সম্পাদক: নীলোৎপল জানা
nilotpaljana1978@outlook.com
সম্পাদকীয়
বাঙালির valentine's
সরস্বতী পুজো বাঙালির আবেগের পুজো। বাঙালি মাত্রেই সরস্বতীর কাছে হাতে খড়ি দিয়েই শিক্ষার শুরু করেন। তারপর কচি-কাঁচারা স্কুলে পা দেয়। এরপর থেকেই অন্য এক জীবন শুরু হয়। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি বাড়িতে সরস্বতী পূজার দিন পাড়ার কচি-কাঁচাদের নিয়ে বাবা মায়েরা আসতেন হাতে খড়ি দেওয়ার জন্য। এছাড়া সরস্বতী পূজায় বাচ্চাদের একটা আলাদা উন্মাদনা আছে। সেই উন্মাদনায় আমিও মেতে থাকতাম। সকাল থেকে উঠে কলাপাতা কেটে, ফুল তুলে স্কুলে যেতাম । সেখানে পুষ্পাঞ্জলি দিতাম।
আবার একটু বড় হতেই বাড়িতে পুজো করতে শুরু করলাম; তারপর বাড়ির পুজো শেষ করে স্কুলে যেতাম। সারাদিন হৈচৈ করতাম বন্ধুদের সঙ্গে। সেই দিনটা যেন আমাদের ব্যক্তিগত। কেউ কিছু বললে শুনতাম না। তারপর কোনো কোনো স্কুলে আবার পরের দিনই পুজোর খাওয়া-দাওয়া হত। তাতে সারাদিন কচি-কাঁচারা ব্যস্ত থাকত। সরস্বতী পুজোর দিন বিশেষ করে মেয়েরা প্রতিমার মতো সেজে আসতো। দেখতে সুন্দর লাগত। কলেজে এসে বুঝতে পারলাম এই সরস্বতী পুজো বাঙালির কচি-কাঁচাদের কাছে valentine's dey. এ যেন ভালোবাসার দিন। এই দিন কলেজের ছেলে-মেয়েরা তাদের ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে নিতে দেখেছি; যদিও আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি।
এখন প্রেম আছে কিন্তু আর সবই স্মৃতি। এখন
যেটা দেখা যায় তা অন্যরকমের । হাতে মোবাইল পেয়েই প্রেম করতে শুরু
করে ছেলে-মেয়েরা। আজকের দিনে সেই সরল উন্মাদনা নেই সরস্বতী পূজায়। বহু ছেলে মেয়েই সরস্বতী পূজার
পুষ্পাঞ্জলির কথাই জানে না। আর জানলেও পুষ্পাঞ্জলি দেয় না বরং বান্ধবীকে নিয়ে, বন্ধুকে নিয়ে গড়ের মাঠে, স্টেশনে,রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে সারাদিন আড্ডা দেয়; আর মোবাইলে
সেলফি তুলে ফেকবুকে পোস্ট করে। ফলে আমাদের সময়ের পুজো আর বর্তমান সময়ের পূজোর
তফাৎ ঘটে গেছে। এখন মোবাইলেই সরস্বতী আরাধনা শেষ হয়। স্কুলে বা কলেজে গিয়ে
প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেকবুকে পোস্টের মাধ্যমে ।
ভলোবাসা-বাসী আছে কিন্তু কোথায়
গেল বাঙালির সেই আবেগ! এই সরস্বতী যেন ভালোবাসার দেবীতে পরিণত হয়েছে। আরো কত কী যে দেখতে হবে তার ঠিক নেই।
অণুগদ্য
বিদ্যা না কি প্রেম ?
রুমকী দত্ত
"ওঁ
জয় জয় দেবী চরাচর সারে,
কুচযুগ
শোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত
পুস্তক হস্তে,
ভগবতী
ভারতী দেবী, নমোহস্ততে।"
ছোটবেলায়
যখন পুষ্পাঞ্জলি দিতাম অন্ধের মতো চোখ বন্ধ করে ফুল নিয়ে করজোড়ে ভক্তি ভ'রে
ঠাকুর মশাইয়ের শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্র উচ্চারণ করেছি, মন্ত্রের মানে বোঝার চেষ্টাও
করিনি কোনোদিন।
আবহাওয়া
পরিবর্তনের সাথে সাথে কেউ এসে একদিন কানে কানে বলেছিল "কুচযুগ মানে
জানিস?"
আমি
সহোৎসাহে মাথা নেড়েছিলাম,বৌদি কানে কানে বলে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল কারণ সেও নতুন
জেনেছিল অর্থটা।আর আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিলাম আরো একবার!
"কুচযুগ
শোভিত মুক্তাহারে" অর্থাৎ দেবীর স্তনযুগল মুক্তার হার দ্বারা সজ্জিত...
অল্প
বয়সে সেই কথায় মনে বিস্ময় জাগলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে মনের সংশয় বিশ্বাসে
পরিণত হয়েছিল এটা সত্য না।
অনুসন্ধিৎসু
মন নিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম,যেটা পেলাম সেটাই বাক্ দেবী আরাধনা
মন্ত্রের "কুচযুগ"র উপযুক্ত ব্যাখ্যা....
সংস্কৃত
ব্যাকরণ অনুসারে “কুচযুগশোভিত” তে ৩টা শব্দ যুক্তাক্ষরের দ্বারা যুক্ত আছে৷ যথা –
কুর্চ+যুগঃ+শোভিত এখানে “কুর্চ”অর্থ বৃদ্ধা ও মধ্য অঙ্গুলীর অগ্রাংশ,
"যুগ" অর্থ দীপ্তিময়, (শোভিত) শোভাবর্ধক, (মুক্তাহারে) মুক্ত মালা
দ্বারা।
কুর্চ
শব্দের “রেফ” টি যুক্তাক্ষরের সময় লোপ পেয়ে হয়েছে “কুচযুগ”,আর এখানেই যত
বিপত্তি।
এই
বার সব কিছু সুন্দর ও ঠিকঠাক।
"ওঁ
জয় জয়....নমোহস্ততে।"অর্থাৎ পরম আত্মারূপী দেবীর জয়,তিনি সর্বব্যাপী,দুই
হাতে ধরা বীণা,এক হাতে পুস্তক আরএক হাতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট ও মধ্যমা অঙ্গুলি দ্বারা
ধরা দীপ্তিময় মুক্তার মালা,সেই দেবীকে করজোরে প্রণাম"
আমরা হিন্দু, মাঘমাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথি আমাদের কাছে বড় আনন্দের বড় আবেগের। যেদিন বালিকা থেকে কিশোরী হয়েছিলাম মনে আছে সেবার সরস্বতী পূজায় মায়ের একটা আকাশ নীল রঙের শাড়ি পরেছিলাম।মাথায় নামি কোম্পানীর শ্যাম্পু করেছিলাম।মা সাজিয়ে দিয়েছিল সুন্দর করে, ঠোঁটে লিপস্টিক, ছোট্ট টিপ, হাত ভর্তি কাঁচের চুরি...আমাদের বাড়িতে থাকতেন ঠাকুমার বয়সী দুর্গার মা, তিনি বলেছিলেন "একদম রাধার মতো লাগছে", কথাটা শুনে বেশ মজা পেয়েছিলাম। এখন মনে হয় সেই রাধাও কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমেরই আর এক নাম।
আমার
বাবা ছিলেন গ্রামের মাস্টারমশাই,পাড়ার দাদারা সম্ভ্রমের চোখে দেখতো।
মনে
মনে অনেকেই প্রেম নিবেদনে আগ্রহী ছিল কিন্তু সামনে বলার সাহস কারোর ছিল না। এটা
বেশ বুঝতাম।
যাই
হোক পুষ্পাঞ্জলি পর্বের শেষে যখন ঠাকুরের পায়ে অঞ্জলি দিতাম তখন দুই একটা ফুল
গায়ে মাথায় এসে পড়তো।
ভাবতাম
ঠাকুরকে ছুঁড়তে গিয়ে হয়তো নিশানার ভুল আর যুক্তি দিয়ে বুঝতে গেলে হয়তো ইচ্ছে
করেই কেউ তার মনের মানুষকে ফুল ছুঁড়ে মারতো,সেই সমাধানে আজ আর নাইবা গেলাম। তবে
একটা কথা জোর দিয়েই বলা যায় সরস্বতী পুজো বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস' ডে!
পুজোর
পরে একবার প্রসাদ চুরি হয়ে গেল, বালতি সমেত প্রসাদ ছিল পুজোর প্যান্ডেলে, দুপুরে
দেখা গেল বালতি ফাঁকা। এক অদ্ভুত কাণ্ড, কে খেল?সবাই যখন এই আলোচনায় ব্যস্ত
সন্ধ্যায় এক জনের প্রচন্ড পেটের যন্ত্রণা ও ঘন ঘন বাহ্যে শুরু হল, প্রসাদ চোর কে
বুঝতে আর কারো বাকি রইল না! শুরু হল সকলের হাসির ধুম।
মনে
আছে এক বছর বিসর্জনের রাতে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা রান্না করেছিল পাড়ার কাকিমা
জেঠিমারা। মাইকেও সে কথা ঘোষণা করা হয়েছিল "আনন্দ সংবাদ
আনন্দ সংবাদ আজ ঠাকুর বিসর্জনের পর আমাদের ভজহরি সংঘের পক্ষ থেকে খিচুড়ি আর ডিম
ভাজা খাওয়ানো হবে, সকলের আমন্ত্রণ"
সেই ঘোষণায় আমরা এত মজা পেয়েছিলাম সেটা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এখনো পুজো আছে কিন্তু আগের মতো আবেগ আনন্দ উৎসাহ উদ্দীপনা আর নেই। সংসার করতে করতে কবে যে ছোটবেলা হারিয়ে গেল, কবে যে মায়ের মতো বড় হয়ে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।
না পাঠানো চিঠি
কৃষ্ণাংশু মাকুর
প্রিয় মন,
কেমন আছ? হটাৎ করে চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল
খুব। আসলে বছর ঘুরে সরস্বতী পুজো, বাসন্তী রং, অঞ্জলি সুবাস এলে মনটা কেমন
ওলট-পালট হয়ে যায়। কেন যে এত কথা কোথা থেকে উজিয়ে আসে বুঝতে পারি না। অনেক কথা
বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বলতে পারি না। তখন লিখতে ভালো লাগে। আর সে কথা লিখতে গিয়ে
খূলে যায় মনের হাজার জানলা। জ্বলে ওঠে সাতমহলা বাড়ির ঝাড়বাতির রং-বেরংএর আলো।
যার ভেতরে একটা বাসন্তী রঙা শাড়ি পরা চতুর্দশী অঞ্জলি দেয়। তার চাপাকলির মতো
আঙ্গুল ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে তুলে দেয় ছেলেটির হাতে। সে যেন তার স্বীকৃতির অঞ্জলি।
বারবার ভুল হয়ে যায় ছেলেটির মন্ত্র উচ্চারণে।মনে মনে বলে, ঠাকুর ক্ষমা করে দিও।
জানো মন, জলের বুকে যখন ছোট্ট ডিঙিটি
ভেসে চলে তখন তার আশেপাশের জল কেবল ডিঙির পেছনে পেছনে ছুটে চলে। যেন তাকে ছুঁতে কী প্রবল আকুলতা! কিন্তু ডিঙিটি ঠিক সামনের জল কাটিয়ে তরতর করে এগিয়ে
চলে। ভাবছ কী সব আবোল - তাবোল লিখছি? ও তোমার বুঝে কাজ নেই! তবে ওই বয়সে যে মন
কেমন করে, ভীষণ হিংসে হয় শুধু বুঝেছিলাম। যখন জানলাম তোমার ওই আলো সাজ, তোমার
সম্মতি, ভালোবাসা সব আমার প্রিয় বন্ধুর জন্য
সন্তর্পনে নিবেদিত, তখন ভীষণ অপরাধী মনে হয়েছিল নিজেকে। আমার দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে
পড়েছিল সারা ক্লাসরুম জুড়ে, বেঞ্চ জুড়ে, তোমার স্কুল ব্যাগ জুড়ে, চারপাশ জুড়ে
।তারপর অনেকটা পথ কীভাবে যেন পিছলে চলে গেছে। এতদিন পরে এ চিঠি আমার বহ যত্নের
বকুল মাল্য ভেবে নিও, নয়তো একান্ত যাপনলিপি।হয়তো তুমি কোনদিন জানলে না সরস্বতী
পুজোর রাতে আমার প্রিয় বন্ধুর দেওয়া গোলাপের কুঁড়িটি যে ছিল আমারই দেওয়া। তবু
আমি সেই কৈশোরের শিউলি ভোরে কুড়িয়ে রেখেছি আমার নিরালা প্রেমের স্নিগ্ধ স্বীকারোক্তি
টুকু। যদি কোনদিন পথভুলে এ পথে এসে থাক...!
খু-উ-ব ভালো থেকো। এটা শুধু প্রলাপ
ভেবে নিও। তবে সরস্বতী পুজোয় বাসন্তী রঙের শাড়িটা অবশ্যই পরো। ভালাবাসা এই চিঠির
মতো তোলা থাক একান্ত গোপনে।
অনবরত মনকে ছুঁয়ে থাকা,
-- সেই ছেলেটা।
সরস্বতী
শংকর সামন্ত
‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে
বিশ্বরূপে
বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহী নমহস্তুতে’
সরস্বতী ভারতীয় বংশদ্ভূত একটি মেয়ের নাম। যার অর্থ - শিক্ষা, জ্ঞান, সংগীত এবং শিল্পের দেবী। সংস্কৃত শব্দ "সরস্বতী" থেকে উদ্ভূত, যা - "প্রবাহিত ধারা বা নদী"। "সরস্বতী" - সরস বা জল, তাই সরস্বতী শব্দের অর্থ - জলবতী বা নদী।
অনেক পন্ডিতগণ
মনে করেন - "সরস্বতী" প্রথমে নদী, পরবর্তীকালে দেবীরূপে পূজিত হন। অনেকে
মনে করেন - এই পূজা বসন্ত আগমনে হয় বলেই - "বাসন্তী পঞ্চমী উৎসব" নাম খ্যাত।
পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারতীয়দেরকেও প্রভাবিত করে।
শাস্ত্রীয়
বিধানানুসারে শ্রী পঞ্চমীর সকালেই দেবীকে সজ্জিত করে নানা উপকরণে পূজিত হন। "সরস্বতী" - হিন্দু বিদ্যা ও সংগীতের
দেবী, হিন্দু ধর্মে - জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞা ও বিদ্যা অর্জনের দেবী।
"সরস্বতী" কে বেদের জননীরূপে কল্পনা করা হয়। তাই পুরাণানুসারে - এই তিথিতেই
ব্রহ্মার মুখ থেকেই বিদ্যা ও বুদ্ধির দেবী "সরস্বতী" এর উৎপত্তি মনে করা
হয়।
মাঘ মাসের
চান্দ্র শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে পূজা হয় - সরস্বতী, শ্রী পঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নাম
খ্যাত । এই পূজা শ্রী পঞ্চমীতে - শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠানে, ছাত্র ছাত্রীদের গৃহে, সার্বজনীন
মঞ্চেও দেবী পূজিত হন। সমগ্র উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ,
উড়িষ্যা, নেপাল, বাংলাদেশে প্রবল উন্মাদনা সহকারে পূজিত হন। এছাড়াও ভারতবর্ষের বাইরে
জাভা,বালি দেশেও সমধিক পূজিত। ভারতবর্ষের শিখ, জৈন রাও পূজা করেন। ধর্মপ্রাণ হিন্দু
পরিবারে শিশুদের হাতেখড়ি, এমনকি পিতৃতর্পন করে থাকে।
পঞ্জিকার
নির্ঘন্ট মেনে প্রতি বৎসরই শ্রী-পঞ্চমীর দিনই একটি ধোয়া চৌকির উপর ধোয়া নতুন বস্ত্র
পেতে দোয়াত, কলম, তালপাতার ওপর লেখনী, বই, সংস্কৃত গ্রন্থ, স্লেট, সঙ্গে একটি সরস্বতীর
ফটো বা প্রতিমা রাখা হয়। মাটির ঘটে স্থাপন করা হয় - যাহাতে থাকে - একটি সিক ডাব, পঞ্চপল্লবের
উপর স্থাপন করা হয়। শিকডাবের শিখিতে একটি হলুদ গাঁদাফুল দেওয়া হয়। ঘটে গলায় দূর্বাসহ
একটি মঙ্গলসূত্র বাঁধা হয়। প্রতিমায় বা ঘটে হলুদ গাঁদা ফুলের মালা দেওয়া হয়। প্রতিমার হাতে থাকে বীনা, পরনে হলুদ পাড় যুক্ত শ্বেতবসনা,
অন্যহাতে বই, লেখনী বা কলম। ঘট পুজো হলে পঞ্চপাচারের পুজো, প্রতিমা সহযোগে পুজো হলে
- ষোড়োশপাচারের পুজো বলে, - সঙ্গে থাকে বাহন হাঁস, এইভাবে সুসজ্জিত করে পূজার্চনা শুরু
হয়। বাসন্তী রঙের হলুদ গাঁদা ফুল, বেলপাতা, তুলসী, দূর্বা, বাসন্তী রঙের আবির সহ, আতপ
চালের নৈবেদ্য দিয়ে ধুমধামের সহিত পুজো করা হয়। শিক্ষানুরাগী, ছাত্র-ছাত্রী, মহিলা-পুরুষ,
লেখক, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী নির্বিশেষে সকলেই দেবীর আরাধনা করনে। পূজান্তে
অঞ্জলি প্রদান ও মনোস্কামনার জন্য সকলে ভক্তিভরে প্রণাম মন্ত্র দিয়ে প্রণাম করেন।
সরস্বতী
সাধারণত - দ্বি-ভুজা ও চতুর্ভূজা হয়ে থাকে।
দ্বি-ভুজা মূর্তির হাতে থাকে - বীনা, পুস্তক, অথবা লেখনী/কলম ও পুস্তক। চতুর্ভূজা
হলে থাকে - পুস্তক, অক্ষমালা, সুধা কলস ও বীনা, এছাড়াও বিভিন্ন সাজসজ্জা, উপাচার দিয়ে
সাজানো হয়।
পূজান্তে
চিড়ে ও দই মিশ্রিত দধিকরম্ব বা দধিকর্মা দিয়ে সমাপন ও বিসর্জন হয়।
এই পূজা
খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বি সি থেকে ১৫০০ এ ডি, মধ্যযুগীয় ও প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য সংস্কৃতিতে
দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
দেবী সরস্বতীকে
- সারদা, ইলা, শতরূপা, মহাশ্বেতা, বীণাপানি, বীনাবাদিনী, ভারতী, বাগ্দেবী নামেও ডাকা হয়।
দেবী বৈদিক
হলেও বর্তমান রূপটি, পুজোর পদ্ধতি আধুনিক কালে প্রচলিত। তবে বৈদিক যুগ থেকে আধুনিক
যুগ পর্যন্ত সরস্বতী তথা সরস্বতী দেবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপিরিসীম।
দেবী সরস্বতী - নদী সরস্বতী
পুষ্প সাঁতরা
সরস্বতী জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী- তিনি শান্ত স্বরূপা,সুশীলা, সত্ত্বসরূপা,হরিপ্রিয়া,তিনি কন্ঠে সুর ও স্বর দেন।পুরাণে বর্নিত ব্রহ্মাই প্রথমে সরস্বতীকে পুজা করেছেন। তারপর ত্রিভুবনে দেবতা ও পরে মর্তে পুজা প্রচলিত হয়।আসলে সকল দেবদেবী কৃষ্ণের কোষকলা থেকে সৃষ্টি,কিন্ত আমরা অবগত যে ,সরস্বতী শিব পার্বতীর কন্যা হিসাবে।কিন্ত পুরাণ অন্য কথা বলে, বাগদেবীর সৃষ্টি হয়েছিল ব্রহ্মার মুখগহ্বর থেকে,ব্রহ্মা ধ্যানে বসার পর,ব্রহ্মার সব ভাল গুন গুলি একত্রিত হয়ে ,এক নারীর আকার নিতে থাকে তিনিই দেবী সরস্বতী!
ব্রহ্মার
প্রথমে একটি মুখ ছিল কিন্ত সুন্দরী সেই দেবীকে দর্শন করার জন্য আরও চারটি মুখের সৃষ্টি
হল।তবে পুরাণ মতে ব্রহ্মা বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করলেও তিনি নিজেকে নিয়ে খুব একটা
সন্তুষ্ট ছিলেন না, সরস্বতীই তাঁকে উপদেশ দিলেন,
বিশ্ব ব্রহ্মান্ড কে কিভাবে সুন্দর রাখা যায়।সে যাই হোক পুরাণ অনুসারে বসন্ত পঞ্চমীতে
সরস্বতীর জন্ম। সরস্বতী সকল বেদের মা বলে মনে করা হয়।ব্রহ্মা নাম দেন বাগ্ দেবী! সকল
শব্দ আর ভাষার উৎপত্তি তাঁর জিহ্বায় - কন্ঠে! পূর্ব ভারতের অনেক জায়গাতেই সরস্বতীকে
শিব- পার্বতীর কন্যা বলে মনে করা হয়।
সরস্বতী
শুক্লবর্ণা ,পীতবস্ত্রধারিনী,এবং বীনা পুস্তকহস্তা।মানব সভ্যতার প্রাচীন তম গ্রন্থে
ঋগ্বেদে প্রথম দেবী সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়।সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে--- সরস্বতী
শব্দ টি সরস্ ও বতী শব্দের সন্ধি।ঋকবেদের দ্বিতীয় মন্ডলের এক চল্লিশ তম সুক্তের ষোলতম
শ্লোকে বলা হয়েছে 'অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী'--- যার অর্থ সরস্বতী মাতাদের
মধ্যে, নদীদের মধ্যে, ও দেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এ ছাড়াও ঋকবেদে একাধিক জায়গায় সরস্বতীকে
নদীর দেবী হিসাবে বর্ননা করা হয়েছে।আবার পন্ডিত রা মনে করেন--- দেবগুরু বৃহস্পতির
সঙ্গে বিবাহের পর ,জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী হিসাবে পূজিত হন।বেদের বর্ণনা অনুযায়ী বীনা-
পুস্তক- পদতলে রাজহংস,কমলে পা রেখে মর্তে আসেন দেবী! সরস্বতীর একশত আটটি নাম।
প্রাচীন ভারতের শিক্ষা কাঠামোয় ব্রাহ্মণের
আমৃত্যু অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা ছিল শাস্ত্র শাসিত ,জ্ঞানের নিত্য সাধনায় হত মনের নিত্য
মার্জনা,এই জ্ঞান ও মনের নিয়ন্ত্রক হিসাবে সে যুগে কল্পনা করা হত এক দেবী বা শক্তিকে,কালক্রমে
তিনিই হন মূর্তিমতি জ্ঞানের দেবী।শুধু ভারতবর্ষ নয়,গ্রীক পুরাণেও জ্ঞান ও শিল্প কলার
দেবী হিসাবে দেবী এথেনা আর রোমান পুরাণে মিনার্ভাকে বিদ্যা ও সংস্কৃতির দেবীরূপে কল্পনা
করা হয়েছে।ঋকবেদে সরস্বতীকে 'অম্বিতমে দেবী তমে নদী তমে -- বলে সম্বোধন করা হয়েছে
,সরস্বতী নদীর তীরে ছিল ঋষিদের বাসভূমি ।তাই সরস্বতী দেবী বৈদিক যুগের শক্তি নদী।
পুরাণের
যুগে এসে হলেন জ্ঞান ও বিদ্যার মূর্তিমতী দেবী সরস্বতীতে ,শুরু হল সারস্বত বন্দনা,পুজার
প্রশস্ত তম তিথি হিসাবে বিবেচিত হল মাঘ মাসের শুক্লানবমী,ঋতু চক্রের আবর্তনে শীতের
জড়তার অবসানে ধরনীর দ্বারে এল মধুময় বসন্ত, তাই নাম হল বসন্ত পঞ্চমী!জ্ঞান মানে আলো
,দেবী জ্ঞানের আলোর পথ দেখান, আমরা শিক্ষার দ্বারা আলোকিত হই।'তমসো মা জ্যোতির্গময়
'--- অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে জ্ঞানালোকে উত্তরণ,এই জ্ঞান বা বিদ্যা দেয় অমৃত লোকের
সন্ধান।
এই ভগবতী
সরস্বতী আমাদের নিয়ত রক্ষাকারিনী আমাদের জ্ঞান ও সুরের ভুবনে অধিষ্ঠিতা ---
ভদ্রকাল্যৈ নম নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো
নমঃ
বেদ বেদান্ত বেদাঙ্গ বিদ্যাস্থানেভ্য
এব চ।।
সরস্বতী পুজো এবং বতর্মান ট্রেন্ড
কবিতা সামন্ত
‘জয় জয় দেবী চরাচরসারে
কুচযুগশোভিত
মুক্তাহারে
বীণা পুস্তক
রঞ্জিতহস্তে
ভগবতি ভারতি
দেবি নমস্তে।’
সরস্বতী
পুজো,সরস্বতী বলতে যা আমরা একসময় জানতাম বা বুঝতাম শিক্ষা সংস্কৃতির বিশেষ করে বিদ্যার
দেবী,বাক দেবী,শুভ্রতার দেবী। একেবারেই ছোট বাচ্চা থেকে বড় সবাই সরস্বতী দেবীর আরাধনা
করে। বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়ারা তো সারা বৎসরের মধ্যে এই দিনটার জন্যই অধীর আগ্রহে থাকে।
স্কুলের মিটিংয়ে উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের ওপর থাকত দায়িত্ব।
সেসব দিন বতর্মানে বদলেছে। বর্তমানে আধুনিকতার হাওয়ায় যেমন বদল হয়েছে সরস্বতীর দেবীর মূর্তির আদল তেমনই সরস্বতী পুজোও কেমন যেন একটা ফরম্যালিটি হয়ে গেছে। কথায় আছে 'দেখা দেখি চাষ আর লাগা লাগি বাস' সেই হয়েছে দশা। মানুষের রুচি বদলাচ্ছে নাকি রুচি কুরুচিতে পরিণত হচ্ছে তা নিয়ে সন্দেহ হয়! নিজ দেশের সংস্কার,শিক্ষা,আচার,বিচার দিন দিন যেমন দীন দরিদ্র হয়ে পড়ছে ঠিক তেমনই রঙে ঢঙে সাজিয়ে তুলছে দেব দেবী মূর্তিও।
দেখে ভক্তির থেকে বেশি হাস্যকর হয়ে উঠছে। আর ছেলে মেয়ে থেকে বড় বুড়ো এমনকি শিক্ষক সবাই বতর্মানে ফোনে এতটাই ব্যস্ত যে এসব বিষয়ে কারো তেমন আগ্রহও নেই। ওই দায় সারা কাজের মতো। করতে হয় তাই করা। সরস্বতী পুজো মানেই ভ্যালেন্টাইন ডে। পুজো অঞ্জলি ছেড়ে সেলফি থেকে প্রোপোজ করা ঘোরাফেরা এটাই বতর্মানে ট্রেন্ড। সেযুগেও যে একদম ছিলনা তা নয় কিন্তু। তবুও লোকলাজ বা চক্ষুলাজের একটি বিষয় ছিল বা বড়দের দেখে ভয় বা সম্মান ছিল।
তাই পুজোটা পুজোর মতোই মনে হতো। বতর্মানে যা মনে হয়না। কোথাও কোথাও হয়তো সরস্বতী প্রতিমা প্রতিযোগিতামূলক হয়ে থাকে তবে অধিকাংশই পুজো বতর্মান ট্রেন্ড ছাড়া আর কিছুইনা। দেবী দেবতার মূর্তি বিকৃতি বা আধুনিক মানব রুপ,পোশাক এসব দেখে ভয় হয় ভারতীয় সংস্কৃতির অবনতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে। কিছু কিছু ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া যা হয়তো গোনাগুনতিতে পড়েনা। সিংহভাগের কাছে চাপা পড়ে যায়।
কবিতা
সরস্বতী
গৌরশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
তোমাকে অরচিত রেখে
কোনো অক্ষর
কখনো লিখিনি
দুহাতে কি
তুলে দেবো
নির্ঝর শব্দের
অভিসার
যে ফুল রেখেছি
প্রণত চরণে
তুমি সরস্বতী
মহাভাগে কমললোচনে।
প্রেম ও প্রথম ভাগ
বিকাশ চন্দ
প্রজন্ম গহ্বর ছিঁড়ে এক বগগা কালিদাসের মতো নয়
দুকান খাড়া ভিতু খরগোশের মতো অমলিন
দূরত্বে দাঁড়াই
সাদা রাজহাঁস ডানা ঝেড়ে জল ঝরালে
সেই যে শুরু জবা সঙ্কাশ ভোর
বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজতে নিরন্তর
পূর্ণ ঘটে আমের শাখায় শিক ডাবে ঢালছি
জল আজও
ফুলের স্পর্শে সেই যে শুরু " সরস্বত্যৈ নমো নিত্যং... "
অবিনশ্বর অক্ষর-ফুল ঝরে পড়ছে নিরন্তর
কবরে শ্মশানে আমাদের আশাহত নিঃশ্বাস
সকল শংসাপত্র উড়ে যাচ্ছে রাজহংসী ডানায়
আশাহত প্রশ্বাসে সচকিত বীণার ঝংকারে
শুক্লা পঞ্চমী
চাঁদ মালায় দোলে নানারঙে সকল বর্ণমালা সর্বশুক্লা দিনে
মেঘাচ্ছন্ন সময়ে আকশে ঝুঁকে আছে পঞ্চমী
চাঁদের ভাগ্য
তবুও প্রসন্ন পরিসরে পাশাপাশি হাঁটে
চিরায়ত প্রেম ও প্রথম ভাগ
হারানো প্রেমের মূর্ছনা
সুধাংশুরঞ্জন
সাহা
আজ আর মায়ের আদর
বাবার অপেক্ষা
নেই
গাছ জানে
গাছের শাখাপ্রশাখা জানে
জানে পাখি
এবং পাখির উড়ান
পাহাড় আর
চা বাগান পেরিয়ে
নদীতে পা
ভুবিয়ে বসলে
জলের সরলতা
ও মাটির নৈকট্য টের পাই
ফেব্রুয়ারি
মাস মুখ তুললেই
দূরে কোথাও
চেনা সেতার বেজে ওঠে
সেকি বাগদেবীর
আবাহন
নাকি হারানো
প্রেমের মূর্ছনা ...
চুপ
বিধানেন্দু পুরকাইত
পূর্ণিমা স্নানে গেছে মেঘবতী চাঁদ
হলাহল মেখে খায় পাড়ার গোঁসাই
কটা কবুতর গম খুঁটছে দাওয়ায়
মৌসুমী হেঁকে বলে নাই সেথা নাই।
মেঘবতী
চুল ন্যাড়া করেছে মেয়েটি
বাস্তু ঘুঘুর দল নটে শাক নাড়ে
আসলে চোখের কোণে জমেছে পিছুটি
ভাঙবার ভয়ে চুপ নিজ সংসারে।
পূরবীর বুকে ভৈরবী
অর্ণব সামন্ত
সন্ধ্যের সেঁজুতি জ্বালার আগে যদি
আচমকা কোনো সকালের মুখ হানা দেয়
আয়না তখন মুখ দ্যাখে একা একা
দ্যাখে গহীনে গহীনে তার কত গাঙ ও আগুন
নীলাভ অন্ধকারে নক্ষত্রদের ছড়াছড়ি
নক্ষত্রের ফুলজন্ম ঝরে পড়ে পথপ্রান্তে
, মাটিতে
দেরাজ থেকে টেনে বার করে সেই
জাদুবাস্তবতা
আগুন খুঁটিয়ে দ্যাখে আর ভাবে
পরম সভ্যতা চরম অসভ্যতার সেই সব যৌবন
দিনরাত্রিগুলি
স্মৃতির বকুল হয়ে তারা বিলীন হয়েছে
অন্য ছায়াপথে
শুধু সৌরভ এখনও যেন নাকে লেগে আছে
সুর মিয়া মল্লারে কাঁপাচ্ছে চারপাশ
ও আকাক্ষা তুই হৃদয়ে আন উচ্ছ্বাস
বাঁধভাঙা সে নিয়মে অন্য নিয়মের
চাষবাস
স্মৃতি যেন মোমবাতি আগুন দরজায় কড়া
নাড়ে ভবিষ্যৎ আঙুল
বর্তমান দ্বিধাগ্রস্ত তাকে নেবে না
ফেরাবে একেবারে
মণি নিবদ্ধ মণিকর্ণিকায় শ্মশানের
চিতাগ্নি ছুঁয়ে জাগে
পূরবীর বুকে জাগে ভৈরবী আরেক বার পেতে
চায় জীবনের স্বাদ !
সাক্ষী
অরবিন্দ সরকার
তোমরা আমার প্রতিদিনের এই সংলাপের সাক্ষী
আর কেউ না থাক চাঁদ থাকবে
আকাশের নক্ষত্রবা কিছুটা সময় করে দেবে
নারকেল বীথিরা বলবে চালিয়ে যাও
বদ্রীপাখি ওকে বলবে এভাবেই উৎসারিত কথা
বলো
শান্ত জোনাকি হাঁক দেবে মৃদুতায় জোর
সে
এভাবেই কথা বলতে বলতে চলে যাবো দুজনে
গহনে
খুঁজতে থাকব
খুঁড়তে থাকব
এভাবেই চলতে চলতে কবিতায় এসে যাব
অন্বষণের শিকড়ে পৌঁছে যাব একদিন অতলান্ত বৈভবে।
গতি
সৌমিত বসু
দড়িতে সার দিয়ে বসে আছে আত্মহত্যা
যেন নিহত হলেই সমস্ত সমাধান
ভেসে যাবে পুকুরের জলে।
এতকাল বর্শা নিয়ে যারা
জঙ্গল তোলপাড় করেছে
তারাও ঘাসে রক্ত মুছে
চুপিসারে নেমে গেছে স্নানে।
প্রথম দৃশ্য শেষে নিভে যাওয়া আলো
মঞ্চের ওপর সে একা।খুব একা।
যতক্ষণ অন্ধকার সে ভেবে চলে
আত্মহত্যারা ভাইবোন হাত ধরাধরি করে
কোথায় চলেছে?
বিনোদিনী বিদ্যানিকেতন
অমিত কাশ্যপ
নম্র সকালের
আলো পলাশের মাথায়
বাতাসে শীতের
ছোঁয়া, ম্রিয়মান
ভোরটি দেখ,
হলুদ শাড়িতে পরিটি হয়ে
গুটি গুটি
পথ ভাঙছে বালিকাটি
আজ পলাশপ্রিয়ার
আরাধনা, কুঞ্জভিলার পাশটি
ফুলে ফুলে
শোভিত, শ্বেতশুভ্র বিদ্যাদেবী পদ্মাসনা
ধূপ-ধুনোর
গন্ধে পুজো পুজো পরিমণ্ডল
আমরা বিদ্যাসাগর
মোড় থেকে কলোনি মোড়ে
বিদ্যানিকেতনের
প্রাঙ্গণে মন্ত্র ভাসছে
জয় জয় দেবী
চরাচর সারে
কুচযুগ শোভিত
মুক্তা হারে...
আবিরে রাঙা
হয়ে বন্দনা সংগীত
ছেলেবেলা
স্মৃতি ভাণ্ডার আজও যেন মধুর
আজও কোনো
গৃহকোণ, বিদ্যালয় জেগে থাকে প্রাণবন্ত
দেখা
অন্তরা দাঁ
দেখা হল তারপর নীল আলো মায়ার ওপারে
তার আগে পিপাসা দারুণ,কষ বেয়ে গড়িয়ে নেমেছে অল্প অল্প
তেষ্টার জল বুক ভিজিয়ে,শীর্ণধারা নদীটির দেহের মতো ক্ষীণ,নাভির গভীরে তার অভিমানের
বসতবাটি, মৃদু মোম,বনতুলসীর চারা—অপেক্ষা অধীর হয়ে সন্ধ্যারতি করে
তারাখসা
রাত সাক্ষী হয়ে ছিল জেগে
শূন্যের ঘরবাড়ি
মৃণালকান্তি দাশ
শূন্য লিখেছি গাছের পাতায়,
শূন্য লিখেছি মেঘে-
হঠাৎ আলোর বন্ধন থেকে
তারারা উঠল জেগে ।
শূন্য এঁকেছি আকাশের গায়ে,
শূন্য এঁকেছি জলে-
প্রান্তরে আজ কারা যেন এসে
চুপিচুপি কথা বলে ।
শূন্য দেখেছি মরুদেশ জুড়ে,
চারদিকে শুধু বালি-
শূন্য পাহাড়ে ঠোক্কর খেয়ে
ফিরে আসে হাততালি ।
শূন্য ভেবেছি ওই সরু পথ,
কতদূরে দেয় পাড়ি-
স্বপ্নের মতো ঝরে পড়ে শুধু
শূন্যের ঘরবাড়ি ।
উত্তরসভ্যতা
শ্যামল রক্ষিত
এইখানে শেষ
হল দক্ষিণদিক
এইখানে খুলে
গেল পুবের জানালা
এইখানে ধরা দিল উত্তরমেঘ
এইখানে পশ্চিমা
বাতাস
ভালো থাকিস মানুষজন
চৌর্যবৃত্তির সমাপ্তি ঘটলে
আবার দেখা হবে
অসম্ভব নির্জনতায়
গাছপালায় ভর্তি অনিকেত কুঁড়েঘরে।
যুদ্ধক্ষেত্র-২
নরেশ দাস
এক দরজা খুলে আরেক দরজা বন্ধ করলাম,
ঘরের মধ্যে ঘর, আর সেই ঘরেই যুদ্ধ।
রাতের ঘুম সহসা বিলীন হয়ে যায়
অনাদরে,
সহস্র ক্ষতচিহ্ন বুক জুড়ে অদ্ভুতুড়ে
বৃত্ত গড়ে।
সারি সারি মুখ দাঁড়িয়ে নিষ্পাপ
মহুয়া বনে,
শিরশিরে বাতাস বয়ে যায় হৃদকমলে।
আমি শিবির ভুলে যাচ্ছি,
পক্ষ হারিয়ে ফেলছি।
অহল্যা মায়ের কান্না ভুলে যাচ্ছি,
ঢিপ ঢিপ স্পন্দন ভুলে যাচ্ছি,
যেন উপসর্গহীন কোভিদ আক্রান্ত,
যেন বসন্ত জুড়ে অবসাদ আর অবসাদ।
আগুনের ভয়ঙ্কর উল্লাসে স্থবির হয়ে
যাই,
ভোরের আলোয় পা বাড়িয়ে ভুলে যাই পথ,
পাখির কলকাকলি না শুনে হয়েছি নির্জীব
--
যেন ভয়ঙ্কর অসুখ আজ পৃথিবীর ঘরময়।
বন্দি
সরস্বতী
জয়ন্ত সিনহা মহাপাত্র
মা বলতো কুল খাবি না একদম
আগে পুজো । তারপর ...
অঙ্কে বেশ কাঁচা ছিলাম
বিদ্যা দেবী রাগ করলে বিপদ
কুল দেখলেই চোখ সরাতাম
।
তখন ভয় ছিল
বেশ ভক্তি ছিল ।
আজ ছেলেমেয়েরা কুল খায় না
শাখ আলু খায় না
ফল মিষ্টি পায়েস সবেতেই না ।
আমার জন্ম খিদের ভারতবর্ষে
আমার জন্ম সম্প্রীতির ভারতে।
তপন স্বপন জাহির ঠাকুর ঘরে
একসঙ্গে ঠাকুর সাজায়
বিদ্যা মাগে । বিড়ি টানে ।
তিরিশ বছর আগে আমার ভারতবর্ষে
জমাটো ছিল না
পিৎজা ছিল না
চমচম ছিল , সাদা বোদের কদর ছিল
সুর ছিল , প্রেম ছিল
সুরার দাপট ছিল না ।
আমাদের ভারতবর্ষে সরস্বতী দেবী ছিলেন
বিদ্যা ছিল
সাধনা ছিল
সরস্বতীদের নিরাপত্তা ছিল । ভরসা ছিল ।
আজ ভারতবর্ষে বিদ্যা বিক্রি দাড়িপাল্লায়
আজ ভারতবর্ষে সরস্বতী বন্দি পানশালায় ।
এসো মা সরস্বতী
ননীগোপাল জানা
এত আলো!
তবু তোমার দেখা পাবো না দৃষ্টি পথে?
সৃষ্টি দূষণের অন্ধকারে
স্রষ্টা কোথায়?
আলোর ভেতরের আলো বন্দী বইমেলায়
বাক্যের সংযম উন্মার্গগামী।
জ্ঞানদার সন্তান অজ্ঞানে
ভেজাল অমৃতি।
নেমে এসো জ্ঞানদায়িনী জ্ঞানদা
চরণামৃত প্রার্থনায় ব্রতী সারস্বত
দূর কর অজ্ঞান আঁধার
লহ প্রণাম মাত সরস্বতী!
সরস্বতী মহাভাগে
নবকুমার
মাইতি
সারস্বত
সাধনায় রত থাকতে চাই
আমরা সকলে,যোজন
বিস্তৃত পটভূমি
জীবন বোধের
আকাশ নীল নির্ভার
সতত আলোকবর্তিকা
উদ্ভাসিত হয়
সৃষ্টির
সুরম্য প্রাসাদ, তবুও রন্ধ্রপথে
ঢুকে পড়ে
বেনোজল, যেখানে পলিও অনুর্বর
পরিতাপহীন
আর্তনাদ,ভেতরের অসম্পূর্ণ ঘর
শস্যের অসম
বন্টন,পুঞ্জিভূত গরিবের ক্ষোভ
স্থিতধী
মানুষ আজ অচল আয়তন
অক্ষরবৃত্তে
জেগে উঠি উপাসনা গৃহে
করজোড়ে প্রার্থনা
রাখি,সরস্বতী মহাভাগে.....
নৈবেদ্য
মহুয়া ব্যানার্জী
পাতাঝরার মরশুমে নরম রোদের আঁচ,
স্কুলের হলুদ দেওয়ালে কৈশোরের অভিমানী
প্রেম ছায়ার আঁকিবুঁকি কাটে -
এ সময় বোগনভেলিয়ার যৌবনের ছটা দেখানোর
পালা,
পুকুরের জলে উদ্ধতগ্ৰীবা মরালী তরতর এগিয়ে যায়…
কলেজের করিডোরে তারুন্যের উঁকিঝুঁকি,
চাঁদা তোলার ব্যস্ততার ফাঁকে চকিত চাউনি
খুঁজে নেয় লাজুক হাসিটিকে!
টোপাকুলের গন্ধে ম’ম করে সারা পাড়া-
হিমের ধূসরতা সরে গিয়ে ঋতুরাজের রঙ
একটু একটু করে ফুটে ওঠে প্রকৃতির গায়ে।
ঠিক তখনই একটা হলদেরঙ পাঞ্জাবীর গায়ে
একটি হলুদ আঁচলের ছোঁয়া লাগে!
প্যান্ডেলের মাইকে ভেসে আসে অঞ্জলীমন্ত্র
সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে-
চরাচর ভেসে যায় পবিত্র গন্ধে-
সব প্রেমই আসলে পুজোর নৈবেদ্য!
শ্রী পঞ্চমী
প্রশান্তশেখর ভৌমিক
শীতের সকাল ডুব সাগরে
উদরে টান-টান
বিদ্যাদেবী আসবে পাড়ায়
সাত সকালে চান।
এমনিতে পেট ছুঁচোয় টানে
পুরুত ঠাকুর নেই
পাঁচ পাড়াতে পুজো সেরে
আসবে দুপুরেই।
এতক্ষণ কি এমনি থাকি,
ক্ষমা করিস মা
অল্পস্বল্প বুদ্ধি দিস
বিদ্যা চাইছি না।
দাদা, দিদি বেকার সবে
ডিগ্রি নিয়ে তারা
চাকরি হলো কিছু জনের
তারাও দিশেহারা।
প্যানেল ঝুলে আদালতে
যেতে পারে কাজ
পুঁটি মাছের পুষ্পাঞ্জলি
তবুও দিচ্ছি আজ।
মৃত্যু লেগে আছে পাখনায়
উত্তম বেহারা
ভোরের মৃত্যুশয্যা দেখার অপেক্ষায় সারা
রাত কাটিয়েছি
অঙ্কুরোদ্গম ছোলার মতো সুপ্ত জীবন
বৃদ্ধি হয়েছে সারারাত
আমাদের বেঁচে থাকার রসদ কবেই নষ্ট হয়ে গেছে গত শতাব্দীর অর্ধেক বয়সে
এবার বলো দমবন্ধ করে কেমন করে বেঁচে
থাকি মৃত্যুর পর!
অসামাজিক
সৌমেন্দ্র দত্ত ভৌমিক
যেখানেই আবেগ সাগরের ঢেউ হয়ে
মনের ভীড়ে আছড়ে পড়ে
আমি তখন ভেবেই চলি
রবাহুত চেতনায়……
যে কাজ অনুচিত
যেভাবে ভাবা বিধেয়,
সব তালেগোলে প্রমাণ করে
অসামাজিক পথে আমি হেঁটে চলেছি ।
সামাজিক অধরা রয়ে গেল
কলিযুগের কলকে পাব না বলে
দুঃখের গালে চুমু দিতে তা বলে
আবেগের হাত ছেড়ে যাব না হাজারো বছর ।
=========================================
পত্রিকা পড়ার শেষে লাইক ও কমেন্ট করতে ভুলবেন না।
0 মন্তব্যসমূহ