দুইপাতা সাহিত্যপত্র
বাইশে শ্রাবণের মায়া
তরুণ মুখোপাধ্যায়
তোমার যে গান আষাঢ়-শ্রাবণে
ফিরে ফিরে আসে বিস্মৃতি-প্লাবনে,
আমাকে জাগায় আমাকে ভাসায়--
নিয়ে আসে আলো ম্লান হতাশায়।
বিরহ বেদনে জাগায় কি সুর,
সবকিছু তাই লাগে সুমধুর
গীতবিতানের পাতায় পাতায়
বাইশে শ্রাবণ কান্না ঝরায়;
আকাশের বুকে কালো মেঘ ছায়া-
দুই চোখে রবি ঠাকুরের মায়া!
রবীন্দ্রনাথকে
শীতল চৌধুরী
উড়ছে ঘুড়ি সীমার ভেতর
জল পরিদের নাচে:
আকাশ আকাশ ঢেউ শাড়ির
ছায়া পড়ে জলে।
একটা সীমা ছাড়িয়ে যায়
সীমার ভেতর শুধু.....
সেই সীমা কী অসীম
জানি না তার কিছু
জল পড়ে পাতা নড়ে
সন্ধ্যা হয় শুধু!
পদলেহন
নবকুমার মাইতি
ক্রমাগত কুরে কুরে খায় জৈবিক রসদ
রক্ত খেকো দানব,অটল সন্ত্রাস
ঘুনধরা সমাজ শরীরে পচন ধরেছে
মুখ থেকে রক্তবমি হয় যক্ষা-কাশ!
কত আর জোড়া তালি দেবে, আগত সময়
বাঁকে বাঁকে মন্দাক্রান্তা ফল্গুধারা বয়
খরা বন্যা মহামারী জনতার বিপুল উল্লাস
শ্বাস-রোধী মহানগরীর পথ,বিপন্ন সময়
আমাদের প্রিয়জন নর-নারী বিষম-সঙ্গম
দূষণ সর্বত্র, জল স্থল অন্তরীক্ষ অনন্য উপায়
জল পড়ে অন্ধের চোখে,বেদনার বহ্নি শিখা বয়
তথাপি অন্ধের মত গণতন্ত্র হাতড়ে বেড়ায়
নিস্তার পায়না উন্মাদিনী,গর্ভে তার অবৈধ জাতক
নামাবলী গায়ে দিয়ে পথ চলে মন্ত্রী মহোদয়
মুক্তির উল্লাসে কাঁধে কারাগার, মৃত সক্রেটিস
নিভৃতে বন্দী বিচারের বাণী, সত্যের অপচয় !
স্খলন
কবিতা সামন্ত
গদগদ করে বেড়ে চলেছে অন্তরঙ্গতা।
জল পায়ে লেগে থাকলেই
হলো আরকি
এইত বেশ কাটছে দিব্যি কাটছে।
পা চাটতে চাটতে ভাতের উনুনে
মাংস আর জলের
অভাব হয়না...
তোমার ফেলে দেওয়া থুতুও চেটে খেয়ে নেবে
পোষ্য হয়ে আজীবন প্রতাজ্ঞা বদ্ধ।
স্রোতের অভিমুখ যখন যেদিকে সেদিকেই
বয়ে নিয়ে যায় আবর্জনা।
ঝর্ণার স্খলনে ধস নামে পাহাড়ে
কদিন হৈচৈ...
আবারও সেই নির্লজ্জ রাস্তা
ঠিক বুক পেতে দাঁড়িয়ে পড়ে পদলেহনে।
পদলেহন
সৌজন্যা মজুমদার রায়
সঠিক কথা বোলোনা এখন
ধোরোনা কারো ভুল,
সমাজের এই রঙ্গমঞ্চে দেখো
সত্য হচ্ছে খুন।
ক্ষমতা আর টাকার নেশায়,
ছুটছে কত মানুষ...
চরকায় তেল দিচ্ছে যারা,
উড়াচ্ছে তারাই ফানুস ।
ক্ষমতাধারীর আজ্ঞাবাহী...
হচ্ছে যারা দিনরাত,
তারাই সমাজের উচ্চপদে
করছে রোজ বাজিমাত।
সফলতার মাপকাঠি কি?
বাজারে এখন সবাই জানে।
খোশামোদকারী স্তাবক যারা,
প্রতিহিংসা তারাই আনে ।।
পদলেহন
সুমিতা মুখোপাধ্যায়
আজ আর পারাপার নেই কোন
ক্ষারকীয় শিলা নেই
অনুঘটক নেই
সেতুবন্ধন নেই
চারিদিকে মিথ্যার প্রতিশ্রুতি,
পদলেহনতার খোরস্রোতা ঝর্নার কোলাকুলি,
পাকস্থলীর মৃত গন্ধে
বুকের অন্তর্গত ঢেউগুলো আজ
ক্রমশ মৃত্যুকে ছুৃঁয়ে দিতে চায়
বারবার -পদলেহনতার অট্টহাসির
মিথ্যা প্রতিশ্রুতি হারিয়ে যায়
জয়জকার স্বেচ্ছায়,
অঝোরে বৃষ্টি উঠোনের বুক জুড়ে।
একাকী বিকলাঙ মন।।
আদালতে একদিন
শ্যামল রক্ষিত
হুজুর , আমার মধ্যে কোনো আড়াল নেই
লোকচক্ষুর সমবায় প্রথা নেই
আমি শুদ্ধতাবাদীদের একজন হয়ে হাজির
এই বোহেমিয়ান আদালতে
হুজুর , আমার বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ করা হয়েছে
তা একবর্ণও সত্য নয়
মিথ্যাচারীরা আমার পৌরুষকে হত্যা করার ফাঁদ পাতছে
আমি ক্রীতদাসী সময়ের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করছি
শুদ্ধতাকে যারা বিনস্ট করছে , হুঁজুর
আপনার আদেশে সেইসব সর্বনাশপন্থীদের মানচিত্র ফিরিয়ে দেওয়া হোক ।
অনুগ্রহ
পুষ্প সাঁতরা
চামচেগিরি পুরো দস্তুর,বহূব্রীহি সমাস
মানুষ মারলেও মাপ উদোম বারোমাস।
পদলেহনের ছোটদাদা তোষামুদে নাম
আখেরটুকু গুছিয়ে নিতে পূর্ণ মনস্কাম।
বোধের দরজায় তালা মানবতা চূর্ণবিচূর্ণ
স্তাবকতায় চাটুকার হয়ে কামনা-বাসনা পূর্ণ।
তৈলবাবু তেলেদিয়ে পুকুরের ইলিশ ভেট
মোসাহেবী রপ্ত করে চলেসাত পুরুষের পেট
বাবুর অনুগ্রহ একটু পেলে মিলে জব্বর পদ
পদলেহন পেশাটি ভাল বাড়বাড়ন্ত সম্পদ।
তুমি শুধু কবি
অমিত কাশ্যপ
রাসমণি গার্ডেন, নতুন কলোনির ওদিকটা
পরিচ্ছন্ন, রাস্তাঘাট ভালো, উজ্জ্বল বাতিস্তম্ভ
আমরা কজন ক্লাব কয়েক বছর হল বেশ নাম
মাঝে মাঝেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়
রবীন্দ্রজয়ন্তী, কবিগুরুর প্রয়াণদিবস আর
বিজয়া সম্মেলনী, বিশেষ মাত্রা পায়
আসেন শিল্পী শহর থেকে, থাকেন পাড়ার শিল্পী
মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, উদ্দীপনায় প্রাণচঞ্চল
ক্লাব সভাপতি প্রতি বছরই আবেগ কন্ঠে বলেন
আমরা পালন করি, রবীন্দ্রপ্রণাম ভরা গ্রীষ্মে
আর ভরা শ্রাবণে প্রয়াণদিবস বাইশে শ্রাবণ
আমাদের প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ
তাঁর কথায়, 'আমার মাথা নত করে দাও হে
তোমার চরণধূলার তলে'
মানুষ ঠাকুর
বিকাশ চন্দ
সকল সভ্যতার উজ্জ্বল সময় জানে
এ ভারতে বাংলায় প্রতিদিন চোখে আলোর রবি-কিরণ
বিলীন শোকের অক্ষর থমকে অনন্তকাল
বহুতর বীভৎসতা দেখেছে মৃত্যুর আলিঙ্গন
সহ্যের সীমা ছাড়ায় স্বদেশের কালিমাময় পাথুরে স্মৃতি
সকল আমির মৌন ঈশ্বর চির ভাস্বর শান্তিনিকেতনে
মানুষের সাথে আত্মার সাথে ভাঙা বাংলার গান
অচলায়তন সময় ভেঙে দাঁড়ায় গীতাঞ্জলি'র আমি
কারা গড়ে সৌধ কারা ভাঙে অনন্ত প্রথা
সূর্যের জীবন জানে অবিনশ্বর রবি কথকতা
আত্মবোধের পথিক বলেন বিশ্ববোধের বাণী
মহাবিশ্বের সৌধে থমকে অমোঘ আলোর খণ্ড চিত্র
প্রতিদিনই সূর্যের আলো খোঁজে মর্ত্যের ঈশ্বর
অমৃত সময়ে মৃত্য ছুঁয়ে কান্নায় ভেজে সকল যতিচিহ্ন
সুউন্নত দিশারি দেখালে আমাদের জন্মের পটভূমি
মাটির জীবন ছুঁয়ে বেঁচে আছে সকল কালের চিত্রলিপি
সকল মৃত্যুর ব্যথায় ভিজে যায় ব্রাহ্ম সঙ্গীতের সকল পদাবলী
সুরেরগুরুর আরাধনায় মৃত্যহীন রবীন্দ্রনাথ মানুষ ঠাকুর
একদা
কেয়া মৈত্র
গাছেরা অস্থির হয়ে নড়ছে,
ঝড় নয়, বুকের ভেতর চাপা দীর্ঘশ্বাস।
আকাশে কালো কলঙ্ক
মেঘ জমে নয়, ধোঁয়ার বিস্তার।
বন সরে সরে দিগন্তে কেবল
মরুভূমি, অনাবশ্যক শুষ্কতা।
মহাশূন্যে অস্থির কম্পন।
এ গ্রহটাকে বাঁচানো যাবে না আর
শুধু একটা প্রলয়ের অপেক্ষা
তারপর অন্য ইতিহাস...
একদা একটা পৃথিবী ছিল
ছিল প্রাণের সম্ভার।
জল তরঙ্গ
কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়
ঝরণা'র গান শোনা
পাথরের অভ্যাসে থাকে না কোনদিন।
শিলা'র ভাগ্য জুড়ে
তাই যত শ্যাওলা গজিয়ে ওঠে;
বিরক্ত এক নদী
মোহনার দিকে মুখ ফিরতেই
টুংটাং জল তরঙ্গ হয় .....
নামান্তর
ননীগোপাল জানা
অভাবে নয় স্বভাব নফর
বোধে বাধে না পরাধীনতার গ্লানি।
স্পর্শ করে না দাসত্বের ক্লেদ।
প্রবৃত্তির দীনতার জালে
আকণ্ঠ নিমগ্ন
চাটুকারিতা সম্বল- যাপনে ।
ন্যায় অন্যায় বোধে অবরোধ
বিপন্ন আত্মমর্যাদা
নির্লজ্জ অভিব্যক্তি- তোষণ।
মেরুদণ্ড ন্যুব্জ দাক্ষিণ্য প্রত্যাশায়।
অনন্যোপায় কূট কৌশল
পদলেহনের নামান্তর।
আশ্চর্য আলো
শ্রাবণী বসু
রোদ্দুরকে পাতার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে -
সপ্তাশ্ব রথ ফিরে গেল স্বর্গের দিকে,
আমাদের চারপাশে প্রতিদিন অনুভূতিময় আলোর লণ্ঠনটি জ্বেলে,
রোজ সে ফিরে যায় নিজস্ব ভূমিতে।
পৃথিবীর পবিত্র পিলসুজে জ্বলে ওঠা
প্রথম দীপশিখাটির স্পর্শে -
সকালের গাল লাল হয়,
বৃক্ষের মাথা সবুজ হয়,
নদীর জল নীল হয়।
কী আশ্চর্য,এতবড় একটা আকাশ,
অথচ ওই একটিমাত্র প্রদীপ -
তার সমস্ত আগুন নয়,কিছু কিছু রেখা দিয়ে
রচনা করে সমস্ত প্রকার প্রাণের সংহতি!
মায়াবী মুখ
কালীপদ ঘোষ
দূরে আছো !
তাইতো ভেসে ওঠে তোমার উজ্জ্বল মুখ!
নাকছাবি,কানে ঝুমকা দুল
কপালে মেরুন টিপ
পরনে হলুদ শাড়ি !
কাছে থাকলে --
হয়তো সেই মুগ্ধতা দেখতে পেতাম না
তারাভরা আকাশের মুগ্ধতা!
অরুন্ধতী নক্ষত্রের চোখে জল
কমণ্ডলু হাতে বশিষ্ঠ চলছেন
গঙ্গোত্রীর উৎসমুখে ...
অলকানন্দার জলে ভেসে যায়
সহস্র নীলপদ্ম
রাতের ছায়াপথে অসংখ্য কান্নাভেজা মানবী মুখ !
রাতের অন্ধকারে ভেসে ওঠে তোমার মায়াবী মুখ ...
মোসাহেবী
বিধানেন্দু পুরকাইত
জীবন আছে জীবনকে নিয়ে
আমি আছি - একা নির্জনে
বালিয়াড়ি ভেঙে সমুদ্রের জল
একা একা কাঁদে
একা করে যায় কলরব।
ক্রমে ক্রমে সুন্দরী হয়ে ওঠে
আমার শহর কলকাতা
দুপায়ে নূপুর বাঁধে বিনুনির খোঁপা
শরীরে লাস্যময়ী - আর মাদকতা।
এখানে বেমানান কিছু কংক্রিট
ওপরে মেট্রোরেল নিচে ছোটে রেল
গোঁয়ার শব্দ ছোটে অশ্রাব্য শ্রবণ
দরকারে মোসাহেবী-কেউ মারে তেল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিবেদিত
আনন্দমোহন দাশ
তোমার ছবি ফুল - মালায় আর ধূপ - চন্দনে সাজিয়ে
বসে আছি পায়ের কাছে।
তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা ভীষণ জরুরী ভেবে
পাতায় পাতায় আঁকিবুঁকি, কাটাছেঁড়া করে
একটিও নিটোল কবিতার জন্ম দিতে পারিনি।
আমার ভেতরে খাঁ - খাঁ করে অভিশাপের মতো
বেজে উঠেছে বৈশাখের তীব্র দাহ
আর কবিতার পাতা জুড়ে নেমে এসেছে অঝোর শ্রাবণ।
যতবার তোমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছি
তুমি ততবার খোয়াই ও টিলা পেরিয়ে
এক পা - এক পা করে চলে গেছো
ভুবনডাঙার দিকে ...
এই লবন নদীর দেশে
তুমি আমাদের একদিন ... প্রতিদিন ... ।
একটি উর্বরতম চাষের নাম
অশোককুমার লাটুয়া
লেহন হলো চেটেচেটে খাওয়া। চাটার জন্য জিভ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ।
জিভ চেটে খায় মালাই বরফ, মধু এবং নেমতন্ন বাড়ি খাওয়ার পরে হাতের যত আঙুল।
কিন্তু পদলেহন মানে পা চেটে খাওয়া। পা চেটে খাওয়া মানে কী? মানে হলো আমড়াগাছি, ধামাধরা, চাটুকারিতা
আর স্তাবকতা।
পদলেহনে পাওয়া যায় সুযোগসুবিধা, ক্ষমতা আর উন্নতির উষ্ণতা।
মানুষের পৃথিবীতে আছে দুটি পক্ষ -- পা চাটানো আর চেটে খাওয়া।
এজন্যই বোধ হয় আত্মবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে ক্রমশঃ। উর্বরতম চাষ পদলেহনের আরেক নাম।
পদলেহন এক আশ্চর্য শৈল্পিক প্রক্রিয়া রাজনীতি আর সংস্কৃতিতে। এ লাইনে কেউ থাকলে হাত তুলবেন প্লিজ।
শ্রাবন যখন -২২
উত্তম বেহারা
অর্ধেক ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আমি
রোজ পাঁজি উল্টে দেখি বিদ্যুৎ জীবন
আজও বিষন্ন অন্ধকারে খোলা ছাদে
ঘুমিয়ে ছিলাম মৃত নক্ষত্রের মতো
হঠাৎ শুনি বাতাসে ভাসে
কারো শীতল ঠোঁটে তোমারই সঙ্গীত উচ্চারণ
আপেক্ষিক আদ্রতায় অজস্র শ্রাবন গেল চলে
এখনো মাথা নীচু করে বসে আছি প্রভু
তোমারে সাক্ষাতে প্রনাম জানাতে
0 মন্তব্যসমূহ