২২ শ্রাবণ ২০২৫।।দুইপাতা ১০২তম সংখ্যা প্রকাশ। সম্পাদক: নীলোৎপল জানা

 

 

দুইপাতা । ১০২তম সংখ্যার প্রকাশ

সম্পাদক: নীলোৎপল জানা

Mail iD: lokpathduiipatapatrika78@gmail.com




ভিজে যাচ্ছে বাইশে শ্রাবণ 

রবীন বসু 

 

সারারাত বৃষ্টি পড়ছে 

কোথাও তুমুল ভিজছে ছাতিম গাছ

গীতবিতান ভিজছে, গল্পগুচ্ছ ভিজছে 

শেষের কবিতা বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে 

কলেজ-পড়া মেয়েটি।


গ্রামদেশ ভিজে সারা হচ্ছে 

কচুপাতায় জলমানিক দেখছে বলাই

তারাপদ শালতি নিয়ে খালের জলে লগি ঠেলছে

উঠোনের জলে কি সুন্দর নাচছে মেয়েটি…


ভিজে যাচ্ছে বাংলাভাষা

বর্ষার গান হয়ে তুমি দাঁড়িয়ে আছো রবীন্দ্রঠাকুর। 


এই শ্রাবণের বুকের ভিতর

মৃণালকান্তি দাশ

আপনি লিখেছিলেন,
  এই শ্রাবণের
বুকের ভিতর আগুন আছে...
অথচ সেই শ্রাবণের আগুনই আপনাকে
পৌঁছে দিল গানের ঝরনাতলায় ।

ওখানে কি এখনও আপনার কন্ঠের সুর
ভেসে বেড়ায় ?
দিনু ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ, রানী চন্দ,
প্রতিমা দেবীরা থাকেন ?
বারান্দার কার্নিশে মুখ নামিয়ে একমনে
শোনেন কাদম্বরী দেবী ?
মৃণালিনীর তো কত কাজ, গান শোনার
সময় কোথায় তাঁর
  !

জানতে ইচ্ছে করে রবিঠাকুর,
ওখানে শ্রাবণ আসে আজও ?
শ্রাবণের ধারার মতো বেজে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ?


শেষের কবিতার মতো বৃষ্টি

অজিত বাইরী 


একখণ্ড মেঘের মতো দু'চোখ ছুঁয়ে আছ।

সাদা কবুতরের মতো ডানা মুড়ে

টিলার উপর নির্জন ওই বাড়ি

আকাশ রঙের শাড়ি

রেলিং থেকে ঝাঁপ দিয়ে

দিগন্তের হাতে পতাকার মতো উড়ছে। 

পাখির ডানার মতো

জানলার পাল্লা দুটো

একবার খুলছে, একবার বন্ধ হচ্ছে। 

হয়তো বৃষ্টি নামবে;

হয়তো শিলং পাহাড়ের বুকে

শেষের কবিতার মতো বৃষ্টি।


কবি প্রণাম

বিকাশ চন্দ


"মরণ রে তুঁহু মম...."

মৃত্যু যদি পরম আশ্রয় হবে

হা কৃষ্ণ বলে মেনে নিতে হয় ভিখিরি জীবন

শূন্য জমিনে আজীবন গেয়েছেন

প্রিয় জীবনের শস্য ফসলের গান

দু'হাতে আগলে জীবন

তবুও হে মৃত্যু শ্যাম বর্ণ তুমি

তুমি আমার কৃষ্ণসখা সমান

 

মরণে আনন্দ বরণে আনন্দ

তবুও স্বজন বিয়োগে শোকের অনুধ্যান

শোক-শক্তি ঘিরে আছে বিচ্ছেদ দর্শনের জীবনের

"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে..."

 

২২শে শ্রাবণ আসে যায় অমৃত বিশ্বাসে

সকল সংসার খোঁজে শান্তি নিকেতন

মৃত্যুর ভিতরে চিরায়ত অধ্যায় আলোময়

"তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে.... "


বাইশে শ্রাবণের স্মরলিপি  

অশোককুমার মিশ্র

 

বাইরে অঝোর ধারে ঝরছে আকাশ।ঘরের ভেতরে মাঝে মাঝে উঠছে বুকফাটা দীর্ঘশ্বাসের গম্ভীর স্বন।তুমি কলম তুলে রাখার আগেও খুঁজেছিলে জীবনের চরম প্রশ্নের কঠিন উত্তর।না-মেলা উত্তর বুকে নিয়ে চোখ বুজিয়েছিলে। তারপর পঁচাশিটা বর্ষা নিয়ম করে অনিয়মিত বৃষ্টির কান্না ঝরিয়ে গেছে,উত্তর মেলেনি।

আমরা যারা তোমার চোখ দিয়ে দেখেছি জীবনের পূর্ণতা আর সে-ই তুমি পূর্ণতার মাঝে বসে সন্ধান করেছ আরো সত্যকে। তোমার অনুভূতির সঞ্জীবি্ত করে প্রকাশ করেছ তাকে সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের পঞ্চম স্থানে থাকা বাংলা ভাষায়।এভাবেই রসশাস্ত্রের নিয়ম মেনেও নব মানব রসের সংযোগে মানুষের জীবনের সব অনুভূতিগুলিকে তুলে ধরেছ আশ্চর্য সাবলীলতায় মরমী শব্দে,অপূর্ব ইঙ্গিতে।

এখন জমাটবাঁধা অন্ধকারে না আছে আলোকময় করে আলোর আলোর আগমন সম্ভাবনা, না জীবনের স্বাভাবিকতার পথে পা বাড়ানোর দিশা আর আগ্রহ।হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী্র নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত।তোমার ভাষায় কথা বলায় মানুষকে স্বদেশে পরদেশীরূপে চিহ্নিত করে দিচ্ছে সুবিধাভোগী সুবিধাবাদীরা।তাই বাইশে শ্রাবণ কাঁদছে।তুমি বাংলার মাটি বাংলার জলকে এককরার মন্ত্র শিখিয়েছিলে।তপোবনের পশুপাখি বনজঙ্গলকে একহৃদয়ের বাঁধনে বেঁধেছিল বলেই শকুন্তলার তপোবন থেকে চলে যাবার সময় তারা সবাই কেঁদেছিল।আর আজ মানুষের সাথে আকাশও কাঁদছে কেননা এই দীর্ঘ সময়েও ভালোবাসার অমোঘ মন্ত্রে দীক্ষা হলো না তার সন্তানদের।বলতে পারছে না তারা -মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। 

 

নির্বাক জলকণা ছুঁয়ে যায় এক অদৃশ্য শবযাত্রা

আবু রাইহান

 

বাইশে শ্রাবণের দিন যেন এক অনন্ত দীর্ঘশ্বাস,

নির্বাক জলকণা ছুঁয়ে যায় এক অদৃশ্য শবযাত্রা।

ঘন মেঘে ঢাকা দিন যেন কোনো গানের ছায়াপাতা,

সারাদিন মন থেমে থাকে শ্রুতির অপেক্ষায়।

সেদিনও ভিজেছিল শান্তিনিকেতনের উঠোন,

যেদিন তোমারছায়া সরে গিয়েছিল নিঃশব্দে।

তুমি চলে গেলে, অথচ থাকলে-যেন প্রবহমান নদী

তুমি ফেলে গেছো একটি অন্তহীন গীতবিতান,

যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠায় আজও শ্রাবণের বৃষ্টি পড়ে।

 


দৃশ্যায়ন

প্রদীপ্ত খাটুয়া 

 

জোরে চালাও সাইকেল। 

মাথার উপর চড়া রোদ, 

নৌতাপ।


আর কিছুটা এগোলে জঙ্গল এসে পড়বে
 

ঠা ঠা মাঠ 


এক-আধটা টিউবওয়েল, ভাঙা
 

জল পড়ে না

দিন শেষে শ্রান্ত পাখির 

তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের শ্রম বিফলে যায়...

 

এই শ্রাবণে

নাগসেন

 

তোমার কাছে অশেষ ঋণী 

                        তরুণ কবি

পালক থেকে ঝরুক বৃষ্টি 

                       যখন ভাবি

 

যখন যেমন একলা থাকে

                      যে পাখিটি

তারও ঠোঁটে তোমারই গান

                         পরিপাটি

 

এই শ্রাবণে মেঘের দলে

               আমিও আছি

তোমার পায়ে পড়বো ঝরে

                        বৃষ্টি হয়ে

বৃষ্টি সে তো ব্যথার বাদল

সারা জীবন এই জেনেছি 


রবিঠাকুর একটু শোনো

বিধানেন্দু পুরকাইত

 

রবি ঠাকুর একটু দাঁড়াও

সত্যি বলছি নইলে আমি আড়ি দেবো

শুনবে বলো আমার কথাও

এবং তোমার সঙ্গে যাবো।

রবি ঠাকুর রবি ঠাকুর

এতোই তুমি বোকা ছিলে !

ঘরের খেয়ে যেমন রাজার

ঘুম আসে ঢেঁকুর তুলে।

এমন বোকা গড়লে একটা শান্তিনিকেতন

স্বপ্ন দেখলে শিক্ষা দেবার

ভারতবাসী মুর্খ যেমন

শিক্ষা তুমি দেবে সবার।

পবিত্রতায় সঙ্গীত ও চারুকলার

বিস্তার হোক চতুর্মাত্রিক

চীন জাপান ভারতবর্ষ কিংবা শ্রীলঙ্কার

শিক্ষক বা ছাত্র ছাত্রী হলো একত্রিত।

আজকে দেখো রবিঠাকুর

গ্রাস করছে রাজনীতিবিদ

চুরি করার ঘেয়ো কুকুর

তারাই অসংবিধ।

রবি ঠাকুর বলো তুমি

কেমন বোকা আগাগোড়া

দরকার কী এ পাগলামী

ভস্মে ঘি পোড়া।

রবি ঠাকুর একটু দাঁড়াও

সত্যি বলছি নইলে আমি আড়ি দেবো।


কে যায় অনন্ত ধামে

অমিত কাশ‍্যপ

 

আমার জন্মমাস শ্রাবণ, সেবার তুমুল বৃষ্টি ছিল

পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট নদী, কাগজের নৌকো পড়ত

ব‍্যালকনি থেকে, আহা, কালো কালো মেঘ

ছিঁড়ে ছিঁড়ে কে যে সেলাই করত সব

 

আমার কষ্ট মা'র কষ্ট হাওয়ায় উড়েছিল ক'দিন

তখন তো এমন শহর খুলে যায়নি নিখুঁতভাবে

বাড়ি বাড়ি গাছপালা বর্ণময় আকাশ

সেজে উঠল শ্রাবণ মেখে, আহা, সুন্দর, আহা

 

এমনই একদিন শূন্য হয়ে হায় হায় করে গাইলে

'শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে'

ঠাকুর বিদায় নিচ্ছেন, এত কান্না লুকনো ছিল

জনস্রোত জনকল্লোল, বিষাদের সুরে

কে যায় অনন্ত ধামে

 

ধর্মে-অধর্মে

শ্যামল রক্ষিত 

 

গলায় সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে কেউ আর সহজ কবিতা লেখে না 

জীবনানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল আওড়াতে আওড়াতে মঞ্চ কাঁপিয়ে তোলে 

ইংরেজদখলের ভারতবর্ষে 

মনোভাবে রাতদিনের ভাঁজ-করা বিষাদ, কেউ গঙ্গা বাইছে, কেউ ইউফ্রেটিস 

চীন বা রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের  জন্য কেউবা মহাত্মা গান্ধীকে দায়ী করছে 

হাহাকার ঝরছে দূষণের ভৌমজলে 

 

আমি কারও পক্ষে নয়, বিপক্ষ আমার ধর্মে ঠিক আসে না 

কবিতার ভিতর ভিয়েতনাম বা কিউবা ঢুকিয়ে টুপি খুলে বসে আছি 

মহাকাশের দর্পণে 

কখন কে ঔপনিবেশিক দখলের সূত্রটা মুখস্থ করবে সেই অপেক্ষায়

 

আমাদের কালযাত্রা শুরু 

ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখে আমি সারাদিন কৃষক আন্দোলন আর শ্রমিক আন্দোলনের খসড়া রচনা করছি 

 

মানুষের ভিড় বাড়ছে কেন্দ্রিকরণের ছায়ায়, গাছেদের সমূলে উপড়ে মানচিত্রের ওপর 

সূর্যপ্রসারিত রোদের চওড়া হাসি 

তুলনামূলক স্বত্বে মন্দির-মসজিদ-গির্জার বহর বাড়ছে 

 

আমাদের যাপনচিত্রে কবেকার সেই রঘুডাকাতের ছবি ভেসে ওঠে ।

 

 


 দুঃখের বরষা: মৃত্যুর মিছিল

শংকরপ্রসাদ গুড়িয়া

 

ভারতীয় দর্শন মৃত্যুকে আত্মার অমৃতলোকে যাত্রা অথবা এক জীর্ণ দেহ থেকে আর এক নবীন দেহে গমন বলে মনে করে। সেজন্য কারো মৃত্যু সংবাদে লেখা হয় তিনি পরলোক গমন  করেছেন বা শ্রাদ্ধের চিঠিতে লিখিত হয় সাধনোচিত  ধামে গমন করেছেন। আরও বলা হয় মৃত্যুর জন্য দীর্ঘস্থায়ী শোক অনাবশ্যক। মৃত্যু এক দেশ থেকে আর এক দেশে দেশান্তর যাত্রা। এরূপ উপনিষদের চিন্তাধারায় সাধারন মানুষের পক্ষে মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মত মহামানবের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছিল।

 একের পর এক প্রিয়জন বিয়োগ রবীন্দ্রনাথের জীবনে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের মায়ের যখন মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স অল্প।ফলে মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর প্রথম যে পরিচয় তা গভীর বা স্থায়ী ছিল না। কিন্তু তাঁর ২৩ বছর বয়সের বৌঠান কাদম্বিনী দেবীর আত্মহত্যা(৮ বৈশাখ ১২৯১) তাঁর অন্তর্জীবনকে  বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।পত্নী মৃণালিনী  দেবীর মৃত্যু(১৩০৯ সনের ৭ অঘ্রাণ) হয় মাত্র ২৮ বছর বয়সে।পত্নীর দেহান্তের ১১ মাসের মধ্যেই কবির মেজ মেয়ে ১৩ বছরের রানীর  মৃত্যু(১৩১০ সনের আশ্বিন মাসে) হয় টিবি রোগে। রানীর প্রয়ানের দেড় বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরম আরাধ্য পিতৃদেবকে হারান( ৬ মাঘ ১৩১১)। এরপর ১৩১৪ সনের ৭ই অঘ্রাণ রবীন্দ্রনাথের অতীব প্রিয় কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রের মৃত্যু হল। বড় মেয়ে বেলা বা মাধুরীলতাও পরলোকে   চলে গেলেন ১৯১৮ সালের ১৬ই মে। কবির দৌহিত্র ছোট মেয়ে মীরাদেবীর একমাত্র ছেলে নীতিন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটে ১৯৩২ সালে‌।

এসব সত্ত্বেও তাঁর অন্তরের নিগূঢ় বেদনার বহিঃপ্রকাশ প্রায় দেখা যায়নি। পরম বিস্ময় এই যে, বিভিন্ন জনের মৃত্যু মিছিলে হাঁটতে গিয়ে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনও অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। বরং তা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি হল জীবনের 'হ্যাঁ' এর দিক হল বেঁচে থাকার আনন্দ, আর জীবনের 'না' এর দিক হল মৃত্যু। তাই মৃত্যুর চেয়ে জীবনের দাবী অনেক বেশী। জীবন যেমন সত্য মৃত্যুও ততই সত্য। খুব কষ্ট হয় তা জানি, তবু একথা অস্বীকার করা চলবে না যে,মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোন মূল্যই থাকেনা। তাই শোককে এত বাড়িয়ে দেখা ঠিক নয়।

 

অন্ধকারের ভেতর হেঁটে চলা

 কবিতা সামন্ত 

                       

সরে যেতে যেতে রোদের ঠিকানা বড্ড সরু হয়ে গেছে। নত হয় অন্ধকারের কাছে।

নদী ঘাটে যত বেনা ঘাস আর বন কলমীর আস্তানা ওরা কাউকেই এক ছটাক জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি না। নদী ঘাটে যে নৌকটা নোঙর ফেলে খুশি খুশি কারো অপেক্ষা করত আজ তারও কোন অস্তিত্ব নেই নদী ঘাটে।

পশ্চিমে মুখ ঘুরিয়ে নদী ঝিলের জলে স্নান করতে যাওয়া সূর্যের রূপ দেখতে দেখতে একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে হারিয়ে যেতে পছন্দ করা উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ে গুলোকেও দেখতে পাওয়া যায় না।

একে অপরের সঙ্গে বন্ধ ঘরের ভেতর চ‍্যাট করতে বেশি ভালোবাসে।

এদিকে ভালোবাসার পরিভাষাও বদলেছে। সময় বদলেছে,বদলেছে জীবনধারা। 

আধুনিকতার আড়ালে বেড়ে চলেছে অদৃশ্য হিংস্রতা আর নগ্নতা। প্রকৃতির সঙ্গে লুকোচুরির খেলায় জিতে গেছে মানুষের বুদ্ধি। মাটি চুরি করে বড় বড় পা ফেলেছে কংক্রিট।

কঠিন বস্তুর কাছে ঠিক যেমন মাঠে ঘাটে ফুটে থাকা কোমল পদ্মের কোন অস্তিত্ব ধোপে টিকেনি তেমনই স্বার্থের কাছে মনুষ্যত্বেরও কোন অস্তিত্ব টেকেনি।

ঘুনে ধরা সমাজকাঠামোয় শিক্ষার হার যতই বাড়ে মানুষ অশিক্ষিত হয় ততোধিক।

পাথরের ঝাঁ চকচকে এসি ঘরে জায়গা হয় পাথরের মূর্তি আর "আন ইউজেবলার" ব‍্যবহার অযোগ্যের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় মা বাবাকে!

সত্যিই কি মনে হয় আমরা আধুনিক,আমরা শিক্ষিত,আমরা ইউনিক!

কারোরই কারোর প্রতি দায়বদ্ধতা নেই,নেই কোন অনুভূতি। মরুভূমির মরা গাঙের মতো। ভনিতা আর ভণ্ডামি পদে পদে পরিলক্ষিত হয়।

পদ বলতে মনে পড়ে গেল পদে টিকে থাকতে মিথ‍্যেকেই  অবলম্বনের পাথেয় করে চলেছে।

এইতো আমরা উন্নত প্রাণী এইতো আমরা মানুষ। সত্যিই কি মানুষ নাকি মানুষের নামে অমানুষ।

এ যেন শুধুই অন্ধকার সময়ের ভেতর হেঁটে চলেছি।

 


বাইশে শ্রাবণ

অরবিন্দ সরকার 

 

শ্রাবণ এলেই দুমড়ে ওঠে তাঁরই গান 

ভুবন জুড়ে আসন পাতা

মন খারাপের আরোগ্য কেতন

পাখির গানে, ফুলের সাজে সবুজ পাতার ডালে

তোমার ছোঁয়া সবখানে

নীলাকাশে ব্রক্ষ্মান্ডে তোমার সুরের ঢেউ তোলে

বিশ্বাসেরই তেজী ঘোড়ায় তোমার সাহস প্রেরণা দেয়।

প্রতিবাদে তুফান ওঠে

বিনীত দিনের স্রোতে জেগে উঠি যখন তখন।

 

আপনাকে ছুঁতে পারিনি

চিন্ময় দাশ

 

আপনাকে ছুঁতে চেয়ে ছাতিমের

তলায় বসেছিলাম শ্রাবণের অন্ধকারে ,

তিন পাহাড়ের কাছে বসে ভেবেছি

কখন সেই দরবেশ আসবেন

মলিন আঁধার আলো করে !

কোপাইয়ের জলে যখন চিকচিক

করে ওঠে চাঁদ , তখনই ছুঁতে যাই

আপনাকে কিন্তু কী এক অবোধ্য

কারণে বাইশে শ্রাবণ ঝাপসা হয়ে

আসে শিশিরের মতো !

আপনাকে আর ছোঁয়া হয় না ,

আপনি অস্পৃশ্যই থেকে যান অনন্তকাল !

 

জাগরণের ঋতু শ্রাবণ

পুষ্প সাঁতরা

 

জীবন ও মৃত্যু আমাদের চলিষ্ণুতার দুটি পর্যায়। তাই মৃত্যু জীবনের শেষ নয়,এ শুধু এক রূপান্তর! রবীন্দ্রনাথ যেমন জীবন অনুভবের স্রষ্টা,তেমনি মৃত্যু অনুভব ও সেই টানে এসেছে বিচিত্রতায় উপলব্ধির সহজ তথ্য ।সত্তার সত্য যে প্রাণ,মৃত্যু কখনও নয়--- উপনিষদ থেকে তিনি এই উপলব্ধি করেছিলেন।কবির জীবন ছিল মৃত্যুর নিপুন শিল্পে বিকীর্ণ , সে কারনে তিনি মরণ নয় , আমৃত্যু জীবনের জয় গান করেছেন।রবীন্দ্রনাথ এক জায়গার লিখে ছিলেন শ্রাবণ হচ্ছে জাগরণের ঋতু।

এই মৌসুমী মাস শ্রাবণ ,কবির অতি প্রিয় মাস তাই তাঁর রচনা ছড়িয়ে আছে সাহিত্যে ।বিরহের কাল বর্ষাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য অনুভব-- নানা বর্ণে নানাভাবে।বারে বারে ফিরে আসে বাইশে শ্রাবণ-- রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি তর্পনের দিন আমাদের ও আত্ম আবিষ্কারের দিন।মহাকবি দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে গ্রহন করেছিলেন জীবনের পরিপূরক হিসাবে।তাই কবির কাছে মৃত্যু কেবলমাত্র, জীবন বিচ্ছিন্নভাবে বোধ আনে না বরং মৃত্যুর অনিবার্য ঘটনাকে মেনে নিয়েই তাঁকে নানা কর্মে ব্রতী হতে নিয়োজিত করে।কবির সুদীর্ঘ জীবনে শোক দুঃখের আঁধার রাত্রি এসেছে বারে বারে,কিন্ত তা সত্বেও রবীন্দ্রনাথের জীবন মৃত্যুর নিপুন শিল্প চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে।শোককে তিনি আত্মস্থ করেছেন।এই দুঃসহ বিচ্ছেদ বেদনা কবির কন্ঠে 'মিলনের গানে 'রূপান্তরিত হয়েছে।কবির কথায় 'জন্মান্তরের নব প্রভাত 'মৃত্যুকে কবি বলেছেন, 'জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা।তাই বাইশে শ্রাবণ জীবনেরই তাৎপর্যকে চেনায় নতুন করে।এ মহাপ্রয়ানের দিন নয় এ বুঝি মহাজীবনের মহা জাগরণের শ্রাবণ মাস ! 

বৃক্ষ রোপন উৎসবের সঙ্গে মৃত্যু তিথি মিলিয়ে, আমরা বৃক্ষ রোপণ ও মৃত্যু উদ্ যাপনের সম্মিলনে পাই জীবন উদ্বোধনের প্রেরণা।পৃথিবীর এই যে মরুবিজয়ী বৃক্ষ তাকেই রবীন্দ্রনাথ 'আদিপ্রাণ'হিসাবে দেখেছেন।বৃক্ষ বন্দনা মানে প্রাণের উপাসনা,প্রাণের প্রতীক, চেতনার প্রতীক। বৃক্ষকে ভালবাসা ,তার সঙ্গে আত্মিক অনুভবের নান্দীঘাট শৈশবেই শুরু করা উচিত তা রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন।শিশু বৃক্ষের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, 'প্রাণের পাথেয় তব পূর্ণ হোক হে শিশু চিরায়।'

মরুবিজয়ের কেতন উড়াও হে শূণ্যে' এই গানটির মধ্য দিয়ে বৃক্ষ রোপণের সূচনা। তাই বাইশে শ্রাবণ দিনটির তাৎপর্য একেবারেই অন্যরকম। এ শুধু মহাকবির তর্পণের দিন নয়,এই দিনটিকে পালন করা হয়, নব জীবনের নবজাগরণের উৎসব হিসাবে,এর এক প্রতিকী তাৎপর্য আছে।বৃক্ষ শেখায় পুনর্জীবনের মন্ত্র।বৃক্ষ শিশুর উদ্দেশ্যে উপসর্গিত এই দিনে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় বনবানী-র  সুর।এভাবেই বৃক্ষ সম্ভাবনায় আকাশ গড়ে ওঠে আবাহনে---  

মৃত্যুর শোক যায় ঝরে,বাকি সব রূপান্তরিত হয় জীবন পাথেয় হিসাবে।

 

বাইশে শ্রাবণ

সুরজিৎ গুছাইত

 

সেদিনও মেঘ জমেছিল এতখানি

শ্রাবণের বাইশে,

দেবতার বিদায় লেখা হল

ইচ্ছামতীর দেশে।

 

জীবন খাতায় তোমারই গল্প

তোমারই উপন্যাস,

তুমিই স্রষ্টা, তুমিই সৃষ্টি

তোমাতেই সহবাস।

 

শ্রাবণের ভোরে,তোমারই সুরে

পূজার সিংহাসন,

ফুলের মালা বাসি হলেও

আজ বাইশে শ্রাবণ।

 


আজ বিকেলের ডাকে

সন্দীপকুমার মান্না

 

শ্রাবণের মেঘমুক্ত আকাশে বৃষ্টির লুকোচুরি

কখনও টুপটাপ কখনও মুষলধারে প্রতি

ডুবিয়ে দিলে মাঠঘাট সবুজ প্রান্তর

চোখের জলে স্ব হারানোর গতি।

তুমি এখনও আমাদের প্রাণে প্রাণের বাতিঘর

বহমান জীবনের প্রেরণা উজ্জ্বল ধ্রুবতারা

বিশ্ব মাঝারে শুনালে যৌবনের গান

দেখালে মানুষ মানুষের চিরতরা।

শুভ সকালের প্রথম আলোয় আলোকিত কল্পনা

রাঙা হয়ে কথা বলে তোমার চোখের তারায়

সন্ধ্যার শঙ্খদীপে আসো সবাকার মাঝে

মননের বেনিআসহকলা মূচর্ছনায়।

এখনও বিস্ময়ে বিস্মিত তোমার' কালিকলম মন

বুঝিয়ে দেয় অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের মানে

হ্যাঁ,কবি শুষ্ক মরুতে জোয়ার আসে

রৌদ্র কিরণে ঐ 'আঠারো'র গানে।

 

বিপন্ন বাইশ

প্রশান্তশেখর ভৌমিক

 

বাইশে শ্রাবণ কেবলই শোক নয় এক আলোকবর্ষের সমাপ্তি বাঙালি জাতি শ্রদ্ধায় করে নত স্মরণের কালে উদ্ভাসিত তৃপ্তি। জাতি এখন বিপন্ন এক স্রোতে ভাষার দখল নিচ্ছে কেড়ে কেউ আমরা কি আর চুপ থাকতে পারি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরি তার ঢেউ। যে ভাষার কবি পেয়েছে নোবেল রত্ন সেই ভাষা আজ বিপন্নতায় ভরা বাইশে শ্রাবণ ঘোর মেঘ করে তাই ছেয়ে দিক এই কালের বসুন্ধরা।

 

একতরফা   

দীপঙ্কর সরকার 

 

বিরহে উতলা আমি তোমার অপেক্ষায় চেয়ে 

থাকি অরুন্তুদ, বেদনা বিধুর। কী করে বোঝাই 

হৃদয়ে যাতনা অপার বিকট ভাঙচুর। 

 

আমি  সেই নাছোড় যুবক তোমার প্রেমেই

হাবুডুবু। যতই এড়িয়ে চলো আমারও জেদ

বাড়ে কিমাকার কিম্ভুত। 

 

এখনও বলতে পারিনি সে কথা। একা একা 

গুমরে মরি, যেদিন দেখেছি প্রথম সেই থেকে 

বড্ড বিচলিত। 

 

ফের যদি দ্যাখা হয় প্রপোজ করব ঠিক, হবে 

না অন্যথা দেখে নিয়ো।

 

শেষ আলো

সৌগত কান্ডার

 

সেদিন যখন সব আলো নিভে এল রাজকীয় ধীরতায়,

খাত বদলানো নদীর অসমাপ্ত সঙ্গীতের মত,

তুমি চলে গেলে মেঘের ওপারে,

এক অনন্ত সূর্যের প্রখরতার দিকে।

তোমার কলম দিনান্তে ঝরে পড়া

ফুলটির মত নীরব হয়ে গেলেও -

তোমার শব্দেরা তখন মুখরতায় অনাবিল।

তোমার সুরেরা তখন ঝর্ণার মত উচ্ছল।

তারা কুহকিনীর মত ছড়িয়ে পড়ল -

দিগন্ত থেকে মহাশূন্যে, শিশির থেকে সমুদ্রে, কন্ঠ থেকে হৃদয়ে।

তারা বয়ে নিয়ে গেল অলাতচক্রের মত

তোমার ঐশ্বরিক বিচ্ছুরণকে -

প্রতিটি গাছে, প্রতিটি ধূলিকণায়, প্রতিটি নক্ষত্রে।

তারাই পৃথিবীর চেতনসৌধের চূড়োয়,

বাইশে শ্রাবণের শেষ আলোকে পৌঁছে দিল

এক নতুন আলোর মোহনায়।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ

দেবব্রত পাল

 

আমার জীবন-যাপনে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ নানা বয়সে নানাভাবে এসেছে। পাঠ্য বইয়ের পাতায় রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি সেই শিশু বয়স থেকে। "ছোটো খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া"। কৈশোরে পাড়ার বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে খুলে দেখেছি ‘সঞ্চয়িতা’-র পাতা। যৌবনে পা ফেলেই প্রেমের অভিসারে ‘মানসী’ কাব্য ধরে হেঁটেছি বহু পথ। জীবনের চড়াই-উতরাই পথে আনন্দ-বিসাদে স্মরণ করেছি রবীন্দ্রনাথকে। কখনও ‘সবুজের অভিযান'-এ কখনও বা 'আত্মত্রাণ'-এ। “বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়”।

এতভাবে রবীন্দ্রনাথকে পেলেও আজ এই মধ্যবয়সে রবীন্দ্রনাথকে মনে রাখতে ভালো লাগে বিচিত্র প্রবন্ধ গ্রন্থের ‘লাইব্রেরি’ লেখাটির মধ্য দিয়ে। সেই সপ্তম শ্রেণি পাঠ সংকলনে পড়া ‘লাইব্রেরি’ শিরোনামে প্রবন্ধের কথা আজও মনে পড়ে। সে প্রবন্ধে গ্রন্থাগারের যে রূপ ও ব্যবহার উল্লেখ ছিল তা আমার বোধগম্যতার বাইরে ছিল। পাঠ মুখস্থ ও পরীক্ষার খাতায় উগরে দেওয়ার বাইরে উপলব্দির গ্রন্থাগার তেমন স্মৃতিতে ছিল না আমার। কারণ সে বয়সে কোনো গ্রন্থাগার দেখা সুযোগ ঘটেনি তখনও।

মোটামুটি ভালো মানের গ্রন্থাগার প্রথম দেখি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তারপর বিদ্যালাভের আশায় শহর, নগরে অনেক ধরনের গ্রন্থাগারে গেছি। দাঁড়িয়েছি সারি সারি বইয়ের তাকের মাঝে। উপলব্ধি করেছি, "লাইব্রেরির মধ্যে  আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি"। "যে যে দিকে ইচ্ছা ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না"।

বর্তমানে আমি গ্রন্থাগার পেশাজীবী। বিদ্যালয়ের কচিকাচাদের আগ্রহের বই পড়ানো, বই পড়িয়ে আগ্রহ তৈরি করা আমার কাজ। শ্রেণি সিলেবাস কেন্দ্রিক  রুটিনের বাইরে আরও কিছু পড়তে চাওয়া কচিকাচার দল নিয়মিত আসে গ্রন্থাগারে। একটা বই ছেড়ে আর একটা বইতে, এক তাক ছেড়ে অন্য তাকে বাধা হীন ভাবে ছুটে বেড়ায় তারা। খুঁজে নেয় সাত রাজার ধন। তাদের এই পাঠভুবনের বিষয়বৈচিত্র্য আমাকে আপ্লুত করে।  মনে করায় রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাংশ, “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, / জ্ঞান যেথা মুক্ত"।

 

২২ শ্রাবণ ২০২৫

শ্রাবণের ধারা

সুমনা মন্ডল

 

সোনার তরী বেয়ে যেদিন পাড়ি দিলে গানের ওপারে 

রূপনারানের কূল তখন প্লাবিত।

কৃষ্ণকলির দু'গাল বেয়ে ঝরেছিল শ্রাবণের অশ্রুধারা।

পড়ে রইল স্বর্ণরথ, রাজবেশ। 

খাঁচার পাখি মুক্ত হয়ে দোসর করেছে বনের পাখিকে 

মাঝ আকাশ থেকে দুই পাখি সাক্ষী ছিল 

তোমার রাজকীয় অন্তর্ধানের। 

আফ্রিকার মহামানবীর অনন্ত প্রেম ছিলে তুমি,

কতবার ভেবেছি তোমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলে

প্রশ্ন করব- 'আর কতদিন অস্তগামী থাকবে?'

পরক্ষণেই জবাব পেয়েছি আত্মজ্ঞানে,

রবির আলোকেই তো আলোকিত এই ধরা

তুমি তো মৃত্যুঞ্জয়, তুমি প্রভাতের শুকতারা।

 

কাগজের নৌকা 

শ্যামলী কর্মকার 

 

কাটানো সেই ছেলেবেলা যেন 

ভারী মনে পড়ে,

জানালার দিয়ে বৃষ্টিরা 

কাগজের নৌকা দিত গড়ে ।

বৃষ্টি বন্ধু বলতো ডেকে 

চুপি চুপি কানে,

ফোঁটায় ফোঁটায় সুরের তরী 

ভাসতো নতুন গানে।

চটজলদি কাগজ দিয়ে 

নৌকার কারুকাজ,

ছুটে গিয়ে বাইরে দেখি

খোলা আকাশের রংবাজ।

জলছবিতে নৌকা ভাসিয়ে

সেই আনন্দে মেতে থাকা ,

ভিজে যাওয়া নৌকা গুলো 

চলে আঁকা বাঁকা।

আজও যেন স্মৃতিগুলো

দিয়ে যায় ডুব,

বারান্দায় চায়ের কাপে 

চুমুকে নিঃশ্চুপ।

 

তোমার অরূপরতন রাজে


লিপিমিতা তনুশ্রী

 

 

শ্রাবণ মানেই অঝোরধারায় তুমিহীন  দু'নয়ন

শ্রাবণ মানেই বিষণ্নতার বাইশের বরিষণ!

তুমি তো নও শুধু কবীন্দ্র, হে রবীন্দ্র —

দিনযাপনের প্রতিক্ষণে ষড়ঋতুর আবেশ জুড়ে 

আবর্তন-বিবর্তনে যুগে-যুগান্তরে, জীবনের

প্রতি পল-অনুপলে তোমাকেই স্মরি  হে বিশ্বকবি—

তোমাতেই গড়ি নিত্যনতুন আপনারে জীবন-খেয়া পারাবারে।

তোমার বাণী মর্মবাণী তোমার সৃষ্টি হীরক দ্যুতি

অনন্ত সে বর্ণছটা রবিকিরণ আলোকজ্যোতি।

বিশ্বভুবন  হৃদয়-মাঝে তোমার অরূপরতন রাজে

শব্দ-কথা দিব্যকান্তি নিত্য বিরাজ করে,  

ছন্দ-তানে রঙ-তুলিতে ভরা সবুজ সাজে

তোমার সৃষ্টি হৃদয় ছুঁয়ে কুসুম মাল্য গাঁথে।

গহন-গহীন আকুলতা বিদায়বেলায় বাজে

প্রকৃতি-মানব এক হয়ে যায় শ্রাবণ ধারাপাতে।

 

জড়িয়ে

মালা ঘোষ মিত্র

মেঘমেদুর আকাশে শ্রাবনের ধারা
জুঁই, বকুল ফুলের গন্ধে
কাজ ভুলে পাগলপারা মোহিনী
ভৈরবীতে কে যেন গেয়ে ওঠে
" এসেছিলে তবু আসো নাই"
করুণ সুরে এস্রাজ বেজে ওঠে
শ্রাবণের উত্তাল রাতে,
জ্যোৎস্না এসে পড়েছে বারান্দায়,
বৃষ্টির গন্ধে চারিদিক অন্ধকার
কবির বাণীর অমৃতকথা
শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে
মন শান্ত হচ্ছে,
বাঁচার রসদ খুঁজে পাচ্ছি,
'গীতবিতান', সঞ্চয়িতা, জড়িয়ে
ঘুমিয়ে পড়ি জলধারা চোখে।

 

অন্তরের রবি ঠাকুর

পপি মৈত্র

 

মোর ভাবনার অন্তরে বিকশিত তব আলো

হে ঠাকুর তুমি আমার কল্পনার জ্যোতিষ্ক

তব রক্তিম ছটায় উদ্ভাসিত মম যৌবন পারম্ভ

অবসরে ব্যস্ততায় তোমার উপস্থিতি সর্বক্ষণ

বিরহে তুমি অঝরে ঝরে শান্ত কর এ হৃদয় 

তোমার নীরব স্পর্শে জাগরিত এ মন-প্রাণ।

 

মনের দোলাচলে তোমার নয়নে খুঁজে পাই

আমার দুর্বল সিদ্ধান্তের কঠিন সমীকরণ

বেয়াদব ভালবাসায় চুরি যাওয়া হৃদয়ে 

 একাত্ম হয় তব প্রাণ___সে আমার ঈশ্বর

তোমার স্থান মোর হৃদয়ের প্রতিটি অণুতে

আমি সর্বদা থাকি তোমার চরণ প্রাঙ্গণে ...


আপনজন 

গোবিন্দ বারিক 

 

আমাদের মাঝে শান্তি নেমে এলো।"শ্যামলী" মাটির বাড়িটিতে প্রবেশের দ্বারে স্বাগত জানায় "সাঁওতাল সাঁওতালনি"। অন্তরালে গোপন যুবা রামকিঙ্কর -- 

 

আমার উত্তাল হৃদয়ে খর-দুপুরের পৌষ, আমার স্ত্রীর মতো মুখখানা যেন স্নিগ্ধ শ্যামলিমা মায়া প্রাণে ঢেউ তুলে "পুনশ্চ"। আমাদের বাড়ির মতো মাটির দেওয়াল, বনলতা পথ একখানি ঘর 

এক পাশে খোলা বারান্দা কাঁচ দিয়ে ঘেরা 

যেন রবি ঠাকুরের গানে খুঁজে পেয়েছি অমৃত চরাচর। 

 

আমাদের লাল সুরকির ঘ্রাণ, লবণাক্ত গ্রামের গন্ধ সাজিয়েছে আম্রকুঞ্জ বিনম্র পান্থশালা তালধ্বজ উপাসনা গৃহ নিরব ছাতিমতলা সাঁচি স্তুপের ঘন্টা তলা কালো বাড়ি যেন জীবন্ত আমাদের জীবনের কথাগান।

 

খোয়াইয়ের হাট, সোনাঝুরি মাঠ, অপরাহ্নের বাতাসে কপাল ছোঁয়া দু'চারটে চুল যেন সব কাছাকাছি, চেনা লোকজন, বিভূতি সম্পর্কের চুপচাপ আনন্দলেহন। শীর্ণ জলের স্রোত, কোপাই যেন আমাদের কত আপনজন

 

আসে বাইশে শ্রাবণ, আসে নীরবতার তূর্য ধ্বনিগুলি

তাপস রায়

 

পথে শ্রাবণ আঁকা, চোখে পড়বে ধানের পাতারা অভিবাদনরত

নির্জনতা বয়স পেয়েছে কোথাও মনে হতে পারে,  ভিজে আছে

পুকুরের জল, কলমির শাক, এমন কি রোদ্রের আগাপাস্তালা

কেমন নরম নরম

 

তাহলে কি মন খারাপের কাল এল! অতটা নেতি-ও যেন মানাচ্ছে না

রবীন্দ্রঠাকুর ধীরে নিদ্রিত হতে যান, ভিড় বাড়ে, গোটা কলকাতা

ঘুরে এসে থামে এই দিকে । চিৎপুরে আতর বিক্রি বুঝি 

                                                          আজ আর হবে না তখন

 

এক একটা যাওয়ার ভেতর কত যে ঘর-বাড়ি ভেঙে-চুরে পড়ে

যে্টুকু মানাবে না জানো, লুকিয়ে রেখেছ, রাখো ফুলের স্তবক

কালো চশমারা বলো কত অশ্রু ঢেকে দিতে পারে! ক্রমে কেঁদে ফেলে

       গাঙ্গেয় বঙ্গভূমিখানি 

 

অক্ষরের পাশে এসে অন্য অক্ষরেরা আজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে

সবাই জেনেছে আজ বাইশে শ্রাবণ

 

মৃত্যুহীন ইতিহাস 

মহুয়া জানা 

 

একটা ইতিহাসের মৃত্যু ?

নাকি একটা মৃত্যুর ইতিহাস ! 

তরতরিয়ে লিখতে চেয়ে থেমে যায় কলম 

ডুকরে ওঠে শ্রাবণ সন্ধ্যার ধারাপাত ।

এপারের বহতা দুঃখ কাঁধে 

কে যেনো পাড়ি দিচ্ছে ওপারে ---

সেতুটা জড়িয়ে আছে অসংখ্য জীবনদায়ী গাছ ।

চোখে যার সাত্ত্বিক সরোবর ,

কন্ঠে কত জিজ্ঞাসার হার --- 

আপামর অশ্রু গ্রহন করে শান্ত হয়েছে কপাল । 

তবু ঠোঁটে যেনো আনন্দগান --

আর অগন্তি নতজানু বাগিচা বুকে 

পেরিয়ে যাচ্ছে নিঃসীম অন্ধকার । 

 

রবীন্দ্র প্রভাত

মধুমিতা পাল

 

তুমি এক রহস্যময়,বর্ণনাতীত,অলীক স্বপ্ন...

প্রভাতী ঊষার আলো আজও তোমার অভিবাদনে অভিষিক্ত-  

তুমি তমশাচ্ছন্ন আঁধারেও যুগ যুগান্তর ঊষার আলোর মতই সপ্রতিভ,সমাদৃত উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক 

 

ধরিত্রীর সৃজন সব প্রভাতই তোমার ... 

শুধু সেদিনের সেই কিছু প্রভাত- 

তোমার তপ্ত কিরণ সুধায় বিগলিত করেছিল নিজেকে- তোমারই জীবন্ত অস্তিত্ব দিয়ে... 

এখনো তুমি সেই স্নিগ্ধ শীতল ভোরের প্রভাতেই রয়েছো...

শুধু নেই- তোমার সেই জীবন্ত নিঃশ্বাসের এক বিন্দু ছোঁয়া- বিশ্ব উদ্ভাসিত,হৃদয় মুখরিত একটি আবেগী রবীন্দ্র প্রভাত আজ ...।

 

 

তোমায় ছুঁয়ে কষ্ট ধোওয়া

বীথিকা পড়ুয়া মহাপাত্র 

 

ঝরছে বুকে শ্রাবণ বৃষ্টি ধারা,

চারদিকেতে জীবন অনিশ্চিত! 

শান্তি একটু খোঁজে বুকের পাঁজর,

ভয়ের শীতল বাজনা বাজায় শীত!

 

গীতাঞ্জলির পাতায় রাখি মুখ,

কবি তোমার সুরে মেলাই সুর,

চারপাশেতে মৃত্যু আয়োজন, 

হারিয়ে গেছে সুখের গৃহপুর!

 

স্বপ্ন দেখি সবার সকল কান্না

রেখেছি সবুজ শালুক পাতার পরে,

সঞ্চয়িতার আবৃত্তি সুখ ছুঁয়ে

কষ্ট ধুয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।

 

বাইশে শ্রাবণ বুকে বইছে ব্যথা,

হারাই খুঁজি তোমায় বারে বার,

মেঘলা আকাশ দুনয়নে শ্রাবণ, 

তোমার অভাব দুঃখ সমাচার!

 

বাইশে শ্রাবণ

সুমিতা মুখোপাধ্যায়

 

হৃদয় যেদিকে চায়,বেদনায়, বৃষ্টিতে

দেখি তাকে হারাবার,ফিরে পাবার কথা লেখা থাকে,

পায়ে দাহ্যলতার হাহাকারটুকু বাঁধা

আমি আগুনের চেয়েও নিরুপায়, 

অনন্তর, কোথায় আর, ফিরে চলি পৃথিবীতে

পথের পাশে কাদাজল, দাঁড়াই, যে হাওয়া

তার ক্ষীণশ্বাস নিয়ে গেল,সে ছিলো  আমার বাইশে শ্রাবণ!

সত্যি কি তুমি চলে গেলে -

এমনি দিনে ভরা বর্ষায় এমন ও বৈশাখের বসন্তে শ্রাবণধারায় কবিতায় গানে তোমায় খুঁজে চলি

নীরবতায় ভাসমান মেঘমুক্ত তাঁর ভাষা ,

প্রতিটি দিনই তোমার জন্ম আমার কবিতায় ,প্রতিটি যাওয়া মানে আমার বাইশে শ্রাবণ।।

 

দুঃখের ত্রাতা রবীন্দ্রনাথ

বনশ্রী রায় দাস

 

দিশেহারা হয়ে হারিয়ে ফেলি পথ

ভাবনাগুলো এলোমেলো পাঁচসাত

জানি আসবেন সঙ্গে নিয়ে পুষ্পরথ

দুঃখের ত্রাতা তিনি যে রবীন্দ্রনাথ

 

ভিতর ঘরে হঠাৎ করেই ভীষণ

আসে যখন ঝড় ঝঞ্জা অভিঘাত

খোয়াই বলে, ভয় পাচ্ছ অকারণ

হৃদয়ে তো আছেন কবি রবীন্দ্রনাথ

 

আনমনা আমি অনিশ্চিত পথচলা

কে জানে কখন হই কুপোকাৎ

সেদিন ও গানের সুরে শেষ বিদায়

চমকে দেখি হাত ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ

 

শ্রাবণে প্লাবনে

তাপস বৈদ্য

 

অতএব এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে,

বৃষ্টি হোক বা না হোক আজ বাইশে শ্রাবণ।

 

তুমি যদি পঁচিশে বৈশাখী হয়ে পলাশপার্বণে

বা নীপবনে ছায়াবীথি তলে আঁচল মেলো,

আমি তাহলে অশ্রুনদীর সুদূর পারে বা

বাদলের গগনের কাছে জমা রেখে যাব একটা

গোটা জীবনের অসাফল্যমণ্ডিত ইস্তেহার।

 

বৈশাখ বলো আর শ্রাবণই বলো, আসলে

এরা আমাদের দুই প্লাবন। আর এদের মাঝে

কখনও ঝড়ে, কখনও বর্ষায় উড়তে থাকে,

ভাসতে থাকে, না নেওয়া সিদ্ধান্তরা এবং...।

 

শ্রাবণের বাইশ

নীলম সামন্ত 

 

শ্রাবণের বাইশ, তেরোশ' আটচল্লিশ বঙ্গাব্দ। 

নতুন বৌঠান নেমে এলেন ছাদবাগানে 

রবির সমস্ত আলো পাখিবেশে 

"আমলকী বন(এ) কাঁপে, যেন তার বুক করে দুরুদুরু" । 

 

অমলতাসে ফুল নেই, কোপাই ভর্তি জল, 

ভাইছুটি রুমঝুম শব্দে নৌকা থেকে নেমে আসছেন, 

"পাতা খসানোর সময় হয়েছে শুরু"

 

কুমড়োর কেক কি কেউ তৈরি করল? 

মুসুরডালের গুঁড়োয় মোড়া কাতলা মাছ? 

 

রবি হাসছেন, মুক্তি প্রতিফলিত কড়িবরগা 

খাওয়ার সময় নেই, 

ঈশ্বর পায়চারি করছেন অসংলগ্ন পায়ে 

ঘরে বাইরে মাথা তুলছে একটা একটা রক্তকরবী

 

উনি কি বললেন — "আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে"


কবি

সুদর্শন দেববর্মন 

 

শ্রাবণ এলে কেঁদে ওঠে বর্ণমালা,

রবীন্দ্র কলমে ঝরে নীলজল ধারা।

মেঘলা আকাশে বাজে মন-হারানো সুর,

তার গানেই নামে শ্রাবণ-বিধুর।

 

কান্না আর ভালোবাসা — পাশাপাশি,

বৃষ্টি তার প্রেমের চিরসাথি।

"মেঘের পরে মেঘ জমেছে," তিনি লেখেন,

ভেজা পাতার মতো হৃদয় ভাসে দেখা ফেলে।

 

"সীমার মাঝে অসীম" খোঁজে কবি,

শ্রাবণ বুকে আনে সেই চির প্রেম-রবি।

অভিসারে যে বৃষ্টি, বিচ্ছেদেও তাই,

রবীন্দ্র কথায় শ্রাবণ যেন নিঃশ্বাস ভাই।

 

"বাঁধা পথে বাঁধা সুরে" বয়ে চলে গান,

শ্রাবণে তার কাব্যে খেলে প্রাণ।

রবীন্দ্রের শ্রাবণ — রাগ, অনুরাগ, অনন্ত ডানায়,

ভাসে শব্দে, সুরে, হৃদয়ের গভীর গাঁথায়।

 

জীবন মুক্তি

সংগীতা মাইতি

 

বর্ণ পরিচয় শিখেই আমি

গিলেছি সহজ পাঠ

সবার মুখে শুনে এসেছি

জন্ম ২৫শে বৈশাখ ।

বড় হয়ে চিবিয়েছি

গীতের গীতবিতান

স্পর্শ করেছি ছোট গল্প

শুনেছি নাটকেও গান।

প্রবন্ধতে চোখ খুলেছে

উপন্যাসে ভক্তি

উজাড় করে দিয়ে গেছেন

২২শে শ্রাবণে পান মুক্তি।

 

২২শে শ্রাবণ যেন চিরজাগরণ

মৌ মধুবন্তী

 

যে রবীন্দ্রনাথকে আমি আমার সারা জীবনের প্রেম করে নিয়েছি, সেই তিনি যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তখন আমার মায়ের ও জন্ম হয়নি। তবু তিনি জ্বলজ্বলে জ্বলে আছেন আমার অন্তরগহনে।

২২শে শ্রাবণ। বিদায়ের আগমন। শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে থাকা এক শোকগাঁথা। ১৯৪১ সালের এই দিনে, দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিঃশব্দে থেমে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদস্পন্দন। বাইরের আকাশে ঝরছিল শ্রাবণের জল, আর ভেতরে নিঃশেষ হচ্ছিল এক মহাকাব্যিক জীবন।

কিন্তু এই দিন কি শুধুই মৃত্যুদিন? না কি কবির অন্তরাত্মা এই দিনেই লিখে রেখেছিল এক অমর কবিতা?

রবীন্দ্রনাথের জীবনে ২২শে শ্রাবণ বারবার এসেছে। কখনও গল্পে, কখনও কবিতায়, কখনও স্মৃতিতে। তাঁর “২২শে শ্রাবণ” নামক কবিতায় তিনি লিখেছেন—

“হে বন্ধু, বিদায়। কোনদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে বসন্তবাতাসে অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস…”

এই পঙ্‌ক্তিগুলো কি তাঁর নিজের অন্তিম অনুভবের পূর্বাভাস?

আমরা জানি না, ২২শে শ্রাবণ সকালে কবির মনে কী চলছিল। কিন্তু যদি অন্তর্যামী জানেন, তবে হয়তো তিনি দেখেছেন—কবি তাঁর শেষ শ্বাসে শ্রাবণের বৃষ্টিকে ছুঁয়ে বলছেন, “আমি যাচ্ছি, কিন্তু রেখে যাচ্ছি আমার গান, আমার কবিতা, আমার প্রেম।”

হয়তো তাঁর অন্তর বলছিল—

“আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে

সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে।”

২২শে শ্রাবণ তাই শুধু একটি দিন নয়, এটি এক অন্তর্লীন সেতু—যেখানে কবির জীবন, মৃত্যু, সৃষ্টি ও শোক একসাথে মিশে যায়।

এই দিন, এই বৃষ্টি, এই নীরবতা—সব মিলিয়ে যেন কবির আত্মা বলে ওঠে,

“মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান”— এই উপলব্ধি দিয়েই কবিগুরুর ২২শে শ্রাবণ যেন চিরজাগরণে রূপ নেয়।

 

প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

অভিজিৎ দত্ত 

 

রবীন্দ্রনাথ, তুমি সত্যিই ছিলে 

এক বিষ্ময়কর প্রতিভা 

গান,নাটক, লেখা,ছবি ও কবিতা

সবেতেই ছিল তোমার 

বিষ্ময়কর প্রতিভার ছোঁয়া।

 

তুমি ছিলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, দার্শনিক 

তুমি ভীষণ ভালোবাসতে প্রকৃতিকে 

চেয়েছিলে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করে

 আমাদের গড়ে তুলতে। 

 

তুমি ছিলে ভারত তথা এশিয়ার 

প্রথম নোবেল বিজেতা 

বিশ্বভারতী,শান্তিনিকেতন সহ

অনেক কিছুরই প্রতিষ্ঠাতা। 

তুমি ছিলে দেশপ্রেমিক 

দেশ নিয়ে রচনা করেছিলে

অনেক গান ও কবিতা ।

 

শ্রাবণ এলে ভয়ে ভয়ে থাকি 

কিশোর নাগ

 

প্রতিবার শ্রাবণ এলে আমি ভয়ে ভয়ে থাকি 

আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলেই 

বেসামাল হয়ে পড়ি

মনে হয় নিষন্ন দুপুরে জানালার গায়ে 

আটকে যায় রবীন্দ্র স্বরলিপি 

আমার সমক্ষে থাকা প্রতীক হারিয়ে যায়

যেন ছন্দহীন ডালপালা 

মনে হয় সময়টা ভীষণ দুর্ভার 

 

প্রতিবার শ্রাবণ এলে আমি ভয়ে ভয়ে থাকি

আরও একটা বাইশে শ্রাবণ হাতছাড়া হওয়ার 

সময় চলে আসে...

 

কালজয়ী 

শ্রাবণী বসু 

  

স্বর্ণ চাঁপার মৃদু ,মধুর সুগন্ধের মতো

বাইশে শ্রাবণ আসে চোখ ভরা জল,

বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে।

 

স্মৃতিরা উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়,

যদিও ওড়ার জন্য পাখির মতো ডানা নেই।

 

গীতবিতানের চিরহরিৎ অক্ষরগুলো

মেঘপ্রজাপতির হাতে হাত রেখে

নাচের মুদ্রায় ইন্দ্রজাল বিস্তার করে।

 

স্তব্ধতার সংলাপ জুড়ে সঞ্চয়িতার কবিতাগুলি

হাঁসের মতোই সাঁতার কাটতে কাটতে

সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে রাত্রি,

মাস পেরিয়ে বছর , বছর পেরিয়ে যুগ ডেকে নেয়।

 

পুনর্জন্মের জন্য 

স্বপন শর্মা 

 

আমার পুনর্জন্মের জন্য চাই  

একটি বাইশে শ্রাবণ , 

জ্যোৎস্নাক্রান্ত রাত,

সমস্ত দুঃখ ও ক্লান্তির ভেতর 

প্রেমের পদাবলী গান । 

 

বাইশে শ্রাবণে সীমাহীন শূন্যতা কাঁদে 

জন্ম দেব ,জন্ম দেব বলে  

শূন্যস্থান পূরণের জন্য 

আমাকেই নতুন করে জন্ম দিক পোয়াতি সময় ।  

 

একমাত্র বাইশে শ্রাবণেই  

হারানো আমাকে ফিরে পেতে পারি 

যখন সূর্য ফের উদয় হবে আকাশে 

বাতাসে ভেসে বেড়াবে ভৈরবী সুর ।  

 

 আসুক বেদনাহীন বাইশে শ্রাবণ

পুনর্জন্মে ভুলে যাব কার্য ও কারণ । 

 

বাইশে শ্রাবন আমার অনুভব


শ্রুতি সামন্ত

অক্ষরে অক্ষরে অক্ষয় নির্মাণ
তোমার শ্রাবনের জলধারায়,
প্রহর জুড়ে তুমিই শুধু রবীন্দ্রনাথ,
এসো বাইশের জয়টিকা পরে,
আমরা বিহ্বলতায়  দিশাহারা

পথ হারাবো, আমাদের যে
নেই রবিঠাকুর,
তোমার মতো সোনার তরী।
ভাসাবো নিরুদ্দেশ যাত্রায়
জীবন মৃত্যুর বাইশে শ্রাবন।

 

মৃত্যু  ও রবীন্দ্রনাথ

তপন তরফদার


জন্মিলে মরিতে হইবে কথাটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু  কথাটি কত ভয়াবহ বুঝতে পারে যখনি নিজের  ঘনিষ্ঠ জনের মৃত্যু  হয়। পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে  চলে যায়। আমরা জানি,রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে দেখেছেন ছোট্ট বেলা থেকেই, খুব কাছ থেকে। জীবনের বিভিন্ন ধাপে এক একটি মৃত্যু এক এক ধরনের শোক গেঁথে দিয়েছিল কবির মনে যা বিভিন্ন কাব্যে লেখনীতে প্রকাশিত। একেবারে শৈশবে হারিয়েছিলেন ছোট ভাই বুধেন্দ্রনাথ কে। যদিও সেদিন মৃত্যুকে উপলব্ধি করার মত বয়স হয়নি -- তাই সে মৃত্যু তেমন ভাবে ছাপ ফেলতে পারে নি। কিন্তু কৈশোরে মাত্র তেরো বছর বয়সেই হারালেন মা সারদা দেবী কে। রাতে সারদা দেবীর মৃত্যু হলেও রবি মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেলেন সকালে ঘুম থেকে উঠে। বাইরের বারান্দায় এসে যখন দেখলেন সুসজ্জিত খাটের উপরে সারদা দেবী শায়িত.... তখনও মৃত্যুর ভয়ঙ্কর রূপ উপলব্ধিতে আসে নি। কিন্তু শ্মশান যাত্রার সময় যখন মৃতদেহ সদর দরজার বাইরে নিয়ে যাওয়া হল.... তখনই  শোক বিহ্বল ঝড়ের দমকা হাওয়ার মতো এসে মনের ভিতর হাহাকার তুলে দিল। উপলব্ধি করলেন.... মা আর কোনদিন এই চিরজীবনের জন্য ফিরে আসবেনা।  শ্মশান থেকে ফিরে এসে দেখলেন..... পিতা দেবেন্দ্রনাথ তখনও তাঁর তেতালা ঘরের সামনের বারান্দায় সূর্যের দিকেমুখ করে উপাসনায় বসে আছেন। 
বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের মনে এক বিশেষ দাগা দিয়ে হৃদয়ের গভীরে  ক্ষতচিহ্ন থেকে যায়। পরবর্তীকালে  লিখেছেন-
"যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে।

 চুকিয়ে দেব বেচা কেনা মিটিয়ে দেব গো,

মিটিয়ে দেব লেনা দেনা বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে।" চিরসত্য কথাটি চিরন্তন  ভাবনার ফসল রুপে চিরতরে আমাদের হৃদয়ে চিরকাল স্মরণ করে যাব।

 

বাইশে শ্রাবণ

প্রবীর চক্রবর্ত্তী

 

কালো মেঘ থেকে ঝরে পড়ছে টুপটাপ 

সোহাগী বৃষ্টি 

পথশ্রমে ক্লান্ত সময় খুঁজছে স্বস্তির আশ্রয় 

যেমন মৌমাছি খুঁজে নেয় মধুকলি 

স্নিগ্ধ আলোকছটা প্রেরণা হয়ে ওঠে 

সমস্বর হয়ে ওঠে প্রারম্ভিক সঙ্গীত ।

 

হাজার বছরের প্রতীক্ষার অবসান হয় 

অপরিচিত মুখ পরিচয় খুঁজে পায় ।

বাইশে শ্রাবণ 

আমার ঠাকুরঘরে জ্বলে ওঠে আমার বিবেক।

 

রবিরং
কৌশিক চক্রবর্ত্তী

(১)


ভিড় সামলাচ্ছে কেউ কেউ

অভিন্ন উচ্চতায় প্যান্ডেল টাঙানোর কথা

বাঁশ হাতড়ে খোঁজ পড়েছে বই
রবীন্দ্র রচনাবলী ষোড়শ খণ্ড...
টুকরো সাম্রাজ্য জোড়া লাগালে
ঠাকুরের জন্মলগ্ন দীর্ঘায়িত হয় আরও...

(২)


পানীয় জলের যোগান পর্যাপ্ত
বোতলে ভরে নিন শীতল শ্লোগান
মুখে উড়ে আসতে পারে গণতান্ত্রিক ভোর
সকাল হবে
এগিয়ে আসবেন রবীন্দ্রনাথ
রাস্তায় পরাবাস্তববাদীর ক্রমশ অনুসরণ...


(৩)


এবার পুজো
ফুলের উপাচার শূন্যতার পরিপন্থী
ধার্য হোক ঝুরোবালি-

মালা দাও গলায়-
তেত্রিশ কোটি প্রবঞ্চনা
এবং একটি মাত্র নির্বাপিত গোধূলির রং...


(৪)


বিসর্জনের সুর সংযমী
ঠাকুরের জন্মপথে উজানী সংশ্লেষ
রবিসন্ন্যাসের কথা উহ্য

ডিভাইড অ্যান্ড কনকার রুলে
সকলে উপকরণ ধরে আছে দু'হাতে...
উপরন্তু জোড়া লাগছে জোড়াসাঁকোর ব্যবচ্ছিন্ন ছাদ...

(৫)


এবার পঁচিশের ডাকে
হাতে এসেছে হারানো গোধূলি
ঘর চিনে নিচ্ছে রবিপ্রেমিক...

বিনিময়প্রথায় শিলমোহর দিয়েছ-
সমস্ত একনিষ্ঠ ঘাসমাঠের বদলে
জড়ো করেছি পুনশ্চর হারানো যতিচিহ্ন...
 

 

রবীন্দ্রনাথ 

শক্তিপদ পাঠক

ব‍্যথানাশক এক আশ্চর্য মলমের নাম রবীন্দ্রনাথ।

তাঁর কবিতা ও গানের প্রলেপ দিলে শান্ত হয় অস্থিরতা,

বিরহ বিচ্ছেদ মৃত‍্যুভয়।

ভাঙা মন জোড়া লাগে।

মৃত গাছে নবপত্র জাগে, ফুটে ওঠে আনন্দকুসুম।

পরাজিত সৈনিকেরা ধুলো ঝেড়ে উঠে বসে।



রবীন্দ্রনাথ, নদীবক্ষে ভেসে যাওয়া সহজ পানসি,

ঢেউয়ের আনন্দ বুকে কলকল গতির আবহে

স্থবিরতা ঝেড়ে ফেলা বুকটান মাঝি।

গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠা সারি জারি ভাটিয়ালি গান,

কথাগুলি বুকে এসে নাচে,

জলের ছলাৎ শব্দে পাড় ভাঙে,

পশ্চিম আকাশে জাগে চাঁদ।

 

https://youtu.be/Xbj4r4_1xag




মহাপ্রয়ানের ৮৪ বছর  

শংকর সামন্ত

বিশ্বকবির ২২শে শ্রাবণের মহাপ্রয়াণ মহাযুগের মহা সন্ধিক্ষণের অবসান। কবি তাঁর দর্শনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের যা কিছুকে অন্তরাত্মা দিয়ে সব কিছুরই আস্বাদ গ্রহণ করেছিলেন। জন্ম-মৃত্যুকে তিনি সমরেখায় রেখেছেন। কোনো তফাৎ অনুভব করেননি। তাই তিনি বলতে পেরেছেন—

"তখন কে বলে গো

সেই প্রভাতে নেই আমি

সকল খেলায় করব খেলা এই আমি—"

 

কবি বলেছেন—

"আজি হতে শতবর্ষ পরে

কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি

কৌতুহল ভরে,

আজি হতে শতবর্ষ পরে।"

কবির মহাপ্রয়ানের ৮৪ বছর পরেও সাহিত্যের আকাশে কবির রবি-প্রাতে প্রভা আরও দীপ্তিমান, আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। তিনি ক্ষণজন্মা শুধু ঠাকুর পরিবারে নয়, সাহিত্যাকাশে নয়, সমগ্র বিশ্বের সাহিত্যের দরবারে। তাঁর সৃষ্টি—সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলার আলোকে সমগ্র বিশ্ব আলোকিত। তাঁর চিন্তায়, ভাবনায়, দর্শনে তিনি চিরভাস্বর। তাই তিনি বিশ্বকবি। তাঁর বিশ্ববোধ, বিশ্বমানবিক চেতনা—সেখানে জাতিগত, রাষ্ট্রগত ভেদাভেদের প্রাচীর নির্মূলের কথা বারবার বলেছেন তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে, লেখনীর মধ্য দিয়ে। তাই তিনি বিশ্বের সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করে, এক জাতি, এক প্রাণের সুর-ঝংকার তুলতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বলেছেন—

"জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে"

আবারও বলেছেন—

"হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক, মুসলমান, খ্রীস্টান—

পূর্ব-পশ্চিমেকে একই দিগন্তরেখায় প্রেমের বার্তা দিয়েছিলেন।"

রবীন্দ্রনাথ—দুর্ভাগা দেশের দুর্গত মানুষের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিলেন আশার আলো হিসাবে। মুক্তির পথও দেখিয়েছেন।

তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত হয় বড়কাকা ও শ্যামার তত্ত্বাবধানে। তাঁর পাঠজীবন শুরু হয় বাড়িতেই। তাঁকে ‘নর্মাল স্কুল’ ও ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারী’ বিদ্যালয়ের শিক্ষা চারদেওয়ালের কুঠিনীতিতে বেশিদিন আবদ্ধ করতে পারেনি। তাঁর জীবনবোধ ছিল মুক্তবাতাস, মুক্তজীবন—তাই বাড়িতেই কবির পাঠশালা শুরু হয়।

তাঁর স্মৃতিচারণায় জানা যায়—মা বিভার শিক্ষকের কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাহিত্য, বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। শিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য, হরকুমার সম্ভবত বাংলায় অনুবাদ করাতেন। তাঁর শৈশবকাল থেকেই কবি সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত করেন। বর্ণপরিচয়ে "জল পড়ে পাতা নড়ে"—এই ছোট লাইনেই তাঁর হৃদয়বীণার তারে ঝংকার তোলে। সেই ছোট বয়সের ছোট কবিতার অনুরণন কবির সমস্ত চেতনায় মিশে গিয়েছিল।

 

তিনি সৃষ্টি করেছিলেন—

‘বনফুল’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’—

এই কবিতার মধ্য দিয়ে কবির আবেগ ও চিন্তার উন্মোচন ঘটেছিল। কবিতায় লিখেছেন—

"পতিত পঙ্কজে জাগিছে উঠিছে প্রাণ

ওরে উঠলি উঠিছে বারি

ওরে পানের বেদনা ধারের আগে রুধিয়া রাখিতে নারি।"

তিনি ছিলেন রোমান্টিক, তেমনি ছিলেন নিসর্গপ্রেমিক। প্রকৃতির সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর আত্মীয়তা, এবং এক অপার ভালোবাসার বন্ধন। কঠোর বাড়ির চৌহদ্দিতে থেকেও তিনি অনুভব করতেন প্রকৃতির আহ্বান—পাঁশবিক ঘটনার, গ্রীষ্মের রোদদগ্ধ আফসোস, প্রকৃতির রোদের যন্ত্রণা, উড়ন্ত চিলের ডাক, নিঝুম দুপুরে ফেরিওয়ালার হাঁক, খাঁচার পাখির সঙ্গে বনের পাখির সঙ্গের যন্ত্রণা—সবই তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করতেন।

তার কবিতায় দন্দ্ব-সংঘাতময় জীবনের নানা অনালোকিত ধারার উন্মোচন ঘটে। ভারতের অতীত গৌরব ও ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে দেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যে রবীন্দ্রকাব্যধারার এক নতুন মোড় দেখা যায়। শুরু হয় অধার ও অসীমের লীলালোক দর্শন।

তিনি রচনা করেন—

খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতালী, গীতিমালা।

তাঁর কবিকর্ম পুরস্কারস্বরূপ লাভ করে—

নোবেল পুরস্কার।

তাঁর কবিপ্রতিভা পায় বিশ্বকবির স্বীকৃতি।

তাঁর কবিজীবন শুরু হয় ১৪ বছর বয়সে, সমাপ্তি ঘটে ৮০ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। তাঁর স্পর্শে প্রতিটি শাখা সোনার মতো উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় হয়ে উঠেছিল। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক।

তাঁর প্রথম উপন্যাস—বউঠাকুরানীর হাট, ঐতিহাসিক উপাদানে সমৃদ্ধ।

দ্বিতীয় উপন্যাস—রাজর্ষি,

সামাজিক উপন্যাস—চোখের বালি, মৌরসুমী, নৌকাডুবি ইত্যাদি। তবে গোরা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

শেষের কবিতা একটি অদ্বিতীয় উপন্যাস।

 

তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা শতাধিক। তার মধ্যে কাবুলিওয়ালা, অতিথি, পোস্টমাস্টার, সমাপ্তি, ভুল, গুপ্তধন ইত্যাদি গল্পে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, বেদনার অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে। তাই বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও এ এক অমূল্য সম্পদ।তাঁর নাট্যজগৎও ছিল সমান সমৃদ্ধ। নাটকগুলো মূলত গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, নৃত্যনাট্য, রূপকধর্মী ও হাস্যরসাত্মক। তিনি প্রচলিত নাট্যধারার বাইরে এসে নতুন রীতি ও আঙ্গিকের প্রবর্তন করেছেন। তাঁর নাটক—রক্তকরবী, রাজা ও রানী, চিরকুমার সভা প্রভৃতি। তাঁর রচনায় বিষয়ের বৈচিত্র্য, বাক্যের নতুন গঠনভঙ্গি এক অপূর্ব সাধনায় পরিপূর্ণ।

তাঁর প্রবন্ধও সেই একই ধারায় সমানভাবে বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। তাঁর সাহিত্যকীর্তির পরিসর বিশাল, বলা যায় সমুদ্রের মতো অতলান্ত।

তিনি বিদেশী কৃত্রিম শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন গানের সম্রাট, দেশানুরাগী ও শিক্ষাবিদ। শান্তিনিকেতনে শিক্ষা ব্যবস্থার নতুন ধারা চালু করে সেই প্রমাণ রেখেছেন। তিনি ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। তার প্রমাণ—জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ইংরেজ সরকারের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেন।

তাঁর দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে জাতীয়তাবোধ, দেশের প্রতি প্রেমের প্রকাশ ঘটে। তাঁর লেখা গান—ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এসব গানের মাধ্যমে তিনি জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাই তিনি কেবল গানের রাজা নন—গানের সম্রাট বললেও অত্যুক্তি হয় না।

বিদেশের মাটিতেও ভারতবর্ষের কৃষ্টি, সংস্কৃতিরMতাঁর সৃষ্টিকর্মের সাক্ষর বিশ্বের দরবারে স্বীকৃত। তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যের কৃতিতম আসনে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান— অপরিসীম ও চিরস্মরণীয়।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট, বাংলা ১৩৪৮ সনের ২২শে শ্রাবণ, বিশ্বকবির মহাপ্রয়াণ ঘটে।

মহাপ্রয়ানের ৮৪ বছর পরেও রবির আলো ম্লান তো হয়ইনি, বরং তা আরও দীপ্তিমান, আরও উদ্ভাসিত। তিনি পদে পদে চলমান, তাঁর গতি থেমে যাওয়ার নয়।

সহস্রাব্দ পেরিয়ে, সময়কে পিছনে ফেলে তাঁর সৃষ্টি, তাঁর চেতনা, তাঁর ভাবনার আলোকধারা

এগিয়ে নিয়ে যাবে মানবজাতিকে। তিনি কালজয়ী, তিনি অক্ষয়, তিনি অমর। তিনি চিরন্তন, মানবজাতির চলার পথে দিশারী হয়েই বিরাজ করবেন সমগ্র আকাশজুড়ে।


বাইশে শ্রাবণ

রবীন্দ্রনাথ সামন্ত


বিশ্ববরেণ্য গর্ব দেশের

মৃত্যুঞ্জয়ী মহাবীর।

স্বজন হারিয়েও পৌষ পার্বণ করেছো

উন্নত করি শির।

জীবন মরণে ঋতুচক্রে

তুমি যে বিশ্বময়।

তোমার রচনা বিশ্ববন্দিত

মেতেছে জগৎময়।

বাইশে শ্রাবণ প্রয়াণে গেলেও

তোমায় স্মরিয়া প্রভাত হয় যে শুরু।

বিশ্ববন্দিত হে মহামানব

মৃত্যুঞ্জয়ী তুমি যে কবিগুরু।

 

সূর্য ডোবার দিন

সপ্তদ্বীপা অধিকারী

 

এই সময়ের কোনো ঘড়ি নেই

অথচ কদমের সুগন্ধ সেতারে সুরের লিখেছে ঠিকানা

হলুদ ডানার প্রেমিকা পাখিটি

বসন্ত রাগ ধরে আছে দুই ঠোঁটে। আজ ভোরে আটপৌরে সূর্য অক্ষরের আজানে স্মৃতি সেঁকছিল!

আজ কোনো ঘড়ি চলবে না।

সূর্যটা অশ্রুর জন্মদিন পিষে পিষে আতর ছড়াচ্ছিল!

আজ অশ্রুর সার্থক হবার দিন।

কস্তুরীর গন্ধ মাখা এই দিনটাই আসলে সূর্য ডোবার দিন!

 

রবীন্দ্রনাথ

তীর্থঙ্কর সুমিত

 

কত কথা বলবো বলেও বলা হয় না

সামনে এক বিশাল পাঁচিল

সময়ের  সাথে সাথে সব পাপ মুছে যায়

অন্ধকার ও আলোর কথা বলে

হাসনুহানা ফুলে ভরে ওঠে বাগান

সব ভোর অপেক্ষারত রাতের ট্রেনের

রবীন্দ্রনাথ বুকের মাঝে

গীতবিতান বা গীতাঞ্জলি সবই আপেক্ষিক মাত্র

তাইতো আজও অমর আমাদের  রবীন্দ্রনাথ

 শ্রাবনের ধারায় চোখ ভিজিয়ে ...

 একটা সকাল আঁকি।

 

প্রতিমা দেবী

প্রশ্ন

গুরুপদ মুখোপাধ্যায়


ঢেউ পাড় ছুঁয়ে থাকে

সব ঢেউ কি পাড় ছুঁয়ে যায়?

মাঝনদীতে অভিমান নিয়ে নির্জনে শূন্যতার ঢেউ

যে ঢেউগুলি ঢেউ ধুয়ে রাখে জলে!

 

ভেঙে যায় চতুরানন , আদি নেই অন্ত নেই

শূন্যতার ঢেউগুলি কুলুঙ্গিতে তুলে রাখি

বৃত্তের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত আমির সারস

নিতাই কবিয়াল খোঁজে নির্ঝর, সাদা কাগজ।

 

শ্রাবণ ভেঙে গেলে ভাদ্র কি হিসেব নেয় তার?

বিছিয়ে রাখে পালঙ্কজুড়ে শিউলি নিঃশ্বাস

রিমঝিম শব্দে বর্ষার নাম লেখে সহকার চীরে

নৌকা ভাসতে থাকে মোহনায়, তীরে।

 

শূন্যতার কথাগুলি আনমনে লিখে রাখে আলপথ!

নদীটি মিশে যায় আস্তিনের গম্ভীরার ঘ্রাণে

শূন্যতার গলিপথে আমি পাড় ছুঁতে চাই

পড়ে থাকা অন্ধকার নীরবে আঁচল বিছিয়ে চলে যায়!

 

আমি কি সংগ্রামী, না অসংগ্রামী?

তবু এত লড়াই কেন শশীর বাগানে?

হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপে?

দেবু পন্ডিতের আটচালায়?

 

মৃত্যুঞ্জয়ী

সৌজন্যা মজুমদার রায়

 

শ্রাবণ ধারায় ঝরে পড়ো

সকল হিয়ার মাঝে,

তোমার সৃষ্টির তরণী ভরা

কত রূপে কত সাজে।

 

সকাল সন্ধ্যাবেলা তোমার

সুর ধারা বয়ে যায়,

খাঁচার ভিতর বন্দি পাখি

বিরহের গান গায়।

 

অবক্ষয়ের যুগেতে তুমি

নব প্রাণের প্রেরণা,

অনন্তকালের পথিক তুমি

চিদাকাশে দাও চেতনা।

 

সুখ-দুঃখ জীবন মাঝে

তুমি রবে নীরবে কবি,

ষষ্ঠী ঝম্পক কেবল বাজে

মৃত্যুঞ্জয়ী তুমি রবি

 

গুরুদেব

নিমাই মাইতি

 

কুসুম কোমল সূর্যমূর্তি

দাঁড়িয়ে রয়েছে সকালে

তারপর সে হাঁটতে হাঁটতে উঠে এলো

মধ্য দুপুরে,

পাতা ভরা ছবিগুলো কিচিরমিচির করে

পাখির মত উড়ছে আকাশ জুড়ে,

খরবৈশাখে তখন সে দাঁড়িয়ে দেখছে

অথচ সে জানে না

তার জোব্বার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে

ঘাসের ডগায় ভরা শিশির বিন্দু।

 

সেদিন বাইশে শ্রাবণ,

পুকুর মাঠ ঘাট থৈথৈ

ভরা প্লাবনে ভেসে গেল আমাদের

মাটির ঘরবাড়ি সাঁকো

তলিয়ে গেল আকাশ গঙ্গায় সূর্য।

 


মৃত্যু অমৃত করে দান

পার্থ প্রতিম চ্যাটার্জী

 

কালের যাত্রার ধ্বনির গ্রাসে আকীর্ণ হোক সৃষ্টির পথ

শ্রাবণ গগনে আসুক মেঘেদের ঘোর ঘনঘটা

রবিকিরণসম্পাতে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে তবু মনন চিন্তন।

 

যুগের পর যুগ ধরে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করে

আজও বিকশিত রবি কুসুমের সৌরভ

অসীম ব্যাপ্তি নিয়ে ছাপিয়ে হৃদয়ের একুল ওকুল।

 

দুঃখ মৃত্যু বিষাদের সাগর মন্থন করে

যে অমৃতসুধারস ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের প্রতিটি বীজন ঘরে, সেই রসের উৎস্রোত শ্রাবণের কালো মেঘেও

এঁকে দিয়েছে চিরঞ্জিবী রামধনু।

 

বিষাদিয়া বাইশে শ্রাবণে মেঘের বুক চিরে ঝরে পড়া বৃষ্টি অশ্রু হয়ে ঈশ্বরের চরণ যুগল ধৌত করে

নীরবে ঘোষণা করে "মৃত্যু অমৃত করে দান"।

 

হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ

মতিলাল দাস

ভোরের আলো যখন চোখে পড়ে, মনে হয় কেউ গান ধরেছে

"জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে"  সেই চেনা কণ্ঠে।

খোলা জানালার পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ হেঁটে বেড়ান আমার ঘরে।

চুপচাপ চা খেতে খেতে তিনি লেখেন, আমি শুধু পড়ে যাই।

 

যখন মন ভেঙে যায়, তাঁর কবিতাই আমার বাঁচার রসদ।

শ্রাবণের বৃষ্টিতে কাঁদতে কাঁদতে শুনি "একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ!"

তাঁর প্রেম, তাঁর বেদনা, তাঁর বিদ্রোহ সব আমার রক্তে মিশে আছে।

আলো নিভে গেলে, একমাত্র তিনিই পথ দেখান অন্ধকারে।

 

আমার প্রেমে রবীন্দ্রনাথ, আমার বিরহে রবীন্দ্রনাথ।

তিনি নেই কোথাও তবু আছেন প্রতিটি স্পন্দনে।

একটা গান, একটা গন্ধ, একটা দোলনচাঁপা

সব যেন রবীন্দ্রনাথের মতোই ধীরে এসে বসে হৃদয়ে।

হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ মানে এক অসীম আশ্রয়, যেখানে সব প্রশ্ন থেমে যায়

 

শ্রাবণ স্মরণ

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়


 রাঙা মাটির ওপর অঝোর শ্রাবণধারা

আকাশ ছুঁই ছুই গাছের পাতা থেকে নামে

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি বিন্দু যেন শব্দছন্দ

জলজ এসরাজের মতো

 

গৌরপ্রাঙ্গনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে

ছাতিম তলা এসে যায়

চারিদিকে  কাদামাখা লালমাটির গন্ধ

সুউচ্ছ তাল গাছের পাতায় ঢাকা আকাশ

তবুও বাইশে শ্রাবণ, থেমে থেমে বৃষ্টি

 

আজ ভীষণ নিসঙ্গ ভূমি

স্তব্ধতার আবরণ মেঘের মতো ঢাকা

তবুও মনে হয় তিনি এখনও আছেন

উত্তরায়ণের বারান্দায়, শ্রাবণ ধারা দেখছেন

হয়ত একটু পরে গেয়ে উঠবেন

'শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা,নিশীথ যামিনী রে..'.

 

কোনো এক অমোঘ বাইশে    

দীপক জানা

 

কোনো পূণ্য নেই, কোনো পাপ

ভালোবাসা অপরাধ হলে, স্বীকার

অসংখ্য ঝুরিতে দোল, আলো

রচনাবলি থেকে জ্যোৎস্না গড়ায়

 

আকাশ কী কেঁদে ছিল, মাটি?

পাতায় শিশির বিছিয়ে ঝিঁঝিপোকা এঁকে ছিল রাত

দিকহারা নক্ষত্র পেয়ে ভূ-পাড়ায় মাদল তখনও

বুড়ো বাউলটা লিখেছিল সোনার গৌর

 

গঙ্গাও থমকে, ধোঁয়া চোখ

জ্বালা জ্বালা পঁচাশির চিতায়

বেহাগ ছড়ায় কেউ

খুলে রাখা সব তত্ত্ব, উপদেশ

ভূমি ভেসে যায়...

 

মৃত্যুহীন রবীন্দ্রনাথ

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

 বাংলা ২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধান দিবস। এই দিনটিকে যদি নিছক প্রয়াণদিবস হিসাবেই ভেবে থাকি তবে মনে হয় ভুল করা হবে। আসলে কবির তো মৃত্যু নেই, রবীন্দ্রনাথের মতো কবির তো নয়ই। রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশাতেও যেমন আলোক জ্বেলে গেছেন, মৃতুর মধ্য দিয়েও সেই একই আলোর দীপশিখাকে আমাদের জন্য অর্থাত্‍ সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রদীপ্ত করে গেছেন। মানবজমিন কর্ষণ করে এক জীবনে তিনি এত সোনার ফসল ফলিয়েছেন ভাবতে গেলেই আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। যে সোনার ফসলের একটুখানি ছোঁয়ায় আমরা নিত্য-নতুন বেঁচে উঠছি, পথ খুঁজে পাচ্ছি সামনে এগিয়ে যাবার। যে মৃত্যুর জন্য আমরা সব সময় ভীত, সন্ত্রস্ত সেই মৃত্যুকেও তিনি অতি সহজ-সাধারণ ভাবে নিয়েছেন। “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?” এই অমোঘ সত্যটিকে কবি রবীন্দ্রনাথ, মানুষ রবীন্দ্রনাথ যেন একান্ত নিজের করে নিয়েছিলেন। তাইতো তিনি সাধারণ খাওয়া-পরার মতো ‘মরণ’কেও বলতে পেরেছিলেন-

–“মরণ রে,

তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।

মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট

রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট,

তাপবিমোচন করুণ কোর তব

মৃত্যু-অমৃত করে দান।

তুঁহুঁ মম শ্যামসমান॥”

 

আসলে রবীন্দ্রনাথ এমন এক বর্ণময় চরিত্র, এমন এক অসাধারণ স্তরের মানুষ যাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে কোনখান শুরু করবো সেটাই আমরা ভেবে পাই না। স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুতে এই মানুষটির কথা শেষ হয়ে যায় না, ফুরিয়ে যায় না। তাইতো তিনি সর্বত্র এবং সব সময়ের জন্যই ঘুরে ফিরে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়ে যান। রোগে-তাপে, শোকে-আনন্দে, সাফল্যে-ব্যর্থতায়, দু:খে-সুখে তিনি আমাদের বাঁচার মন্ত্র, জীবনের প্রেরণা। সর্বক্ষণের জন্যই তিনি আছেন। আজ-কাল-পরশুর ক্ষণকালে তাঁকে বাঁধা যাবে না। তিনি বিশ্বজনীন, এবং অনন্ত কালের জন্য। এক কথায় রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন তা কোনোদিনই শেষ হবার নয়। বরং নিত্য-নতুন ভাবনা-চিন্তার জন্ম দিয়ে আমাদের তিনি ঋদ্ধ করে যাবেন।

২০২০ সাল আমাদের কাছে এক অন্ধকারের কাল। মারণব্যাধি কোভিড নাইন্টিনের প্রাদুর্ভাবে সমগ্র বিশ্বের জনজীবন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমাদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ প্রায় নষ্ট। একটা দমবন্ধ পরিবেশ আমাদের সামনে উপস্থিত। আমরা ভারতবাসীরাও তার থেকে মুক্ত নই। এমনই একটা অভূতপূর্ব পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমরা এবারে কবিগুরুর জন্মদিন ২৫ বৈশাখ পালন করেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম খুব শীঘ্রই হয়তো আমরা এই অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসতে পারব, আমরা ফিরতে পারব আগের মতোই স্বাভাবিক পরিবেশে। কিন্তু তা হয়নি। সেই বদ্ধজীবনের কাল কাটাতে কাটাতেই আবার আমরা কবিগুরুর মৃত্যুদিন ২২ শ্রাবণে উপস্থিত হয়েছি। আমরা মনে করি কবিগুরুর এই দিনটিকে সামনে রেখেই এই মহা সঙ্কটকাল পার হবই। কবিগুরুর জন্মদিনের মতোই তাঁর মৃত্যুদিনও আমাদের কাছে একবুক প্রত্যয়, একবুক বিশ্বাস, একবুক প্রাণ ভরে নেওয়া শ্বাস। ২২ শ্রাবণকে আমরা নিছক কান্নার মধ্য দিয়ে স্মরণ করবো না, তাঁকে স্মরণ করবো বেঁচে থাকার আলো হিসাবে। আমি মনে করি এই রবীন্দ্রনাথ যখন আমাদের আছেন তখন ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। তিনি আমাদের শক্তি, তিনি আমাদের পরিত্রাতা। অনেক দুর্মুহূর্ত, অনেক সঙ্কট আমরা পেরিয়ে এসেছি রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে। আজকের ভয়াল- ভয়ঙ্কর সময়কেও অনায়াসে জয় করবো রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখেই। তিনি আমাদের আলোর দূত, তিনিই পথ দেখাবেন। তিনি মৃত্যুহীন, তিনি চিরজীবী।

এমন দিনে

বিকাশ ভট্টাচার্য

 

মেঘমগ্ন আকাশ এখন চেয়েছে ছাড়পত্র

পায়ের নিচে শক্ত জমি রয়েছে দানপত্র

 

ঝিল্লিমুখর দিনের আলোয় ঝাপসা চারপাশ

বিষাদগাথার নৌকো থেকে নাবলো শ্রাবণমাস

 

বুকের ভেতর ভাঙা উঠোন টইটম্বুর জল

বিষাদসিন্ধু দুয়ার ছুঁয়ে করছে ছলোচ্ছল

 

পায়ের নিচে শক্ত জমি মাথার ওপর ছাদ

এমন দিনে ঘরে ঘরে আসেন রবীন্দ্রনাথ।

 

বাইশে শ্রাবণ

মধুসূদন চক্রবর্ত্তী

 

বাইশে শ্রাবণ শুধু তোমার জৈবিক তিরোধান,

তুমি আমাদের চিরকালীন,তুমি যে মহানপ্রাণ ,

যে রবির দীপ্তি ছড়িয়ে গেছ তুমি সেই সময়

সে আজও আছে একইরকম অম্লান, অক্ষয়,

তোমার আশঙ্কাকে সরিয়ে রেখে অসীম দূরে

আজও তোমার কবিতা পড়ি কৌতুহলভরে ,

পায়ের চিহ্ন আর হেথায় পড়বেনা তোমার ই ,

তবু অলক্ষ্যে বাইছ তুমি সাহিত্যের খেয়াতরী ,

তোমার গান আজো গীত হয় কত ভালোবেসে,

চিরচিহ্ন দিয়ে গেলে তুমি সাহিত্যের ইতিহাসে ,

বাংলার সাহিত্যাকাশে তুমি চির উজ্জ্বল রবি ,

তুমি আমাদের সবচেয়ে গর্ব , হে মহান কবি ,

তোমার সৃষ্টির মাঝে তুমি অমর , তুমি কবীন্দ্র,

তোমার পূজা করে যাবো চিরকাল, হে রবীন্দ্র ।

 

* লাইক ও কমেন্ট করুন ।।

 

=============================

ছবি ঋণ-গুগল

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ