ঘাম মুছতে মুছতে ওরা শীতল ঘরে
নিয়ে গেল। আলোর ভ্রুণে বীজ। আর একটি
আলো। বাষ্পীয় রীতি মেনে আলো আবহমান।
ওর আলো জোছনা এক হয়ে গেল।
নদী কথা
আনন্দমোহন দাশ
রোজ বিকেলে তুমি যে নদীর কাছে যেতে
সে এখন একা।
জলের ভেতর থেকে কেঁদে উঠে জল
পাড়ে তার ক্ষতদাগ, ঘাসবনে তোমার পায়ের ছাপ
কবে ধুয়ে গেছে !
পুরানো গল্পের মতো জলস্রোতে ভেসে যায়
ফেলে দেওয়া ফুল, শুকনো পাতাপুতি।
মৃত ঝিনুকের পাশে যেখানে তুমি রেখেছিলে পা
সেখানের পলিকাদায় আত্মহত্যা করে পড়ে আছে
হিম - হিম কুয়াশা মাখা শারদীয়া চাঁদ ।
ছেলেটা কাঁদছে
মৃত্যুঞ্জয় হালদার
ছেলেটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে
অন্তহীন বিষন্নতার বালিয়াড়ি বাঁধ ভাঙছে
অন্তর্দহনে দাহ্য দীনতার দিনলিপি
জলছবি ভেসে উঠছে অশ্রুসিক্ত অন্তরে
ছেলেটা খুব কাঁদছে
অথচ কেউ দেখতে পাচ্ছে না!
অপ্রাপ্তির অন্তর্জলী যাত্রায় ও
ওর কান্নার ভাষা কেউ কোনোদিন বোঝেনা
বোধহয় বুঝবেও না কোনোদিন
আজীবন ছেলেটা ভীষণ কাঁদছে
বাহ্যিক উৎফুল্লতায় উৎসুক্য সবাই
ভিতরের ভাষা কজনই বা বুঝতে পারে
পাষাণ হৃদয় গলছে কেবল গলছে
গিরগিটি
পলাশ পোড়েল
একান্নবর্তী মন যেন অস্থিচর্ম সার
শুধু দুজনে ধরেছে মরচে -ঘুন ,
আশাভঙ্গের স্তূপ শুধু চাহিদার
জীবানুর মতো বেড়েছে বহু গুণ ।
স্বার্থবলয় সময়কে আছে ঘিরে
প্রতিবন্ধী রুগ্ন তাই সমাজ ,
আঁতেল যত বুদ্ধিজীবীর ভীড়ে
প্রতিবাদী হারিয়েছে সব ঝাঁঝ ।
বিবেক আজ ধূসর মরুভূমি ধু - ধু
প্রাপ্তিতে ছুঁতে সীমাহীন অধিরতা ,
নেতা আর ন্যাতায় রাজজোটক শুধু
তৈল লেপনে দিবা স্বপ্নের বিলাসিতা ।
বাউলের ভেকে কবি তুই গিরগিটি
জামা পাল্টে ধরিস দাঁড়ি - টিকি ,
সরলরেখা শিখে জীবন হয়নি জানা
হৃদয়ের জলছবিতে বৃথাই আঁকিবুকি ।
জীবন
ত্রিদিব রায়
জীবন একটা কানাগলি
এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত
অম্লান আলোর খোঁজে দিশাহীন
ছুটতে ছুটতে বেলা পড়ে আসে।
কারো জীবনে হয়তো
ফাঁক ফোকর গলে ---
এক চিলতে আলো এসে পড়ে,
কারো দিন কাটে হাপুস অন্ধকারে।
গর্ভ তমসা থেকে আলোয় প্রকাশ
আলো থেকে অন্ধকারে ফেরা
বিপর্যয়ের প্রখর দাবদাহে
স্বস্তির বৃক্ষ ছায়ায় দু'দণ্ড জিরিয়ে
আর বার জটিল ঘূর্ণাবর্তে
শর্তহীন সমর্পণের মধ্যেই
জীবন নদীর ক্রমশঃ এগিয়ে চলা।
নিজেকে আড়াল রাখি
বিদ্যুৎ মিশ্র
নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়ায়
নিজের ব্যর্থ যাপনের
স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে চাই।
অপর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে
মরচে পড়ে যাওয়া
অর্ধেকটা বসন্ত পুড়ে ছাই ।
তবু দেখে যাই নদীর ওপারে
ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় যাযাবর পাখি।
নতুন করে কোন গল্প লেখা হয় না আর
নতুন করে কোন স্বপ্ন দেখতে নেই ।
চারিদিকে যখন কান্না
নিজেকে আড়াল করে রাখি
সমুদ্র সফেন সাদা সাদা ঢেউয়ের মাঝে ।
গেট
গুরুপদ মন্ডল
দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি
উঁচু গালে হাত দিয়ে
আনন্দ পাশে দাঁড়ায়
আমার গেটের সামনে
আমার সামনে পাঁচজন পরিচিত
হিম্মত চোখে দেখে
তাদের দখল ভাবনা
স্টিল গায়ে দেখা যায়
অবাধ্য পাঁচজন ফেল করে লাইক চিহ্ন দেয়।
ধুলো মাখে আত্মার আলেখ্য
বিকাশ চন্দ
হঠাৎ ধমনী ছিঁড়ে ছিটকে এসেছিল হৃদপিণ্ড বুকের বাইরে
তখন সকল চরাচর ঘিরে ভেজা ভেজা প্রকৃতি আশ্রয়
মাঝ রাত জানে শেকড়ে শরীরে বেঁচে ছিল রাত প্রহর
মায়া শরীর গিলেছিল অসহ্য ঠোঁটের চুম্বন
ভেসে যাচ্ছিল সকল দিগন্ত চতুর্দিকে
গঙ্গার দূষণের মতো মদ গন্ধী জীবন
দিব্যি ভেসে যাচ্ছে উচ্ছ্বাস উৎসব
ভাসিয়ে দিচ্ছে যা কিছু বিসর্জনের মতো
খাবলে খুবলে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিল বাতিল শরীর কিছু
আঁচড়ে কামড়ে অদ্ভুত চোখে দেখছিল কিছু জিঘাংসু প্রাণী
যাদু জীবনের কিশলয় ঢেকে দিচ্ছে মায়া গোলক
তুলতুলে শরীর দেখে চোখে মুখে কয়েকটি মানুষ শ্বাপদ হয়ে গেল
একা একা কোজাগরী মাঠ পাহারায় ক্ষিদের সুষমা
বাধ্য বুকের বাঁধনে বাঁচে আত্মার উৎসব জানে পূর্ণ শশী
গ্রাম শহরের এমনই রাতে জাগে অরণ্যের রঙ্গভূমি
অসময়ে গার্হস্থ্য ধুলো মাখে আত্মার আলেখ্য
চৈতালি
সুদীপ্তা মাইতি
চৈতালি তুই চৈত্রদিনের চৈতিফুল।
তোর শাখে দ্যাখ নাগ-নাগিনীর বিষাক্ত কেউ।
ফোঁস করেনি? দাঁত দুটো ঐ তোর গায়ে
গর্জনে দ্যাখ আকাশ-গাঙে কালবো শাখ।
চড়ক এলে কালেশ্বরের মাথায় বাস
চম্পা রে তুই মিথ্যে দেখিস
কেউটে সাপ।
ভূত -প্রেত জাত ওরকমই বারোমাস।
মিথ্যে কি সব ? হয়তো মিথ্যে! তোরাই ভাব ।
তোর সুরভি তপ্ত দিনের অকটোপাস।
চম্পা রে তুই এই বাংলার সর্বনাশ।
কবিতা রূপান্তর
সুমিতা মুখোপাধ্যায়
বোবা পাথরেরা কথা বলছে,
বোবা মেঘেরা নীরবে হাসছে।
আর, সকল রাত্রির শেষে,
মৃত্যু আলো হয়ে,অন্ধকারে ভাসছে।
পৃথিবীর পল্লবিত শাখায় - শাখায়
অনেক রৌদ্রসফল রূপান্তর দেখে,
আলোকের অলীক বিন্যাসে
নিয়তিকে আগুন জেনেছি।
প্রস্তুতি তো ছিলই, তবু
মূর্ত আকস্মিক ধ্বংস সংসারে;
একবগ্গা খেয়াল কি আর বাঁচাতে কিছু পারে?
চারিদিকে পড়ে থাকে সমস্ত ভঙ্গুর......
শুধু একটা কোথাও না পৌঁছানো
খুব উঁচু সিঁড়ি দাঁড়িয়ে থাকে
আকাশের দিকে মুখ করে -
আসছে বসন্ত ।
ঠিকানা
সুব্রত মাইতি
দেওয়ালে চিহ্নিত ছিল ঠিকানা
মালিকের নাম ও পরিচয়--
এক অনন্ত আকাশ তার বর্তুলের নিচে
সযত্নে ধরে রেখেছিল
সেই বাড়ির দেহপট
তবুও দুয়ারে এসে হারালাম সবকিছু
আমি প্রশ্নের পেরেক দিয়ে
নিজেকে ক্রুশ বিদ্ধ করি
যে ক্রুশ বয়ে চলেছি সারা জীবন ধরে
কোথাও দূরে উৎসবের ঢাক বাজছে
ট্রাফিক অগ্রাহ্য করে এক ধর্মের ষাঁড়
এগিয়ে চলেছে ওই দিকে
লাল নীল আলোর পাখা মেলা ভি আই পি কনভয়
ওকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়
এটাও তো এক ঠিকানা--
চলমান চৌমাথা আপাতত স্থির হয়ে গেছে
এক স্বেচ্ছাচারী ষাঁড়ের প্রতিভায়
তোমার ইচ্ছেগুলো
রথীন পার্থ মণ্ডল
আজও হারিয়ে যাওয়া আমিটাকে
ফিরে পাবার অপেক্ষায় থাকি
অপেক্ষায় থাকি তোমার ডাকের
তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
এখনও হেঁটে চলি নির্জন রাস্তায়
খামে বন্দী সব ইচ্ছেগুলো
সঙ্গী হয় আজও
রঙিন প্রজাপতি হয়ে
তারাও উড়ে যেতে চায় তোমার কাছে
তোমার রেখে যাওয়া ইচ্ছেগুলো
পূর্ণতা পায় আমার হৃদয় মাঝে
জানো শিউলি,
আমার একাকীত্বের আকাশে
তোমার পাওনার ডালিগুলো
নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করে এখনও।।
গয়নার বাক্স
উত্তম বেহারা
সমস্ত মৃত অন্তিম বিশ্বাসও
গয়নার বাক্সে লুকিয়ে রাখি আমি
হয়তো অগোছালো
হয়তোবা কোন এক কোনে
রোদ জল না পাওয়া বুক যেমন
আতর মেখে বসে থাকে বারান্দায়
অথচ
তুমি বার বার ভেঙে দ্যাখো
ভোর ঘুমে আসা পিরামিড স্বপ্ন
আর
আমি রোগের আশায় শয্যা খুঁজি
সেফটিপিন কুড়িয়ে পাওয়ার মতো
নতুন পথের জন্য
অর্পিতা ঘোষ পালিত
চোখের সামনে শান্তিকে খুন করে
জয়ের আনন্দে উৎসবে মাতে ওরা
থমকে যায় সুখ স্বপ্নের দৃশ্য
আসক্তিতে ভরা আমার চেতনা
দেখেও না দেখার ভান করে
কোনো কিছুতেই এখন অস্থির হইনা
ভাবনার দোলাচলে নিরব থাকি
কখনও কিছুক্ষণ দাপিয়ে বেড়ায়
তারপর স্মৃতি থেকে যায় মুছে
পুনরায় ফিরে আসে হাওয়ার ঝাপটায়
নতুন পথ পরিক্রমার জন্য শব্দ-কল্পদ্রুম
আকাশী
কলমে অণিমা গুছাইত
খুব খানিকটা কাঁদল আকাশী
যাকে বলে ডাক ছেড়ে কান্না।
সেই কান্নাতে গ্রাম শহর উজাড় হল কিনা জানিনা,
কিন্তু আভাস পেয়েছে অনেকেই।
সেই জলে এঁদো ডোবা ভর্তি হল
সবুজ মাঠ ডুবে জলমগ্ন।
বাতাসি দের পুকুরের চারটে পৈঠা ডুবে জল ভিটার ধারে।
সবাই জানে এই জল একদিন গড়িয়ে যাবে।
শুধু, কেউ জানবে না বুকের ভেতর ঢেকে রাখা ক্ষতস্থান থেকে নিরন্তন রক্তক্ষরণ।
নিরাময়
প্রশান্তশেখর ভৌমিক
ঘরের ভেতর
জন্ম নিয়েছে ঘর
পাল্টেছে
কথা পাল্টেছে ইঙ্গিত
নিঝুম দুপুরে
জেগে থাকা তারপর
বরফ জমলে
গাঢ় হয়ে ওঠে শীত!
বিছানা বালিশে
থিকথিকে সব ধুলো
বদলেছে কার
সম্বোধনের ভাষা?
হারিয়েছে
মাঝে পেতে রাখা পরিপাটি-
দরজার পাশে
নিচু মুখে শুশ্রূষা।
রাত্রি চলেছে
অজানা যে আলপথে
রোদ্দুর
হতে চেয়েছে অবুঝ মন
আজও যখন
ঘুম ভাঙে মাঝরাতে,
যদি বেজে
ওঠে আচমকা সেই ফোন?
নিজের সাথে
নিজেই কথা বলি
সন্ত্বনা
আর শান্তি দুটোই জোটে
ঘরের ভেতর
বাড়তে থাকা ঘরে
ফিনকি দিয়ে
রক্ত ধারা ছোটে।
কখনো সখনো
আড়াল রাখা ভালো
বৃষ্টি নামলে
জলও বড়ো কাছে
আস্তরণের
নিচে জমে থাকা ধুলো
পথ খুঁজে নিয়ে একা একাই বাঁচে।
ব্যক্তিগত প্রবন্ধ
শুভ বিজয়া
সুব্রত নন্দী
শ্রীচরণেষু
…………………………………………….. বিজয়ার প্রণাম নেবেন।
ইতি,
বিজয়ার চিঠির প্রেরক , প্রাপকেরা এবং চিঠি নিজেই এখন অতীত। যদিও বিজয়া দশমী যথা নিয়মেই আসে ফি বছর। বিজয়ার প্রণাম, শুভেচ্ছা সবই জানানো হয়। তবে সে জন্য চিঠির খোঁজ পড়ে না। একটা স্মার্টফোনই যথেষ্ট। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-ট্যুইটার-এসএমএসের যুগে দাঁড়িয়ে চার-পাঁচ দশক আগের বিজয়ার দিনের কথা ভাবা সত্যিই দুষ্কর৷ ঘরের কোনায় চেয়ার-টেবিলে গুছিয়ে বসে, অথবা মেঝেতে উবু হয়ে বসে পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড খামে বিজয়ের প্রণাম , শুভেচ্ছা জানানোর আর কোনও প্রয়োজনই আজ নেই৷ পথে চলতে-ফিরতে, ট্রামে-বাসে-ট্রেনে চাপাচাপি ভিড়ে বসে বা দাঁড়িয়েও দিব্যি বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া যায় উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে৷ সত্যিই কত্তো সুবিধা এখন৷
অবশ্য এটাই বোধহয় সমাজের স্বাভাবিক গতি৷ এই বিশ্বায়নের যুগে কোনও সমাজ বা কোনও ধর্মের পক্ষেই তাদের সাবেক সমস্ত রীতি, সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদিকে ধরে রাখা আর সম্ভব নয়৷ সব কিছুতেই একটা মিশ্রণ ঘটে চলেছে–পুরনো প্রথাকে বিসর্জন দিয়ে নতুন রীতির প্রচলন৷ কোনও কিছুকেই আর আঁকড়ে ধরে রাখা সম্ভব নয়৷ চারপাশের জানালা-দরজাগুলো এখন এমনই হাট করে খুলে গিয়েছে যে, বাইরে থেকে আসা দমকা হাওয়াকে আটকে রাখা যাবে না৷
ডিজিটাল দুনিয়ায় সবকিছুই এখন 'ভার্চুয়াল' হয়ে গেছে। করোনার সময় কাছের মানুষদের মৃত্যুকেও 'ভার্চুয়াল' দেখতে হয়েছে। বিজয়ার প্রণাম আর শুভেচ্ছা প্রদানও এখন 'ডিজিটাল' হয়ে গেছে। ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে গেছে মানুষ, হারিয়ে গেছে শুভ বিজয়ার চিঠিও। আগেকার দিনে চিঠি লেখার একটা আলাদাই ঐতিহ্য ছিল। চিঠির ভাষা, লেখার ধরন, এসবের একটা অন্য গুরুত্ব ছিল; লেখার মধ্যে ছিল আত্মিক বন্ধন । পুজোর কেনাকাটার সঙ্গে বাধ্যতামূলক ছিল পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড খাম। পোস্ট অফিসগুলোতে লম্বা লাইন পড়ত। আর শুধু বিজয়া নয়, নববর্ষের সময়ও চিঠির মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়ের রেওয়াজ ছিল। এমনিতেও মাঝে মাঝেই পোস্টকার্ড আদান প্রদান করা হত আত্মীয় স্বজনদের খবরাখবর নেওয়ার জন্য। বিজয়ার মিষ্টিও এখন আমাদের মুঠোফোনের মধ্যে দিয়ে খেতে হচ্ছে। হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ছিল !
পুজোর ঠিক আগে আমার কাজ ছিল বাবাকে একশোটার মতো পোস্টকার্ড আর খান কুড়ি ইনল্যান্ড খাম এনে দেওয়া । একাদশী বা দ্বাদশীর দিন বাবার পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড খামে লেখা বিজয়ার প্রণাম, শুভেচ্ছা পত্র পোস্ট অফিসের লাল ডাক বাক্সে ফেলে আসতে হতো। লক্ষ্মীপুজোর পর থেকেই বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের বিজয়ার শুভেচ্ছা পত্র ( পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড খামে) শুরু হয়ে যেত, আর ভরিয়ে দিতো ডাকবাক্স। টাইম মেশিনে ছোটবেলায় পৌঁছে মনে পড়ছে - দশমীর পর বড়দের প্রণাম করার পালা , বিজয়া দশমী উপলক্ষ্যে মিষ্টিমুখ এর আকর্ষণও কিছু কম ছিল না। রসগোল্লা-সন্দেশ ও বোঁদের পাশাপাশি নারকেলের নাড়ু আর সিঁড়ির নাড়ুর স্বাদ আজও ভুলতে পারি না। এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে ২-৩ দিন ধরে বিজয়া করার জন্য ছোটদের দল থাকত। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বড়দের প্রণাম করত তারা। সঙ্গে কোচর ভরে মিষ্টি, নিমকি, নাড়ু, মুড়কি। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তারপর চলত বড়দের ফরমাস মতো চিঠি লেখা।বিজয়ার চিঠি। তাতেই প্রণাম, তাতেই শুভেচ্ছা, তাতেই স্নেহ-ভালবাসা জানানো। বড়দের কোলাকুলি তো ছিলই, কিন্তু যাঁরা বহু দূরে থাকতেন তাঁদের জন্য হাতে লেখা চিঠিই ছিল এক মাত্র ভরসা।
আজ আর কেউ চিঠি লেখে না। যে কোনও কারণেই হোক চিঠি লেখার সংস্কৃতিটা এখন নষ্ট হয়ে গেছে ।কোথায় হারিয়ে গেল পোস্ট কার্ড, ইনল্যান্ড লেটার বা এনভেলপে লেখা চিঠি । সেই সময় বড়দের পাল্লায় পরে আমাদেরও বিজয়া দশমীতে চিঠি লিখতে হত। বড়দের প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখতাম আমরা। আজ আমার আপনার বাড়ির ছোটদের চিঠি লেখার কথা বলাই যাবে না। সেই প্রসঙ্গ উঠলেই ওরা বলবে, চিঠি? সেটা আবার কী? অবশ্য আমরা বড়রাই এর জন্য দায়ী। নিজেরাই আর কেউ চিঠি লিখি না !
হয়তো সত্তরোর্ধ বয়স্কমানুষেরা বিজয়া দশমীর পর পরই পুরোনো সেই সব চিঠি খুলে ‘ডাউন মেমোরি লেন’ বরাবর হেঁটে চলবেন।
পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে (মহীনের ঘোড়াগুলি) গানটা এই সময়ে লেখা হলে হয়তো এরকম হতো : পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, মুঠোফোনের ডিজিটাল আর ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বন্দী...
আলোর সাধক
পুষ্প সাঁতরা
মহাকালের সঙ্গে যিনি রমন করেন, তিনি ই কালী,কালকে যিনি কলন করেন,খন্ড খন্ড করেন,বিভাজন করেন, অনন্ত কে টুকরো টুকরো করেন, প্রতিটি জীবনের সময় সীমা নির্ধারণ করেন ,তিনিই তো কালী।জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের অদৃশ্য রেখাটির নাম কালী।পৃথিবী মৃত্যুর এলাকা,এখানে অক্ষয় বলে কিছু নেই। স্বামীবিবেকানন্দ সেই ভাবেই মাকে দেখেছেন, মৃত্যুরূপা কালী! সাধক কমলা কান্ত,রামপ্রসাদ, বামাক্ষেপা,কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ,ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, এবং ভারতের ধুলো তে আরও অনেক কালী সাধক জন্ম গ্রহন করেছেন।ঠাকুর বলেছেন, ' আদ্যাশক্তি লীলাময়ী,সৃষ্টি স্থিতি- প্রলয় করছেন।কালীই ব্রহ্ম,ব্রহ্মই কালী,সুতরাং মহাকালী,নিত্য কালী,শ্মশান কালী,রক্ষাকালী,শ্যামাকালী,আসলে কথা তন্ত্রে আছে।তন্ত্রে কালী হলেন বর্ণময়ী।যা প্রকাশ করে তাই বর্ণ।বর্ণমালাই বিশ্ব সৃষ্টি
বিশ্ব তত্ত্ব,সকল তত্ত্বের মর্মকথা প্রকাশ করে।
তত্ত্বময়ী কালীর মূল তত্ত্ব হল ---- বর্ণবিকাশ।
অকার,উকার,মকার,চন্দ্রকলা ও বিন্দু।সমগ্র বিশ্ব চরাচর বিচিত্র বর্ণ,ও শব্দের এক মহাসংগীত।বর্ণ আর শব্দ হলেন --- পার্বতী আর পরমেশ্বর। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বললেন, 'ব্রহ্ম ও কালী এক।
শান্ত শিবের উপর নৃত্য রতা ভয়ঙ্করী,এই জগতের ক্রিয়া শক্তি রূপী।
কালী সাধনার অনেক পন্থা নিয়ম থাকলেও সংগীতে কালীকে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করেছেন, এক বিধর্মী সংগীত সাধক কাজী নজরুল! মুসলিম রা বলেছেন, এ কাফের -- মুসলিম হয়ে,হিন্দুদের কালীর গান লিখে,মুসলিম জাতির কলঙ্ক, কিন্ত তবুও মায়ের গান লিখেছেন, এবং গেয়েছেন।মাতৃসাধনার সিদ্ধপীঠভূমি এই বঙ্গ ভূমি।মাতৃ সাধনার মহনীয় রূপটি ফুটে উঠেছে-- শাক্ত পদাবলীতে অবশ্য পথিকৃত রামপ্রসাদ
আর তার চরম বিকাশ নজরুলের ভক্তি গীতি তে। আসলে নজরুল ভক্তি রসের কবি,গায়ক লেখক। মাতৃমন্ত্রকে উপজীব্য করে মাতৃ ভক্ত নজরুলের ধ্যানে মা কালী সদাই প্রকটিতা।কালী তাঁর কাছে চলমান সত্ত্বা।বিদ্রোহী কবির নিত্য প্রার্থনায় এই মাতৃরূপা ওতপ্রেতভাবে বিরাজমানা।বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণ তাঁর কাব্য সাধনায় এক নতূন রূপে প্রকাশ পেয়েছে।
'আমি নামের নেশায় শিশুর মত
ডাকি গো মা মা বলে
নাহি বা দিলি সাড়া মাগো
নাই নিলি তুই কোলে'।
সৌন্দর্য ময়ী ও মহাপ্রকৃতির পরিপূর্ণ প্রকাশ দেবী কালিকা।ছায়াময়ীর অপরূপা আলোকময়ীর রূপ দর্শনে বিমুগ্ধ হয়েছিলেন তাই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন------
আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
দেখে যা আলোর নাচন।
মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব
যার হাতে মরণ বাঁচন।।'জগন্মাতার প্রকাশ ময়ী মূর্তি ত্রিবিধ।এই তিনটি বিভূতির নাম মহাকালী ,মহালক্ষী,ও মহাসরস্বতী।এই ত্রয়ের সমষ্টিভূতা অখন্ড শক্তি দেবী চন্ডিকা।
তাই তিনি মুক্ত কন্ঠে গেয়েছেন----
'মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী কালিকা
পরমাপ্রকৃতি জগদম্বিকা ,ভবানী ত্রিলোক পালিকা।
মহাকালী মহাসরস্বতী
মহালক্ষী তুমি ভগবতী
তুমি বেদমাতা তুমি ষোড়শী
কুমারী বালিকা।
এই অপূর্ব ছত্র পড়ে কবির 'দেব স্তুতি বইয়ের ভূমিকায় ডঃ গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় যথার্থ মন্তব্য করেছিলেন, 'নজরুল শক্তিতত্ত্ব ও মাতৃরূপের নবভাষ্যকার।' নজরুলের ধ্যানে মাতৃরূপা তাই অনন্ত বিচিত্র রূপিনী।কালীর মধ্যে কৃষ্ণের দর্শন, শ্যাম শ্যামার ভেদ ঘুচিয়ে নজরুল দিয়েছেন তাই মিলন মন্ত্র:
শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে
জপি আমি শ্যামের নাম
মা হলেন মন্ত্র গুরু
ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম।
মায়ের সঙ্গে তার যত আবদার অভিমান
আমার কালো মেয়ের সাধ হয়েছে
পরবে জবা ফুল
তাই বনে বনে পালিয়ে বেড়ায়
দুলিয়ে এলোচুল।
বিশ্বাত্মবোধ ,জাতিয়তাবাদ ও স্বদেশ প্রেমচিরন্তন এই ত্রিধারার শাশ্বত ভারতে মাতৃসাধনার বিশ্ব রূপ।দেশ মাতা রূপে মা কালীর আরাধনা সেই প্রেরণা র জীবন্ত প্রতিমা।দেশ মৃন্ময়ী নয়,চিন্ময়ী।তাই তাঁর প্রত্যয় -----
এবার নবীন মন্ত্রে হবে জননী তোর উদ্বোধন
নিত্যা হয়ে রইবি ঘরে ,হবে না তোর বিসর্জন '।
মাতৃ পুজার আবাহনে কেউই বঞ্চিত নয়,সকলেরই সমান অধিকার। তাই সংহতির কবির আহ্বান আয় অশুচি আয়রে পতিত এবার মায়ের পুজা হবে
যেথা সকল জাতির সকল মানুষ, নির্ভয়ে মার চরণ ছোঁবে'।
নজরুলের কালী সাধনা নিয়ে এক সুন্দর বিশ্লেষণ পাই প্রাবন্ধিক ও ঐতিহাসিক সুধীর কুমার মিত্রের বিবরণে,ধর্ম সাধনায় নজরুল প্রসঙ্গে বলেছেন, ভাস্কর গোষ্ঠপালকে দিয়ে তৈরি করালেন, কালীমাতার বিগ্রহ, প্রতিষ্ঠা করলেন বাড়ির এক তলার ঘরে।রোজ মায়ের পুজার জন্য আনতেন রক্ত জবা।সারাদিন গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করে এসে বাড়িতে চলত মায়ের আরাধনা,আর উদাত্ত কন্ঠে গীত হত,কত গান যে মা কে উৎসর্গ করেছেন!
সেই সময় তাঁর 'বল রে জবা বল কোন সাধনায় পেলি রে তুই মায়ের চরণ তল! ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কন্ঠে আকাশ বাতাস মুখরিত করেছিল।
কবি যতীন্দ্র মোহন বাগচী লিখছেন',নিম্নে যত ভেদ গন্ডী ,ঊর্ধ্বে জাগে অনন্ত আকাশ, শিল্পীরে বাঁধে না ধর্ম, গুণীরে স্পর্শে না জাতি পাশ',
তথ্য ঋণ--- কালিকা পুরাণ ও দৈনিক বর্তমান
গল্প
মুন্নি
কৃষ্ণাংশু মাকুড়
" মুন্নি বদনাম হুয়ি, ডারলিং তেরে লিয়ে..."
গানটা কানে আসতেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল পারমিতা। অনেকদিন পর শব্দটা স্মৃতিতে যেন হটাৎ করে ভেসে উঠল। আজ এদের কাছে সেলাইদিদি বলে পরিচিত হলেও একদিন সে অনেকের কাছে ছিল আদরের মুন্নি।
মুন্নির বাবা যেদিন চলে গেল মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা একলা বিধবা মানুষ পড়লো অকূল পাথারে। সে এক ভয়ঙ্কর ছেলেবেলা গেছে তাদের। কিন্তু সময় তো মানুষের চিরকাল একই থাকে না। তারাও একদিন সেই দুর্বিসহ জীবন কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল।
মুন্নি পেয়েছিল মায়ের গায়ের দুধে আলতা রং। আর সৌম্যদর্শন বাবার মতো সুন্দর মুখখানা। তাই ছোট থেকেই বেশ সুন্দরী। বি. এ. তে ভর্তি হতে না হতেই বিয়ের সম্বন্ধ এল। পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও মা অনেকটা কম বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তাছাড়া এমন বনেদি, শিক্ষিত পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধের খোঁজ করা একা মেয়েমানুষের পক্ষে সত্যি কষ্টকর ।তাই, সম্বন্ধটা আসা মাত্র না দু'বার ভাবে নি। ছেলে ভালো । চাকরী করে। ঘর বাড়ি আছে। তাই আর না করতে পারে নি।
মুন্নির বিয়ের পর স্বামী, সংসার, শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল। আবার বছর না ঘুরতে ঘুরতে বাবান কোলে এল। মুন্নির কখনও কখনও মনে হতে লাগল তার জন্য সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি ঘটে যাচ্ছে । জীবনটাকে চিনে নেওয়ার আগে সব কেমন বাঁধাধরা গতে বয়ে চলেছে। তাই মাঝে মাঝে কারণে অকারণে খুব মন কেমন করত। ছেলেমানুষ বউএর এই মনখারাপ বুঝত সুপ্রিয়।নানান বায়নাক্কাও সামলাত সে । স্ত্রীর মন ভালো রাখার হাজার চেষ্টা করতেও হত। কখনো কখনো এ অত্যাচার মনে হলেও বেশ হাসিমুখেই করত। কিন্তু সবসময় তো আর খেয়াল করা যায় না।অন্যদিকে সারাদিনের সংসারের নানার ব্যস্ততায় আনন্দের বদলে হাঁপিয়ে উঠল মুন্নি। সামান্য বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হতে লাগল মনোমালিন্য ।সুপ্রিয়ের সব ব্যাপারে অতি সহজভাবে নেওয়াকে মুন্নিকে জেদী করে তুলল। ফলে ঝগড়া বাঁধল দুজনের। এরকম এক সময়ে অনুপম এল। সুপ্রিয়ের দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয় হবে। সম্পর্কে বৌদির প্রতি সহানুভূতির প্রলেপ ধীরে ধীরে সহমর্মিতায় রূপ নিয়েছিল । মুন্নির বরাবর মনে হয়েছে এ কী শুধু বন্ধুত্ব! সে এক আদর্শবান পরিবারের পুত্রবধূ।তার একটি দেবশিশুর মতো সন্তান আছে। তার এসব মানায় না।তার এই অন্তর্দ্বন্দ্ব তাকে বারবার দুঃখী করে তুলত। কিন্তু ঈশ্বর কার জন্য কী লিখে রেখেছেন তা কি মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব!
প্রথম প্রথম সুপ্রিয় বিষয়টাকে অতটা গুরুত্ব দেয় নি। সময় যত যাচ্ছিল ছেলের প্রতি অবহেলা অবাক করছিল তাকে। ছোট্টো ছেলে আদরর ভাষা বোঝে। আপন জগতে থাকা মায়ের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে লাগল। তখনই বাবাকে বেশী করে আঁকড়ে ধরল ছেলে। এই অবহেলা শান্ত সুপ্রিয়কে অশান্ত করে তুলল। মানুষ নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়। ঘটলও তাই। যেদিন প্রবল অশান্তি হল দু'জনের সেদিন অনায়াসে তুলল সংসারে এইটুকু বয়সে এসে তার নাকে মুখে রক্ত তুলে প্রাণান্তকর পরিশ্রমের কথা ।এই জীবনে এ সংসার তাকে কী দিয়েছে - এরকম হাজারো অজুহাত। কিন্তু সংসারে থাকতে গেলে সকলকে সংসারের জন্য প্রাণপাত করতে হয়। তারজন্য কৈফিয়ত কী আশা করা যায়।
ঘোর লেগেছিল মুন্নির। তাই বলা নেই, কওয়া নেই একদিন দুম করে বাপের বাড়ি চলে গেল। এমনকি ছেলেটাকেও সঙ্গে নেয় নি। । সুপ্রিয় ভেবেছিল কিছুদিন পরিবেশ বদল করলে আবার ঠিক হয়ে যাবে। ছেলেও মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে অভ্যস্ত হতে উঠল। মুন্নির মা কতবার বোঝালো। নিজের জীবনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথাও শোনাল। কিন্তু কোন কিছুতেই রাজী হয়নি মুন্নি। সে আবার শুরু করতে চায়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়।পড়ার জন্য বেসিক ট্রেনিংএর একটা কলেজে ভর্তি হল। একরকম এক অবস্থার মধ্যে চলতে চলতে সকলে স্বাভাবিক সময়ের আশায়, ঠিক সেই সময় ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। মুন্নিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।কলেজ থেকে আর বাড়ি ফেরে নি। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব সব জায়গায় খোঁজ করেও কোন সন্ধান মিলল না। অবশেষে থানা পুলিশ । প্রায় তিনমাস তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। ক্রমে শোকও স্তিমিত হয়ে এল। কেউ জানল না একটা মানুষ কোথায় হারিয়ে গেল!
সময়টা অনেক এগিয়েছে। সময়ের পলি স্মৃতির আস্তরণে ঢেকে দিয়েছে শোকের ছ-ছ'টা বছর। এরমাঝে কত ঘটনাই ঘটে গেছে।মুন্নি থেকে পারমিতা হয়ে গেছে কবে। এক মোহের টানে একটা সুন্দর সম্পর্ককে মূহুর্তে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিল সে। মনে পড়ে তার ছোট্ট সন্তানটার মুখখানা। মা মা বলে গলা জড়িয়ে ধরার দৃশ্যখানা। সুপ্রিয়র ভালোবাসায় চিরকাল গভীরতা ছিল কিন্তু সে স্রোত ছিল বড় নিস্তরঙ্গ। কেন যে সুপ্রিয় তাকে জোর করে ধরে রাখতে পারেনি ভেবে কষ্ট পায় আজ। হয়ত সে জোরটুকুকে এড়াতেই পারতো না। আজ ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে। অনেক বড় ! মাকে সে নিশ্চই ঘৃণা করে।সে কি আর মায়ের মুখ দেখতে চাইবে! হয়ত সকলে তাকে গালি দেয়, থুতু ছেটায়। নোংরা কথা বলে। সেদিনের একটা মেসেজ জীবনটা হটাৎই পাল্টে দিয়েছিল তাকে। কেন যে এত দুঃসাহসী করে তুলেছিল তা আজ নিজেও জানে না। শুধু আবেগ, অন্ধমোহ নাকি চুড়ান্ত উৎশৃঙ্খল হতে চেয়েছিল মনে মনে।
অনুপম আজ দু'বছর হল তার পূর্বতন স্ত্রীর কাছে ফিরে গেছে। পারমিতা আর ফিরে যেতে পারে নি। সে এখন এই অবাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকায় সকলের সেলাইদিদি, পারমিতাদি।
পুজাবকাশ
প্রদ্যোৎ পালুই
“অফিসে কাল থেকে দু’সপ্তাহের পুজোর ছুটি। স্কুল-কলেজের ছুটি আরও বেশি। সরকারি কর্মচারী থেকে ছাত্রছাত্রী সকলের মধ্যে একটা উড়ু-উড়ু ভাব। সকলেই পুজোর আনন্দে ভেসে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব। পুজোর ছুটির আগে শেষ দিন অফিস খোলা থাকলেও কর্মচারীদের কাজে মন নেই। সকলের বাড়ি ফেরার তাড়া। অফিস বস সেন সাহেব ছুটির প্রাক্কালে টিফিন টাইমে নিজের চেম্বারে অফিসের সকলকে নিয়ে একটা টী-পার্টির আয়োজন করেছেন। সকলেই প্রায় উপস্থিত। ক্যান্টিনের শিবুকে আগে থেকে বলা ছিল। সে সকলকে চা এবং স্ন্যাক্স পরিবেশন করছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সেন সাহেব হালকা চালে গল্প জুড়লেন, “আপনারা তাহলে এবছর পুজোয় কে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন?”
নানাজনের নানারকম পরিকল্পনা। কেউ কাছে পিঠে দীঘা, বকখালি ঘুরে আসার ব্যবস্থা করেছে। কেউ কাশ্মীর, সিমলা, গোয়া তো কেউ কেউ আবার বাড়তি কয়েকদিন ছুটি নিয়ে ব্যাঙ্কক, দুবাই ইত্যাদি বিদেশে যাবার টিকিট কেটেছে। যারা বড় রকমের ট্যুর করছে তারা বেশ গর্ব এবং আভিজাত্য নিয়ে পেশ করছে বেড়ানোর পরিকল্পনা। সেন সাহেব নিজেও একসময় নিজের আসন্ন ট্যুরের ফিরিস্তি তুলে ধরলেন। তিনি বিদেশ না গেলেও এবছর সপরিবারে অরুণাচল বেড়াতে যাচ্ছেন। সেখানে সপ্তাহখানেক কাটিয়ে আসবেন। ষষ্ঠীপদ ছাড়া উপস্থিত সকলেই বেড়ানোর ব্যাপারে কমবেশি মুখ খুলেছে। সেন সাহেব সেটা লক্ষ্য করে বললেন, “ষষ্ঠীবাবু, সকলেই নিজেদের বেড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানালেন। আপনি কিন্তু কিছুই বলেননি। আপনার পরিকল্পনার কথা একটু সকলকে জানান। এটা তো অন্য কিছু নয়। জাস্ট পরস্পরের মত বিনিময়।”
“আমার কিছু পরিকল্পনা নেই, স্যার।”
“মানে ! আপনি কোথাও যাচ্ছেন না?”
“না, স্যার। আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
“কেন? বছরে এটাই সবচেয়ে বড় সরকারি ছুটি। এটাকে কাজে লাগাতে পারতেন। কাছাকাছি কোথাও অন্তত দু-চার দিনের জন্যে বেড়িয়ে আসতে পারতেন।”
“কিছু সমস্যা আছে, স্যার।”
“সমস্যা কমবেশি সবার থাকে। সমস্যা ছাড়া মানুষ আছে নাকি? তবুও অনেকে যায়, কাছাকাছি কোথাও অন্তত যাবার চেষ্টা করে। আপনার তো ছোট ফ্যামিলি।”
“না স্যার, আমার ফ্যামিলি ছোট নয়।”
“কেন, আপনারা স্বামী-স্ত্রী আর একটা ছেলে, তাই তো?”
“না স্যার, আমার ফ্যামিলিতে সাকুল্যে আটজন সদস্য।”
“আটজন!”
“হ্যাঁ স্যার, আমরা তিনজন হলে কী হবে, বাব-মা, একটা অবিবাহিত বোন আছে। তাছাড়া স্বামী পরিতক্তা দিদিও তার ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকে। এতগুলো মানুষের জন্যে আমার একার রোজগার। খুব হিসেব করে সংসার চালাতে হয়।”
পাশ থেকে মলয় বলল, “আরে, তুমি সবাইকে নিয়ে যাবে কেন? তোমরা তিনজন কোথাও ঘুরে আসতে পার। বাকিরা বাড়িতে থেকে কাছাকাছি পুজো দেখবে।”
“তা হয় না মলয়দা। সবাইকে মনঃকষ্টে রেখে আমরা বেড়াতে গেলে কেউ হয়তো কিছু বলবে না। তবে সেটা আনন্দদায়ক হবে না। আপনারা যান, বেড়িয়ে আসুন। আমি আপনাদের কাছ থেকে বরং বেড়ানোর গল্প শুনে নেব।”
চেম্বারে তখন পিন পড়ার নিরবতা। সেই নিরবতা ভাঙলেন সেন সাহেব। “আপনার আর কোন ভাই নেই?”
“থাকলেও সে এখানে থাকে না। ফ্যামিলি নিয়ে বাইরে থাকে। কাউকে দেখে না।”
“আপনার ডিভোর্সি বোন খোরপোশ আদায় করতে পারেনি?”
“আদালতে মামলা চলছে। এখনও ফায়সালা হয়নি।"
সেন সাহেব প্রশ্ন করা থেকে বিরত হলেন। বুঝতে পারলেন, সবার কাছে পুজো সমান আনন্দ নিয়ে আসে না। কারও কারও কাছে বরং উল্টোটাই বয়ে আনে। পুজো এলেই তাদের মন খারাপের পালা শুরু হয়। সকলের উদ্দেশে বললেন, “পুজোর ছুটিতে সকলে ভাল থাকবেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়িয়ে আসুন, আনন্দ করুন। যাদের নিতান্তই বাইরে যাবার সুযোগ নেই, তাঁরা বাড়িতে থেকেই আনন্দ করবেন। মন খারাপ করবেন না।”
চা-চক্র ভেঙে গেল। চারদিকে ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছে। ছুটির সময় হওয়ার আগেই এক এক করে অনেকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতে শুরু করল।
চিনু
নিরঞ্জন জানা
" চিনু, ভারতের প্রধানমন্ত্রী'র নাম কি? --বলো, বলো- না হলে তোমার সাথে খেলবো না। এই বলে রাখলুম।" নিরুপম- এর কথা শুনে চিনু বলে," ভালতের
পদান মন্ তি ,অতল বি লা লী বাদ পাই।"
-বলো তো--"মা যশোদা কাঁদে।"
চিনু কথাটা শুনেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। পালাতে শুরু করল। নিরুপম বলে- "অ্যাই,দাঁড়াও- বলো বলছি- নাহলে রাগ করব। চিনু ছুটে এসে মামা নিরুপমের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখে মুখ গুঁজে বলে, "মা দতোদা কাদে"। নিরুপম সোনা মানু বলে বুকে জড়িয়ে ধরে ভাগ্নী, চিনুকে আদর করে।
সে কবেকার কথা। ভালো করে কথা
বলতেও শেখেনি। মামাদাদুর সাইকেলে বসে হঠাৎ একদিন আসা। আসা নয়; এ যেন রীতিমতো আবির্ভাব। ছুটে গিয়ে দিদা
কোলে তুলে নেয় । টাকার চেয়ে টাকার সুদের কদর যেমন অনেক বেশি তেমনি নাতনি ,চিনুকে পেয়ে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দ্যায়। অবশ্য, দিদাকেও এজন্য কম
ঝক্কি-ঝামেলা সামলাতে হয় নি। দিদা এক
সন্ধায় ঘাটে যাওয়ার আগে জেদি চিনু আড়ি ধরে ," আগে তুই তাপড় খুল ,তারপর
ঘাতে যাবি, আগে তাপড় খুল--।"
ধুলো -মাটি ,খেলামপাতি নিয়ে গাছ
তলায় খেলতে খেলতে যদি কখনো কুরকুট
কামড়ে দ্যায় কিম্বা শুঁয়োপোকা লেগে যায়,
তাহলে চিলচিৎকার করে ডাকে , "ওরে মোকে কুরকুটিয়ে খেয়ে লিলোরে ,ওরে থুঁয়াপোকা ধরে লিলোরে --ওরে দিদিমারে-
ওরে মামারে-- কুরকুটিয়ে খেয়ে লিলোরে।"
ছুটে গিয়ে চুন লাগিয়ে দিলেই মন্ত্রের মতো কাজ হয়ে যেত।
সারা ঘরময় ঘোরাঘুরি। সবসময় পায়রার মতো বকমবকম করেই চলে আর
শুধু এটা খাব ওটা খাব বলে বায়না ধরে।
তাই নিরুপম কখনো কখনো ওকে চিনু না
বলে 'বাকুম' ও 'খাওয়া বুড়ি' বলে ডাকে।
চিনু একটু একটু করে মিতালি হয়ে
উঠছে। কেননা , প্রাথমীক-এ পা দিয়ে ঐ নামেই ও ভর্তি হয়েছে। এখন, খাওয়া বুড়ি
বলে ডাকলে রাগ করে। ভেংচি কেটে বলে,
" মামিকে সব বলে দেব।" মনে মনে
ভাবি-- ঘর নেই দোর খোঁজে। বউ নেই বাচ্চা খোঁজে। বিয়েই হয়নি-- আবার মামি।
এ নিয়ে নিরুপমের ভারি ভাবনা। না, না বিয়ে নিয়ে নয়। ভাবনা-- কে আসবে, কেমন হবে, কিভাবে মানিয়ে নেবে।আদৌ
মানিয়ে নেবে তো -- । তাই সৌমিতাকে দেখতে গিয়ে নিরুপম প্রথমেই জিঙ্গেস
করেছিল , " দেখুন, আমাদের বাড়িতে ছোট্ট একটি ভাগ্নি আছে, বড় আদুরে। মানিয়ে নিতে পারবেন তো ?" মৃদু হেসে
বলেছিল, " পারবো। "
বিয়ে হয়ে বাড়িতে এসে সৌমিতা
সত্যিই পেরেছিল। তা না হলে পুরী হনিমুনে
চিনুকে সাথে নেয়? নিরুপম বেয়াড়া হয়ে উঠলে,সৌমিতা বলে,"অ্যাই -দেখছো না,চিনু আছে।" নিরুপম নিরুপায় হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু কি পুরীতে, এরকম ঘরেও তো
কতবার হয়েছে।
চিনুর আদর যত্নের অভাব নেই। গান
শেখে ,ছবি আঁকে। না, নাচ শেখানো হয়নি।
তবে, মামি একরকম জোর করেই আঁকায়
দিয়েছিল। চিনুর আঁকার হাত ভারি সুন্দর।
সে এখন আঁকার দিদিমণিও।
নিরুপম- সৌমিতার জীবনে পাপান ও
দিঘি এলেও চিনুর আদর কমেনি। ক্যাডবেরি , ডেয়ারি মিল্ক যাই আনুক না কেন, তিন জনের জন্যই সমান আনে।
পাপান- দিঘি মাকে বিশেষ কিছু করে দিতে বললেও, মা বলে,"থাম না, তোর দিদি মেস
থেকে আসুক, এলে করে দেব। একসাথে
বসে খাবি।" চিনুর জন্মদিন ঘটা করে ওর
মামিই পালন করে। মা আসে না। কবে কবে মামি 'মা' হয়ে গেছে। এ যেন এ যুগের যশোদা--পাড়ার লোক এ কথাই বলে।
জন্মদিনে মোমবাতির উজ্জ্বল আলোয়
চিনুর অপার্থিব আনন্দ আঁচলে বাঁধে
যশোদা সৌমিতা।
সৌমিতার পেছনের দিন গুলো মনে
পড়ছে। ফ্রক ছেড়ে চুড়িদার। ঋতুতে পা
দিলে ,ঋতু রং ধুইয়ে দিয়েছে। কণ্ঠে কোকিল ডাকলে , চোখে পলাশ ফুটলে,
মহুয়ার গন্ধে আর পাঁচটা মেয়ে যা করে
চিনুও তাই করেছে। ভালো মন্দ বোঝাতে
গিয়ে কত রাত ভয়ে ভয়ে জেগে কাটাতে
হয়েছে। মন যে বিদ্রোহ করে নি তা নয় ।
সহ্য করতে না পেরে সৌমিতা নিরুপমকে
বলে," তারা বাবা-মা হয়ে নিশ্চিতে ঘুমোবে,
আর আমাদের হয়েছে যত জ্বালা ! নিকুচি
করেছে ভালো হওয়ার। দেখবে- জন- জামাই-ভাগ্না কেউ নয় আপনার। নিরুপম
বলে,"আসলে কি জনোতো ? আমরা হলাম
ক্ষমতাহীন দায়িত্বের অধিকারী। বাবা-মা যতই বকুক কিচ্ছু মনে করবে না। মামা-মামি যদি কিছু বলে বলবে ,তাড়িয়ে দেওয়ার ফন্দি।" রাত ফর্সা হলে সৌমিতাও
নতুন সূর্যের মতো একগাল হেসে বলে,
"থাক না , ও তো ছোট , পাপান-দিঘি করলে কি করতে?"
সত্যি,কথায় বলে মেয়েদের বাড় লাউ
ডগার মতো। সেদিনের সেই পুঁচকে চিনু
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে আজ বিএড পাঠরত। কলেজ থেকে ফিরে
মামির সাথে কত গল্প। সোনার গল্প, সোনা
মানে সুরজিৎ, সুরজিৎ মানে আমাদের
হবু জামাই, তার গল্প, বাবা-মা'র গল্প ,ঠিক
গল্প নয় ,মা-এর প্রতি রাগ, জীবনে কোন
কিছুই দ্যায় নি। আচ্ছা মামি তুমি ই বলো
মীনার বাবা মেসিন ট্রলি চালায়, তবু তার
মেয়ের সব সখ আহ্লাদ মেটায়। আমার বাবার এত কিছু থেকেও ...।
--থাম রাগ করিস না। তোকে হয়তো খুব
প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ করতে পারিনি কিন্তু
কোন্ আব্দারটা তোর মামা মেটায়নি বল?
লেখাপড়া, গানবাজনা, আঁকা, কম্পিউটার, বেড়ানো... ।
--মেয়ে হয়ে দুপুরে একা ছবি আঁকাতে যাই।
লোকে অনেক কিছু বলে। মামার সম্মান
যায়। বাবা কি কিছু হেল্প করতে পারতো
না?
--কেন, তোর মামা তো অনেকদিন আগেই
বারন করেছিল।
--স্বীকার করছি, মামা বলেছিল আর এটাও
বলছি,মামা না থাকলে এই জায়গায় আমি
পৌঁছাতে পারতাম না।
--ছাড় ওসব কথা একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাগ থামলে আবার সমাজের গল্প বলে, নারী স্বাধীনতার কথা বলে। সে সব কথা শুনে মাঝে মাঝে সৌমিতাও সংসারে বিদ্রোহ করে।
কখনো কখনো অভিশাপও কারুর
জীবনে আশীর্বাদ হয়। করোনা কালে লকডাউনে কলেজ বন্ধ থাকায় চিনু মামিকে বলে," মামি, সামনের ফাগুনে যেহেতু আমার বিয়ে তাই বাড়ি যাই, কয়েকটা দিন মায়ের কাছে থাকি, না হলে
সারাজীবন বাইরে বাইরে কেটে যাবে।
কয়েকদিন পর মামি ফোন করে,"কিরে চিনু
ফোন করিস নি কেন? কেমন আছিস?
কবে আসবি? " মুক্ত হাওয়ায় অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে মিতালি বলে,"মামি এখানে
না এলে জীবনে বেঁচে থাকার মানেই বুঝতাম না। "
-- কি রে একদিন যেতে না যেতেই এত পরিবর্তন... না থাক, সকলের মন
খারাপ চলে আসবি।"
আসলে, কোন যশোদাই তার কানুকে ধরে রাখতে পারে নি।কেবল সন্তান স্নেহ কুড়িয়ে কুড়িয়ে মায়ার আঁচলে বাঁধে।
মিতালি হঠাৎ বিজ্ঞপ্তি পায় বি এড'র
ফাইনাল ইয়ারের ফর্ম ফিলাপ। তাই ,মামা
নিরুপমের ফোনে রিং টোন-এ বেজে ওঠে
" আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে..।"
মামি ফোন ধরলে অপর প্রান্ত থেকে ভেসে
আসে - হ্যালো! মামি,মামা যে কুড়ি হাজার
দেবে বলেছিল--সেটা পরশুর মধ্যে কলেজ
দিতে হবে, মামাকে বলবে।
--হ্যালো! চিনু শোন, তোর মামা'র আর্থিক
অবস্থা এখন তুই তো জানিস, সে দশ হাজার দেবে বলে আলোচনা করেছিল।
--জানি, মামা'র সব কিছুই হয়ে যাবে। শুধু
আমার বেলায়...। মামা- ই আমাকে ফাসিয়ে দিল। রাখছি।
ফোন রেখে বাবা 'র দিকে তাকায় চিনু। বাবা ধান ভর্তি ডোলে হেলান দিয়ে
কয়েক দিন আগে আসা টাকা অ্যাকাউন্টে
চেক করছিল। চিনু বলল,"বাবা বাকিটা তুমি দাওনা। "
--আমি দিতে পারবো নি।আর পড়তে হবেনি।
অগত্যা দাদাকে বলল। দাদা বলল," না।
দিতে পারবো না। আমি দরজা বানাব।"
বাধ্য হয়ে মিতালি সদ্য রিং এনগেজমেন্ট
হওয়া সুরজিৎকে ফোন করল। সে ক্ষেত্রেও নিরাশ হল। উল্টে ফ্রিতে শুনতে
হল, "আগে বলনি কেন? তাই, তোমার ফ্যামিলি নিয়ে এত বড়াই করতে যে ?"
কাজেই, সেই বুড়ো বটতলা। দিদা ও মামি'র কাছে ফিরে আসে । মিতালি বলে, "তোমরা না দিলে রিং এনগেজমেন্ট'র আংটি বাঁধা দেব। দিদা ও মামি বলে, " না,
এ কাজ করিস না। কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। থাক, অনেক দিন থাকিস নি।মন খারাপ করছে।মামা ঘরে এলে আলোচনা
করে কিছু একটা ...
--না, থাকব না।
--কেন ? থাকনা।
--না, আমি থাকলে তোমাদের একটা 'বাড়তি!
--আজ ছাব্বিশ বছর থেকে গেলি।কখনো
বাড়তি বলে মনে হয়নি।আজ দু' দিন ঘর
গিয়েই বাড়তি বলে মনে হল? সব ভুলে গেলি?
দশ বছর আগেই আমার মনে হয়েছিল,
তখন কোন উপায় ছিল না বলে বাধ্য হয়ে
থেকে গিয়েছিলাম। না হলে কবেই চলে
যেতাম।
রুমির ডাকঘর
কবিতা সামন্ত
প্রিয় ডাকঘর,
তোমার কথা মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে। মনে পড়লেই মনটা ভীষণভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।মানুষ আধুনিকতার হাত ধরে এতটাই এগিয়ে গিয়েছে যে তোমার কথা ভাববার কোন অবকাশই নেই তাদের কাছে!
এখনো দেখি কোথাও কোথাও তোমার কাছে পৌঁছে দেওয়া চিঠি পত্রের বাক্স গুলো ভাঙাচোরা অবয়ব নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে। ওরা যেন একবুক কষ্ট নিয়ে অনেক কিছু বলতে চায়,কিন্তু মানুষের মনে ওদের কষ্টের কথা শোনা বা জানার ইচ্ছেই নেই! আর বতর্মান প্রজন্ম তো তোমার কথা জানেও না। ওরা জানেনা কেমন করে একটুকরো কাগজে কলম আর অক্ষরের সংলাপ। কিভাবে মানুষের মধ্যে একটা চিঠির উদ্বিগ্নতা ভরে থাকত,কিভাবে পাশের কারোর বাড়িতে ডাকবাবুর সেই সাইকেলের কিরিং শব্দে ঝোলায় থাকা খামের পেটে একটা চিঠির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত গোটা পাড়াময়। সুখের সংবাদে চিঠি বুকে জড়িয়ে আপনজন রাতে শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে পড়ত আবার দুঃখের খবরে শোকের খবরে সারা পাড়া বা কখনও কখনও গ্রাম শুদ্ধ একসঙ্গে বসে রাত্রি জাগত।
একটা চিঠির গন্ধে গোটা গ্রামের সুখ দুঃখ জড়িয়ে থাকত।
একটা চিঠি লিখিয়ে নেওয়ার জন্য তোমার দরজায় গিয়ে বারবার ডাকবাবু আছো নাকি?কিংবা পড়ে থাকা ধুলোদের ঘরের চিঠির খোঁজে তোমার দরজায় হানা দেওয়া অথবা
প্রবাসী সন্তানদের কত পড়াশোনা না জানা বাবা মা তোমার কাছে গিয়ে ডাকবাবুর কাছে মিনতি করে আসতো...বাবু,চিঠিটা যেন ছেলের মেয়ের কাছে পৌঁছে যায়।চিঠি না পাওয়া কেউবা চিঠির অপেক্ষায় আবার আগাম বলে আসতেন...ডাকবাবু,আমার নামে কোন চিঠি এলে জানিও। অথবা বলতেন...ভালো করে একবার তোমার ঝোলাটা খুঁজে দেখোনা বাবা;আমার নামে কোন চিঠি এলো কি না!
অথবা দেখতো বাবা...আমার নামে কোন টাকা কড়ি এলো কি না।
সেসব কথা মনে পড়লে শরীরের প্রতিটা লোমকূপে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মনে হয় সেসব দিনই ভালো ছিল। অল্পতে মানুষ ভীষণ খুশি হয়ে যেত,আবার একে অপরের সঙ্গে সূখ দুঃখ ভাগ করে দিনের পর দিন এমনকি মাস বছর পর্যন্ত চোখের জলে ভাসত।
এখন যেন কোন কিছুর প্রতি কারোর তেমন আগ্রহ নেই। না আছে আনন্দের কোন রেষ, আর না আছে দুঃখের কোন আয়ু! নিমেষেই জন্ম আর নিমেষেই তার মৃত্যু। জানিনা আজও তুমি গ্রামে বা শহর তলির কোন কোণে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছো! আমার এই স্মৃতির প্রেক্ষাপট এই সংলাপ তোমার কাছে পৌঁছবে কি না। তুমি আদৌ আমার লেখা এই অক্ষর গুলো ছুঁয়ে দেখবে কি না। তবুও তোমায় লিখছি...এই বিজয়ায় তোমাকে শুভেচ্ছা জানাই। কোন বাড়ির দরজায় লেখা ঠিকানা নয়,আমার এ চিঠি যেন তোমার দরজার গিয়ে তোমাকে জানান দেয়...এ অক্ষর শুধু তোমার জন্যই কাগজের বুকে আঁকা হয়েছে। কোথাও হয়তো তোমারও আত্মীয় রয়েছে যে তোমাকে আজও মনে রেখেছে। তোমার দোর থেকে আবারও সেই অনুভূতি প্রবণ খামের পেটে লুকিয়ে থাকা চিঠির জন্ম হোক। ডাকবাবু আবারও তোমার জানালার ধুলাবালি ঝেড়ে খোলা হাওয়াতে তোমার বদ্ধ জীবনে খুশির বন্যা বইয়ে দিক।ঝোলা ব্যাগ ঝোলানো থাক তোমার দেওয়াল জুড়ে। কাগজ আর কলমের আত্মীয়তা তোমার ঘরে সেজে উঠুক। ভালো থেকো আমার সেই প্রিয় ডাকঘর,ফিরে পাক তোমার প্রতিটা ডাক বাক্স তার সেই পুরাতন অবয়ব।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ রুমি।হঠাত দরজায় ডিং ডং বেল।
একটা চিঠি এসে পৌঁছল দরজায়।
গল্প লেখার গল্প
ননীগোপাল জানা
পূজার সময়, কাগজ-কলমের সম্পর্কের সুসময়,
যে সময় লেখক লেখিকাদের কলমে ছড়া হাসে, কবিতা কথা বলে,গল্পেরা গাছে চড়ে ।
গোলক বাবুর ইচ্ছা একটু বড় পত্রিকায় গল্প লিখবেন।
সম্মান ও সম্মান দক্ষিণা মিললে ও মিলতে পারে, অবশ্যই যদি পাঠকেরা গল্পটা নিয়ে গল্প করেন।
এর আগে গল্প লিখেছেন, ছেপেছেন 'সাথী' 'রোদ্দুর' ও একাধিক লিটিল ম্যাগাজিনে।
আর "দুই পাতা"র সম্পাদক মহাশয় নতুন লেখকদের উৎসাহ দানের জন্য, বলা যায় নতুন নতুন লেখক তৈরি করার জন্য ,তাদের লেখা কখনো সখনো
'দুই পাতা' র পাতায় সমাদরে বসিয়েছেন।
সেই থেকে আশা কুহকিনী মনে বাসা বেঁধেছে,
'অল্প কথার
গল্পকার' হবার। একটা ভালো প্লট পেলেই লিখে ফেলবেন।
নামী দামি জমির প্লট যখন পাওয়া যায়, তখন লেখার প্লট পাওয়া যাবে না ?
এ কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো
শিবরাম চক্রবর্তী পায়চারি করতে করতে প্লট খুঁজতেন।
পায়চারি করে, নাতনির সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়েও
যখন লেখার প্লট আসছে না, সাত সতেরো ভাবতে ভাবতে মনে হল সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কায় সীতা উদ্ধারের জন্য অনেক লম্ফঝম্ফ করে ক্লান্ত হয়ে একসময় সীতা উদ্ধার প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল হনুমানের ।
পরক্ষণে ভেতর থেকে প্রেরণা আসে "উদ্যমই সৌভাগ্যের মূল"।
শেষে সীতা সন্ধান এবং সীতা উদ্ধার হল তো?
গোলক বাবু মনে মনে হনুমানকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নতুন উদ্যমে রং বেরঙের রঙিন কলমের গোছা নিয়ে বসেন।
কোনো কলম রবি কবির নামে, শরৎচন্দ্র কিংবা বিভূতিভূষণ, নজরুলের নামে। "রসে বসে"র লেখকের নামেও একটা।
গোলক বাবুর মনে হয়েছে ভালো ভালো লেখকের নামের প্রতি সমীহ থেকে ভালো গল্পের প্লট নেমে আসতে পারে।
একটা প্লট নামছে মনে হচ্ছে কিন্তু দাঁড়াচ্ছে না । তখন মাথা ঘুরছে গোলকের মতো।
আবার যখন এলো তখন কলম ছোঁয়াতেই ছোঁয়াচে রোগটা মাথা চাড়া দিল । কোন্ লেখকের নামের কলমটা আগে টাচ্ করবেন?
তাই দ্বিধা দ্বন্দ্ব এড়িয়ে, সব কলম সরিয়ে , দাদুর আমলের কলমে ভরসা রেখে ,লেখক তারাশঙ্করের নামে
তিনবার কপালে কলম ঠেকিয়ে লিখতে শুরু করেন।
মনে হলো -তিনি 'বামা'র ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবছেন। এখন 'না' বলার সময় নাই।
সঙ্গে সঙ্গে ভাবনা ওলটপালট করে একটা রসনা উদ্দীপক প্লট এসে গেল।
'ইলিশের আমন্ত্রণ।'
শিল্পী পুলক বাবু ও তার বউ,
স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বদলা নেওয়ার খেলা খেলছে বহুদিন ।
কারণটা?
একটু গোপন রাখবেন প্লিজ!
কিছুদিন হল রাতে,শিল্পী যখন ঘুমের আলিঙ্গনে আচ্ছন্ন প্রায়।
শ্রীমতি তখন তীব্র আলো জ্বালিয়ে নানা কাজের বাহানায় উচ্চরবে বক্তৃতায় বিরক্তি উৎপাদন করেন।
আবার শ্রীমতি যখন এখনকার ছেলেদের মত অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকতে চান, শিল্পী ও সমানে প্রতিবাদী শিল্প আঁকেন।
তীব্র আলো জ্বালিয়ে ফ্যান বন্ধ করে দেন।
তখন শ্রীমতি ভয়ংকরী হয়ে
লম্বা ফর্দের
সঙ্গে বাজার সেরা রাজার মতো লম্বা তালিকা দেন।
বড় ইলিশ আনার কথা বললে শিল্পী বলেন একটু সবুর করো।
পুকুরে ইলিশের চাষ শুরু হয়েছে ।
দেখবে এক সময় পোষা বেড়াল কুকুরেও ইলিশ ছাড়া টিফিন খাচ্ছে না।
এই কথা বলার
পরক্ষণে ভয় ও পান, বউ যদি রং তুলি সরিয়ে রেখে
হ্যারাস করে!
এখন বৌ-দের কিছু বলাও তো মুশকিল !
কারণ আইন-কানুন অর্ধেকের বেশি অর্ধাঙ্গিনীদের জিম্মায় চলে যাচ্ছে ।
এখন ললনাদের গলার বলার জোর ধৈর্য্য গলানোর গলনাংক অতিক্রম করতে পারে।
তাই সাধ্যমত সংযত কণ্ঠস্বরকে উদারাতে নামিয়ে মিহি আওয়াজ করে বলল -ঠিক আছে গিন্নি!
তোমাকে বড় ইলিশ খাওয়াবো ! তবে অত বড় ই - লি -শ!
তোমার ভাইকে ডাকবে না ?
যেদিন তোমার ভাই আসবে সেইদিনই আর কোনো অন্যথা হবে না গো!
এখন শুধু ভাইয়ের অপেক্ষায়,
শুধু টাইমটা জানালেই ভালো হয়।
শিল্পীর কি নিস্তার আছে গো!
ছবি আঁকার ক্লাস রাত অবধি।
আবার পাঁচ বন্ধু বাড়ির ইলিশের আমন্ত্রণ, যেদিন খুশি যেতে পারি। আমন্ত্রণ জমা রেখেছি।
মিষ্টি কথা শুনে তুষ্টিতে ডগমগ। সঙ্গে সঙ্গে হ্যালো করে
ভাইকে।
কাল সকালের মধ্যেই আয়! মহালয়া পেরিয়ে গেল, কবে ডাকতে আসবি ভাই?
উত্তর দেয় ভাই। -ঠিক আছে দিদি।
-তবে তুই তোর জামাই দাদাকে জানিয়ে দে!
কখন আসবি।
পরদিন সকাল-সকাল শিল্পী তার গিন্নির ফর্দ পাঁচ মিনিট আবৃত্তি করে -'জয় মা দুর্গা' বলে বেরিয়ে পড়েন।
যথারীতি মাছ বাজারে দেখা শালা ভগ্নিপতির ।
ওজনের পর ইলিশের দাম 2735 টাকা ।
5 টাকা বাদ দিয়ে
দাম ফাইনাল করে শালাকে বলল -ভাই পার্স টা খুঁজে পাচ্ছি না তো!
শালাবাবু জানায় ভাবতে হবে না দাদা, আপনি আপনার আঁকার ক্লাসে চলে যান। আমি ইলিশ নিয়েই আপনার বাড়ি যাচ্ছি।
একটু ভেবে শালা কুটুম্বকে সতর্ক করে দিলেন, যেন টাকা পয়সার কথা তার দিদিকে না বলে।
শালা কুটুম দিদি বাড়ি যাবার সময় ভাবছে, ইলিশ খাওয়াবে না ফুলিশ বানাবে?
তবে দিদি যদি জানতে পারে সুদে ও আসলে পুষিয়ে দেবে।
একে তো শিল্পী গিন্নি, এতদিনে অনেক রং চিনে ফেলেছে। কর্তার রং করা রঙ্গ তামাশা চিনতে একটুও ভুল করে না।
এদিকে রাত আট টার সময় তিন বন্ধু সহ শিল্পী হাজির।
কি গো বৌদি,কি রান্না হচ্ছে?
খাওয়াবেন না?
আপনার রান্না যে খেয়েছে সে এজন্মে
ভুলবে না !
-ঠিক আছে তোমরা
গরিবের বাড়িতে যা আছে,না খেয়ে কেউ যাবে না!
খাওয়ার সময় দেখা গেল তারা চেয়ে চেয়ে এমন খাচ্ছে যে ভাইয়ের পাতে সকালে দেওয়ার মত একটা পিস ও নেই ।
রাগ হচ্ছে
কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। অবস্থা বুঝে শিল্পী গিন্নির জিম্মায় থাকা
পার্সের অন্তর খুঁড়ে তিন হাজার টাকা বের করে ভাইয়ের পকেটে কখন রিচার্জ ভরে দিয়েছে ।
পরদিন সকালেই ভাই বাড়ি যাবে। দিদি পতি দেবতাকে বলল -
শুনছো?
৫০০ টাকা ভায়ের হাতে দাও না গো!
ভাইকে বললো -জামাই দাদাকে ইলিশের আমন্ত্রণ জানাবি না ?
নীরব সাক্ষী
বীরেন্দ্রনাথ মহাপাত্র
আজকে সমরেশ মৃত সুলতাকে নিয়ে যখন শ্মশানে দাহ করতে গেল তখন উঠানে সুলতার কোলের মেয়ে ক্রন্দন রত তিন বছরের সুধা এবং আট মাসের অন্তঃস্বত্তা ও ছিল । দাহ কারীদের নির্দেশে, দাহ করার আগে পেট কেটে দিতেই একটি অসম্পূর্ণ শিশু অর্থাৎ একটি ছেলে বেরিয়ে এল ; কিন্তু সাময়িক ছটপট করেই মারা গেল । সেই সময় সমরেশ একবার ভাবল যে এই দত্ত বাড়িতে ব্রহ্মশাপ লেগেছে, তা না হলে দাওয়ায় বসে বাবা জগদীশ মা প্রমীলা আর ঘরের ভিতর ছেলে সমরেশ ,বৌমা সুলতা ও কোলের মেয়ে সুধা ছিল,সামান্য বৃষ্টিপাত পরে হঠাৎ বজ্রাঘাতে বাবা ও মা নিশ্চুপ নিথর হয়ে গেল ।
ওদের শ্রাদ্ধ শান্তি শেষ হওয়ার কিছুদিন পর ঠিক একই ভাবে ঘাটে কাঁসার বাসন মাজতে মাজতে বজ্রাঘাতে সুলতা ও চলে গেল । এবার সমরেশ সুধাকে কোলে পিঠে মানুষ করতে করতে এক ঘটকের পাল্লায় পড়ে মণিকাকে বিয়ে করতে বাধ্য হলো । মা - হারা মেয়ে সুধা বাপের আদরে পড়াশুনা মোটামুটি করলে ও সারাদিন ছেলের মত মাঠে ঘাটে বিশেষ করে নদীর ধারে বসে বসে দিন কাটিয়ে এক পূর্ণ বয়স্কা যুবতী হয়ে উঠল । মেয়ের রঙ বেশ চাপা হওয়ার জন্য বাবা বিরাট চিন্তায় পড়ল,বিশেষ করে মণিকার কোলে একটি ফর্সা মেয়ে জয়া আসার পর সুধাকে সে একেবারে সহ্য করতে পারল না ।সারাদিন তাকে গালিগালাজ অবশেষে বাড়ির সমস্ত কাজ করাতে লাগল । সমরেশ সব দেখে ও সুধার সামনে না দেখার ভান করে । যে ঘটক তাকে বিবাহ করিয়েছিল, তাকে দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও বিফল হল । তাই একদিন রেগে সুধা কে বলল, " তোর এই ধিরিঙ্গিপনা আমায় আর সহ্য হয় না, তোর মায়ের চিতায় দিয়ে আসলে আমার সব জ্বালা মিটে যেত "।
তাতে সুধার মনে কোন বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হলো না । সে বাবার গালে চুমু খেয়ে দৌড়ে সেই পরিচিত নদীপাড়ের দিকে চলে গেল ।
সেদিন হঠাৎ নদীর ধারে চিরপরিচিত বীরেশের সঙ্গে দেখা ও হয়ে গেল । বীরেশ একমনে মোবাইল নড়াচড়া করছে ।এই দেখে সুধা বীরেশ কে বলল, " মোবাইলে কি দেখছিস রে ? তোর প্রেমিকা কে দেখছিস বোধ হয় ;" " সুধাদি তুমি এখন ও ঠিক সেই নাবালিকা হয়ে রইলে ,তুমি কিন্তু এখন নাবালিকা নয়,এখন পূরোদুস্তর একজন প্রাপ্ত বয়স্কা যুবতী " " তাতে কি হয়েছে ? আমার মনে এখন ও কোন পাপ বাসা বাঁধে না ---' আবার বলল,' হ্যাঁরে, মোবাইলে নাকি অনেক মেয়েদের কুৎসিত ছবি তুলে ,আবার তাকে ভয় দেখিয়ে প্রচুর পয়সা উপার্জন করে,আমাকে একটু কি জিনিস দেখাবি --- ?'
তখন বীরেশ মোবাইলে এক যুবক ও যুবতীর প্রকাশ্যে সহবাস দেখাল । তা দেখে সুধা যেমন লজ্জা ও পেল,তার চেয়ে যৌবনের কামনা দীপ্ত মন জেগে উঠল, বীরেশের চেয়ে ৩/৪ বছরের বড় হওয়া স্বত্বে ও যৌবনের উন্মাদনায় সে তাকে জড়িয়ে ধরল ।
তৎক্ষণাৎ বীরেশ বলে উঠল, ' একি করছো সুধা দি, এটা তোমার খুবই অন্যায় হচ্ছে ।' "ঠিকই বলছ তুমি, এটা একেবারে বেহায়াপনা ছাড়া আর কিছুই নয়, আমি সবই বুঝতে পেরেছি, বুঝে ও একটা অন্যায় করে ফেললাম ," বলেই ওর হাত দুটি ধরে কাঁদতে লাগল , ঠিক এই সময় বীরেশ বলে ফেলল, " এটা স্বাভাবিক, এই সব ছবি দেখে প্রাপ্ত বয়স্করা কেউ ঠিক থাকতে পারেনা,এতে আমি মনে কিছু করি না ।"
তবু ও কাঁদতে কাঁদতে বীরেশকে বলে বসল, " তুই আমাকে বিয়ে করবি, আমার দেহ,মন সবই আছে,শুধু গায়ের রঙ চাপা, আমাকে কেউই পছন্দ করে না, মা নেই,তাই এই বিমাতার জ্বালা আর সহ্য করতে পারছি না, পারবি না ,আমার যৌবনের জ্বালা মেটাতে, বল, আমি এখন ভাই,দিদি, বলে মানছি না,আমি কথা দিচ্ছি,আমি তোকে জীবন ভোর ভালবেসে যাব এবং নারী ধর্ম পালন করে যাব, শুধু একবার হ্যাঁ বল, ভালবাসায় ছোট বড় বলে কিছু নেই ।"
বীরেশ নির্বিকার হয়ে কি করবে তা ভেবে শুধু সুধার মুখের পানে চেয়ে রইল,এদিকে নীরব সাক্ষী স্বরূপ আবছা অন্ধকারে নির্জন বয়ে চলা নদী পাড় ।
মাথাটা ঝুঁকে যায়
অমিয় আদক
আমার বিবাহিত জীবন আজ খাপছাড়া। বেয়াড়া রকমের সমস্যার গভীরে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঈশ্বরে পাপপূণ্যে সামান্য হলেও বিশ্বাস রাখি। সম্ভবত সে জন্যই মানসিক ভাবে কিঞ্চিৎ বিধ্বস্ত। আমার জীবনে অতীতে এক প্রেমিকাও জোটে। সে প্রকৃত ভালোবাসায় আন্তরিক। সে সময় চায় তার ক্যারিয়ার গড়ার জন্য। আমি তার জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য্য রাখতে পারিনি। সেই প্রেমের জন্য নিজের যৌবনকে উপেক্ষা করিনি। সদর্পে সেই প্রেমকে অস্বীকার করি। সেই প্রেমের মূল্য দিতে পারিনি।
সেই পাপবোধ আজ আরও গভীরতর। আমার অজ্ঞাতেই আমার সেই প্রাক্তন প্রেমিকা আমার স্ত্রী অনুরাধার চিকিৎসা করেছেন। তিনিই তাকে প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আজ আমি কোন মুখে সেই চিকিৎসকের মুখোমুখি দাঁড়াবো? কি ভাবেই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো? সেই ভাবনায় ব্যাকুল। আমি চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে। ভিজিটিং আওয়ার প্রায় মিনিট কুড়ি বাকি। অতীতটা আমার ভাবনায় ফিরে ফিরে আসে।
বিদিশা আমার টুইশানের ছাত্রী। আমাদের গ্রামের গার্লস হাইস্কুলের মেধাবি ছাত্রী। পাশের গাঁয়ের মেয়ে। ক্লাস নাইনে পড়ে। মিষ্টি চেহারার শান্ত মেয়েটা। ম্যাথ ফিজিক্সের কোন অংশ দু’বার তাকে শেখাতে হয়নি। বিদিশার ইলেভেনে পড়ার সময়। আমি খানিক ঘোরলাগা। মনেমনে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলি। প্রকাশ করতে পারিনি। ব্যাচে পড়াই। গরীব ব্রাহ্মণের মেয়ে। বিনা বেতনেই পড়াই। তাকে একা পাওয়ার চেষ্টাও করিনি। ব্যাচেলার প্রাইভেট টিউটর। এলাকায় সুনাম সৌরভ ভালোই। সেটাও মাথায় রাখি।
বিষয়টা মনেই ঘুরপাক খায়। প্রকাশ করার ছটফটানি চলে। ছলের আশ্রয় খুঁজি। সেদিন বলি, ‘বিদিশা একটু ওয়েট করবে। একটা ফিজিক্সের বই দেবো। চ্যাপ্টারের মধ্যে সল্ভড প্রবলেমগুলো একটু দেখে আসবে।’ ইচ্ছাকরেই সেই চ্যাপ্টারের পাতার মাঝে দিই প্রেমের চিরকুট। তাও বাঁহাতের লেখায়। পরের দিন বই ফেরৎ পাই, উত্তর সমেত। উত্তরটা, হেঁয়ালি ভরা। অথচ সদর্থক। তা বুঝতে পারি। সরাসরি প্রস্তাব রাখতে পারিনি। পরে যা কিছু বলি চোখেচোখেই। একদিন সবার অলক্ষ্যে সামান্য কিছু কথা। সেদিন বিদিশার হাতটাই চুমু দিয়ে ছুঁই। মধুর পরশে বিহ্বল আমি।
বিদিশা উচ্চমাধ্যমিক পাশকরে ভালো নম্বর নিয়েই। জয়েন্টে কেবল মেডিক্যাল এন্ট্রান্সের পরীক্ষাতেই বসে। তেমন ভালো ফল করতে পারেনি। ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার ইচ্ছা নেই। তাই ভর্তি নামকরা কলেজে ফিজিক্স অনার্সে। পরের মাসে আমার বরাত ‘খুলজা সিমসিম’ করে খুলে যায়। আমি পাশের গ্রামের হাইস্কুলে ম্যাথের টিচার হিসাবে নিয়োগপত্র পাই। সালটা দু’হাজার ছয়। ব্যস্, আর ফিরে তাকাইনি। আমার প্রেমের পানসি তরতরিয়ে চলে। দু’জনাই মুঠোফোনের আলাপে প্রলাপে বেজায় ব্যস্ত। তখন বিদিশার ফিজিক্স অনার্সের সেকেন্ড ইয়ার।
চার বছর ধরে মুঠোফোনে অনেক ভালোবাসার কথা, ভালোলাগার কথা চলে। মনেমনে হিসাব চালাই, আর বড়জোর দেড় বছরের অপেক্ষা। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলেই বিয়ের প্রস্তাব আটকাবে না। তারপর চুটিয়ে ঘর সংসার করবো। এমন ভাবনায় তখন আমি বিভোর। তার মাঝেই হাজির বিদিশার জীবনে বেটার টার্নিং পয়েন্ট। সে মেডিকেল জয়েন্টে ভালো ফলকরে। ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় এন আর এস মেডিকেল কলেজে। আমিও প্রেরণাদাতা হিসাবে গর্বিত এবং খুশি। তার বাড়িতে যাই। তার বাবামার সামনে অভিনন্দন জানাই। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। গাঁয়ের অনেকের কাছেই প্রচার করি, ‘মেয়েটা আমার প্রেরণাতেই এতোটা আগিয়ে যেতে পেরেছে।’ গ্রামে আমাদের প্রেমের বিষয়ে কেউ কিছুই জানেনা। আমিও সযতনে অপ্রকাশ্য রাখি।
সেদিন থেকেই আমার মনে অপেক্ষার চিন্তাটা দানা বাঁধতে থাকে। এর পরেও পাঁচছ’ বছর অপেক্ষা! আমার বিয়ের জন্য এতোটা অপেক্ষা আমার হয়তো সইবে না। সেই কথাটা বিদিশাকে এখন বলাটাই অসম্ভব। তার জন্যও অপেক্ষার প্রয়োজন। চলতে থাকে অপেক্ষা। ফোনেও সেই কথা বলতে দ্বিধা। ফলত মুঠোফোনের আলাপ প্রলাপ কমিয়ে আনি। বিদিশাও তার পড়াশোনার ব্যস্ততায় হাবুডুবু খায়। তার দিক থেকেও ফোনালাপের আগ্রহ কমতে থাকে। আমিও নিজের মনকে ভিন্ন খাতে পাঠানোর চেষ্টায় থাকি।
এদিকে বাড়িতে বিয়ে করার তাড়া দিতে শুরুকরে। বেকার নই। তাই বিয়ে করার প্রস্তাব এড়ানোটাও কঠিন। মায়ের বয়স হয়েছে। তিনিও পরিবারের কাজের বোঝা ধীরেধীরে নিজের ঘাড় থেকে পরবর্তি প্রজন্মের ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন। বিদিশার জন্য বিয়ে করার দেরি হতেপারে এমন কথা অপ্রকাশিতই রাখি। বিদিশার জন্য অপেক্ষার দায়টা মনেমনে লঘু করতেই থাকি। সাথে প্রেমের বিচ্ছেদে ছুতো খোঁজার চেষ্টায় থাকি।
বিদিশার সামনে সবটুকু স্পষ্ট করার জন্য পৌঁছাই এন আর এস মেডিক্যাল কলেজে ক্যাম্পাসে। বিদিশা সেদিন জানায়, ‘তা আপনি বলতেই পারেন, সময় দিতে পারবোনা। আমার কিন্তু সময়ের প্রয়োজন। আমি চাই আমার সক্ষমতা প্রমাণ করতে। আপনিই আমার মধ্যে স্বক্ষমতা প্রকাশের জেদ তৈরি করেছিলেন। এখন আপনিই সেই জায়গা থেকে সরে গিয়ে অন্য কথা বোঝাতে চাইছেন। আমি বুঝতে পারছি, আপনি ভালোবাসায় বিচ্ছেদ চান। চাইতেই পারেন। আমি আমার ক্যারিয়ার গড়বই। আপনাকে ভালোবেসে হয়তো ভুল করেছি। আমিও আপনাকে ভুলতে চাই। এটাও জানাই, কখনই আমি ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসবো না। কথা দিচ্ছি। আপনিতো আমাকে এবং আমার ভালোবাসাকে ভুলতেই চেয়েছেন। আপনি সংসারি হতে চান। আমি বাধা দেওয়ার কেউ নই। আমি এখনও সেই ভাবনায় আসিনি। আমি জীবনে প্রতিষ্ঠা নিয়েই আপনার সামাজিক জীবনে আসতে চেয়েছি। তা যেহেতু আপনার কাম্যনয়। এখানেই কথা শেষ। আমাকে ভাবনা থেকে মুছে ফেলুন।’
সেদিন আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। অপরাধীর মতো এন আর এস মেডিক্যাল কলেজের কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য। আমি তখন নিজে স্বাবলম্বী। সেই অহংকারেই প্রায় অন্ধ। অনেকটা ধরাকে সরা জ্ঞানের মানসিকতায়। আমি তার প্রেমকে পৌরুষাত্মক জেদেই বসেই দু’পায়ে মাড়াই। সেই পাপবোধ আজও লালন করি। আমার ভাবনা ছিঁড়ে ভিজিটিং আওয়ারের বেল বাজে। গেট খোলে।
ওয়ার্ডে যাই। অনুরাধা এখন তুলনায় সুস্থ। তার মুখ থেকেই জানতে পারি একটি কঠিন সত্য। সে জানায়, ডঃ মুখার্জি বলেছেন, আমি সুস্থ শরীরেই বাঁচবো। সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি কোনদিন মা হতে পারবোনা। সত্যটা জেনে আমি অনুকে সান্ত্বনা দিতে একটিই বাক্য খরচ করি, ‘তুমি সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকলেই হবে। মা হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে।’ অনু নিরুত্তর।
আমার সাথে ডঃ মুখার্জির অতীত সম্পর্কটা নিঃসঙ্কোচে অনুকে বলি। সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে জানাই। অবশেষে আমি বলেই ফেলি, ‘জানো অনু, আমি অতীতের ভালবাসাকে সম্মান না জানিয়ে সত্যিই পাপ করেছি। আমায় শাস্তিতো পেতেই হবে।’ বাক্য শেষ হওয়ার আগেই অনু বলতে শুরুকরে, ‘আমি নিজে তোমার হয়ে ক্ষমা চাইবো। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা। ডঃ মুখার্জির মধ্যে একটা দৈবী শক্তি কাজকরে। আমার ওই ডাক্তার দিদিকে দেবী বলেই মনেহয়।’ এদিকে ওয়ার্ড-বয় জানায়, ‘ভিজিটিং আওয়ার শেষ। বাইরে যান। এখুনি ডাক্তার বাবুরা ওয়ার্ডে আসবেন।’ আমি বেরিয়ে যাওয়ার পথেই বিদিশার সাথে মুখোমুখি। তার প্রশ্ন, স্যার আপনি এখানে? পেশেন্ট কে?
‘আমার স্ত্রী অনুরাধা সরকার।’
‘পেশেন্ট ডিটেইল থেকে আমি অনুমান করেছিলাম। তবুও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করিনি। উনি প্রায় সুস্থ। পরশু ছুটি পাবেন।’
‘ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করতে চাইনা আপনাকে। শুধু একটাই অনুরোধ আমায় ক্ষমা করবেন।’'
আপনিই আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধনে খাটো করছেন। ‘তুমি’ সম্বোধনটাই আমার প্রাপ্য। যাইহোক, ক্ষমার কথা উঠছে কেন? আমার ক্ষমা করার অধিকার নেই। আজও আপনাকে অন্তরে শিক্ষক হিসাবেই সম্মান করি। বাকি অতীতটা আমি স্মরণে রাখতে চাইনা। আমার অতীত প্রেমকে প্রতিস্থাপিত করেছি চিকিৎসায়। সংসারি হওয়ার বাসনাও আর নেই। হাসপাতাল সংসারেই আজীবন থাকতে চাই। আসুন, পরশু আবার দেখা হতেপারে।’ বেরিয়ে আসি। চেতনে বা অবচেতনে বিদিশার পায়ে মাথাটা ঝুঁকে যায়।
সত্যি হয়
মালা ঘোষ মিত্র
অনুপম ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মুখচোরা। বাড়িতে
দিদি মনিকা তার একমাত্র আশ্রয়, বাবা অরুণ রায়, সবসময় নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ভীষণ রাগী। মা
তনিমাদেবী তো সবসময় তটস্থ থাকেন, পান থেকে
চুন খসলেই বাড়ি মাথায় করেন। অনুপম ক্লাস সিক্সে
পড়ে, খুবই ভালো পড়াশোনায় কিন্তু একটায় অসুবিধা ও সবসময় মেয়েদের পোশাক পড়তেই
ভালোবাসে, দিদির জামা, লিপস্টিক ওর খুব পছন্দ
ওর মধ্যে কেমন যেন মেয়েলি ছাপ ফুটে উঠেছে।
স্কুলে অনুপম যখন টয়লেটে যাই,, তখন একা একা যাই , ওকে মেয়েদের মতো বসে বসে
টয়লেট করতে হয়। একদিন হেডমাস্টার মশাই অনুপমকে টয়লেট করতে দেখে ফ্যালে, বেশ কয়েক
দিন ধরে ওকে লক্ষ্য করতে থাকেন। এরপর ওর
বাবাকে ডেকে পাঠান, এলে প্রচন্ড অপমান করেন,
বলেন---" আপনারা একটা নপুংসক কে আমাদের
স্কুলে পাঠিয়েছেন পড়াশোনা করতে, ওকে কাল
থেকে আর স্কুলে পাঠাবেন না, ওর জন্য আমার স্কুলের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ। ওই হিজড়াকে
ওর জায়গায় পাঠিয়ে দেন।"অরুণবাবু বাড়িতে এসে
রাগে ফেটে পড়েন, বলেন---"এখুনি ওকে বাড়ির থেকে তাড়াও, এতদিন ধরে আমি একটা হিজড়ে
পুষছি।" মমতাময়ী মা তনিমাদেবী কান্নায় ভেঙে পড়েন। অরুণবাবু বলেন---" তোমাকেই ওকে তাড়াতে হবে, নাহলে তোমারও এ বাড়ির দরজা বন্ধ।
মা কি একেবারে রত্নগর্ভা !জন্ম দিয়েছে নপুংসক।
লোকলজ্জার ভয় নেই।"
এত অপমান আর সহ্য হয় না। সন্ধ্যাবেলায় যখন অনুপম কলে হাতপা ধুচ্ছে তখন মাতনিমাদেবী একগামলা ফুটন্ত গরম জল ওর গায়ে ঢেলে দিয়ে
ফিসফিস করে বলেন-----" পালা, পালা" অনুপম এই ঘটনায় এত হকচকিয়ে যায়, সে চিৎকার করে কাঁদতেও ভুলে যায়-----। তারপর দৌড়, দৌড় আর
দৌড়। উঠোনে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকেন একজন মা।।
ভালোবাসার ফল
অজিত জানা
ছেলেটি হররোজ ফল কিনতে আসে বাজারের মোড়ে।এক একদিন এক এক রকমের ফল কেনে। প্যাকেট থেকে দু-একটা ফল দোকানী মা-কে
খেতে বলেন-মিষ্টি কি -না দেখতে বলেই ফলের প্যাকেট নিয়ে দ্রুত চলে যায়। দোকানী মা তার দেখে অবাক। মায়ের করুণ চোখে অভাবের চিহ্ন দেখে ছেলেটির মন আর্দ্রতায় ভিজে যায়। দোকানী মা ধরে ফেলেন ব্যাটার চালাকি।মা- ও ওজনের পরে দু-একটা ফল প্যাকেটে বেশি ভরে দেন। প্রতিবেশী দোকানদার জিজ্ঞাসা করেন -দিদি আপনি এমনটা করেন কেন? সটান উত্তর -অভাবের জ্বালায় আমি যে ফল খাই না, সেটা ব্যাটা বুঝতে পেরে এমনটা করে। আমিও বা কম যাই কিসে! হৃদয়ের মরুদ্যানে ভালোবাসার অঙ্কুরোদ্গমে গড়া মহীরুহ ভরে উঠেছে ভালোবাসার ফলে।
ভালোবাসা ও মন্দবাসার উপাখ্যান
কবি বনশ্রী রায় দাসের কাব্যগ্রন্থ
"আদিম স্রোতের সংলাপ"
শ্রীতনু চৌধুরী
সময়ের কথা সে বলবে। বলতে বলতে সময়কে অতিক্রম করে সমস্ত সীমারেখার ওপারে সন্ধ্যামনি ফুল হয়ে সে ফুটে থাকবে তুলসী তলায়। যুগ যুগ ধরে তার সম্মুখে অক্ষর আরতি সাজিয়ে নিমগ্ন বসে থাকবেন কবি। কেন বসে থাকবেন - তা তিনি নিজেও জানেন না ! "আদিম স্রোতের সংলাপ" লেখা কবি বনশ্রী রায় দাসও সেভাবেই বসে আছেন সেই কল্পবৃক্ষটির তলায়। আদিম অন্ধকারের স্রোত কয়েক কোটি বাঁক নিয়ে আজ যেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে তার ভাঙ্গা-গড়া, উত্থান-পতনের ভীষণ নগ্নতা আর অনুপম সৌন্দর্যের চরম বৈপরীত্যময় নিদারুণ এক ধারাভাষ্য তাঁর এই ছোট্ট কাব্যগ্রন্থটি। মহাকাব্য পুরান ইতিহাস মন্থন করে নিজস্ব মেধা মননের সংলাপে প্রতিটি কবিতার অন্তরে কবির নিজস্ব একটি বোধ জাগ্রত দেখি - তা হল ভালোবাসা! মন্দবাসাও যেহেতু ভালোবাসারই রূপান্তর তাই ইন্দ্রজালিক মুখোশে বেদনাহত কবি নির্ঘুম রাতে অর্জুন গাছের ছায়ায় বসে থাকেন কারো প্রতীক্ষায়। তিনি কিছু বলতে চান । কিন্তু বলা তাঁর হয়ে ওঠে না। তাই বলেছেন- 'কিন্তু বলবো কার কাছে-সাঁকোটা ভাঙ্গা'। এই ভাঙ্গা সাঁকোর সামনে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন এক মৃত্যু উপত্যকায়- যেখানে ছিল তাঁর ভালোবাসার ঘর বাড়ি। 'কিন্তু সেই পৃথিবীকে কেউ পেরেক ঠুকে টাঙিয়ে দিয়েছে ঘরের অগ্নিকোনে' ।
এই চরম হতাশার মাঝেও তিনি যখন লেখেন-
'বৃষ্টিকুচি মেখে রুমাল চুরি খেলছে
পৃথিবীর মতো গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে
আমার কৈশোর কাল '
-তখনই শ্মশান চাঁপার মত বিমূর্ত হয়ে উঠে ভালোবাসা। কাব্য সাহিত্যের ধ্রুপদী ব্যাঞ্জনার বাইরে কবি বনশ্রী রায় দাসের "আদিম স্রোতের সংলাপ" আসলে ভালোবাসা নামক একটি মূদ্রা, যার এক পিঠে আলো অন্যদিকে অন্ধকার, একদিকে জয় অন্যদিকে পরাজয় । আদিম নৃশংসতার সঙ্গে সভ্য আধুনিকতার যে চিরকালীন বিরোধ - এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার নির্মাণ তার সাক্ষী। তাই বিবাহের তত্ত্বের হলুদ শাড়ির নৌকার অনুরাগের ভাঁজ একদিন আলগা হয়ে গেলে 'ফোঁস করে ওঠে শুকনো রক্ত মাংস' । তখন একটি সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার যে আকুতি তা থেকেই কবি লেখেন- 'কী করে বাঁচাবো এখন মৃতসঞ্জীবন' ! আসলে সেই সুধা বা অমৃত যা কিনা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলে তাও এখন যে ভীষণ রকম বিপন্ন বা দুষ্প্রাপ্য সে কথাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন কবি। সেরকমই 'সম্পর্কের জল ও পাথর' কবিতায় আদিম স্রোতের তীব্রতা এত গভীর যে ছাদ বাগানে নক্ষত্রপরীর চন্দনচর্চিত হবার কোন অবকাশই নেই। তাই কবি লেখেন -
'সম্পর্কের মানে খুঁজে না পেয়ে চলেছি
রক্তাক্ত নিষেকের দিকে'।
তারপরেও গান্ধারে শূন্যের তালিকা নিয়ে যতই ঝুলে থাক বিষন্ন পিয়ানো, তার হৃদয় বাউল ফাঁকা মাঠে খুঁজে ফেরে মনের মানুষ। আসলে কবির মনের কোণে পরশপাথর অন্বেষী যে লালন বাস করে সে আমাদের উন্মুক্ত নয়-জানালা দিয়ে কবিতার মাধ্যমে সৃষ্টি করে চলে নিজস্ব রসের রসিক। বাউলমন তো এমনই- আলখাল্লার পরিবর্তে তাই যখন তিনি লেখেন- 'আমরা কেবল শরীর পরে থাকতে অভ্যস্ত', তখন তিনি অজান্তেই তার নিরাকার দ্বৈত আত্মা বা চেতনার উপর শরীর নামক ষড়রিপুর অবয়ব পরিয়ে গড়ে ফেলেন যাকে, তা আর কেউ নয় - একটি নিরেট মানুষ । সে মানুষও যুগ যুগ ধরে হতাশা আর বিষাদের অন্ধকারে নিমজ্জিত । চরম ক্রূর পঙ্কিল এক আবহের মধ্যে লেখা 'বিষাদ সিন্ধু' কবিতায় তখন দেখতে পাই তীব্র শ্লেষ -
'যুদ্ধ শেষে তাহাদের পাতে বেড়ে দিও অভাবে
অস্থির নৈবেদ্য, যারা নিজেদের ভগবান ভাবে। তেমনই আবার 'আনমনা উড়ান'এর- হিংসা হানাহানি, 'অক্ষরের অশ্রু'র- অন্ধ পৃথিবী জুড়ে শীতলতা পেরিয়ে কবি তার দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পান- 'নিশ্চয়ই একদিন বিন্নি ধানের খই
ফুল হয়ে ফুটবে নব কুঞ্জের জীবন ডাঙ্গায়'
আর সেই দিনের অপেক্ষায় সমস্ত দ্রোহকাল পেরিয়ে সবশেষে তিনি বলতেই পারেন- '
'বহুকাল ধরে সুগন্ধি এই বুকের ভিতর সযত্নে গুছিয়ে রেখেছি এক টুকরো সূর্যকিরণ'
বা
'সাঁতার আঁকবো ওই ঠোঁটের উপত্যকায়
তারপর একসাথে ডুবে যাব দুধ- সরোবরে'
আদিম স্রোতের হলাহল মন্থন করে মন্দবাসা আর ভালোবাসার এমনই চরম দ্বান্দিকতা ভাষ্যকারের নিষ্পৃহ কথনে আবহমান স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে দুধ সাগরে ডুবে যাওয়া এই যে পুণ্যস্নান - এখানেই এই কাব্যগ্রন্থের স্বার্থকতা। যেখানে 'কবিতা বিভোর রাত'এর মতো একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা ঈশ্বরের চোখের দিকে তাকিয়ে আমাদের শুনিয়ে যায়-সূর্যাস্তের উদ্বৃত্ত ভাষা। একটি দু-ফর্মার কাব্যগ্রন্থ থেকে এর চেয়ে অধিক প্রাপ্তি আর কী হতে পারে ?
শব্দ ও ভাষা নির্মাণের অদ্ভুত কৌশল কবি বনশ্রী রায় দাসের করায়ত্ব- তা আমরা জানি, তবু তার নব নব উদ্ভাবনে আশ্চর্য হতে হয় বৈকি! তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেখানেও সংযম দাবি রাখে । যেমন মহাকাব্যিক এবং চিরায়ত কাহিনীর উল্লেখে আরো তথ্যনির্ভর এবং যত্নবান হওয়া উচিত ছিল, যাতে পড়তে গিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত না হতে হয় । এমন সুন্দর সুখপাঠ্য একটি কাব্যগ্রন্থে এরকম ছোটখাটো অসঙ্গতি এবং বানান বিভ্রাটের দায় প্রকাশকও কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারেন না। কারণ দিনের শেষে কবি এবং পাঠকের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র তো তিনি'ই । এসব সত্ত্বেও বইটির নিগূঢ়-পাঠ পাঠক সমাজে আলোচিত ও সমাদ্রিত হবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
0 মন্তব্যসমূহ