দুইপাতা শারদ সংখ্যা ২০২৫(১০৩তম)

 


দুটি পাতা, দুটি কথা

উত্থানপদ বিজলী

 

চারা চারা সব গাছ

ছাড়ে দুটি পাতা

পরে কেউ মহীরুহ ----

কেউ হয় লতা।

 

পাখিদের শিশুমুখ

বড়ই মধুর

বড় হয়ে কেউ  , কা-কা--

কেউ , কুহু সুর।

 

অশ্বমেধ ঘোড়াদের পা

শীতল চৌধুরী

 

দারুণ উত্তাপে তাকে পেয়েছিলাম একদিন

রৌদ্রচোখে জারুলের বনে;

উত্তাপে ছিল কত সূর্যডানার গন্ধ

ভ্রমরের ওড়াউড়ি--  

আর ছিল শত পালকের নিচে বর্ণময়

তৃতীয় বিশ্বের অশ্বমেধ ঘোড়াদের পা...

তবু সে নির্বিকার পিঁপড়ের মতন

স্বপ্নের মাটিতে পুঁতেছিল বিষ

না দেখার ভান করে তারপর

শরীরের সমস্ত বল্কল খুলে

একা একা বনতুলসীর গন্ধ নিয়ে

হেঁটে গিয়েছিল গোপালপুরে, বনগাঁয়!


জ্ঞান 

সৌমিত বসু 

 

অন্ধ পাবক। বিনুনির ভেতর লুকিয়ে রাখা অন্ধকার আমি যত্নে বের করে আনি।

তোমার বুকের উপর চেনা জন্মদাগ আমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় মহেঞ্জোদাড়োর চাতালে।

আমি চিৎকার করে উঠি আর ভেঙে পড়ে সব হ্যারিকেন। 

নীল জোৎস্নায় মাথা নাড়িয়ে কে যেন ভেসে আসছে ঢেউয়ের চূড়ায়।

অন্ধ ফসফরাস তাকে আজ হাত ধরে শুইয়ে রাখতে চায় সিঁড়ির ওপর।

বাতাস অন্ধ। তুমি আরো আরো বেশি অন্ধ। 

তোমার আমার মতন চক্ষুষ্মান কে বা রয়েছে?

 

একটি নদীর ঘাট ও তুমি

শান্তনু ভট্টাচার্য

 

নদীর যে ঘাটে স্নান করতে নামি রোজ

তারই প্রবেশপথে তোমার মর্মর মূর্তি।

 

বিস্মৃত পান্ডুলিপি খোঁজার মতো আতিপাতি করে খুঁজি

কোথায় তুমি বসতে বা দাঁড়াতে

কোন সে অপূর্ব ভঙ্গিমা

বলে দেবার কেউ নেই।

শুধু কল্পনা আছে...

নদীর বয়ে যাওয়া আছে, আছে পার ভাঙা আর

তোমার রেখে  যাওয়া গান।

 

তাতেই আমার নিত‍্যস্নান

তাতেই আমার আত্মার মুক্তি

 

আমি তোমার জন্য লিখতে বসিনি

গুরুপদ মুখোপাধ্যায়  

 

আমি তোমার জন্য লিখতে বসিনি 

লিখতে বসেছি তাদের জন্য

যাদের জন্য তোমার শরীরে ভূমিকম্প হোত।

 

এখন চাঁদের আলোয় মাঠে ঘাসে শুইনি

ঘাটে দেখিনি ছড়ানো হাঁসের পালক

পোড়া রুটির মানচিত্রে ভারতবর্ষ এঁকেছি।

মাঠময় ছড়িয়ে দিয়েছি প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস!

 

হে জাদুকর!এ পোড়া রুটির ভূমিকায় তোমার

আজানুলম্বিত হাত। ছাড়পত্রে শিশুর মুখ।

যেখানে মৃত্যু বারবার জেগে উঠে শোষনের গোলাঘরে

জীবনানন্দ! মেয়েরাও নিলামে ওঠে আদিম চন্দ্রালোকে।

 

ফেলে গেছ পুরোণো দলিল! টেবিলের হিসেব -নিকেশ

ঘুমিয়ে নিচ্ছে অনসূয়া রাত।সংকেত আঁধার

তোমার কবিতার বাঙ্ময় শরীরে ভুখা মিছিল

আমি  একদিন ঠিক খুঁজে নেব নির্জন হাত।

 

শুয়ে  থাকো কিশোর কবি!

আমি তোমার জন্য কবিতা লিখবো সেদিন

যেদিন তুমি শূন্যের ঢেউ গুনে গুনে

ভেঙে দেবে নিরন্ন অমাবস্যা খাত।

 

গল্প :  অ্যালজাইমার

রবীন বসু

 হঠাৎ নগদ টাকার খুব দরকার পড়ল। এটিএম কার্ডের মেয়াদ চলে গেছে। ব্যাঙ্ক নতুন কার্ড বাই পোস্টে পাঠিয়েছে, কিন্তু তাকে অ্যাক্টিভ করতে ছেলের সাহায্য লাগবে। ছেলে সৌম্য এখন দিল্লীতে অফিসের কাজে। অশেষ ভেবে পাচ্ছেন না কী করবেন! হঠাৎ তাঁর মনে হল, বন্ধু রাজেশ তাঁর কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিল গত বছর। বাড়ি রিনোভেট করবে। অনেক দিন হয়ে গেল সে টাকা ফেরত দেয়নি। লজ্জায় বন্ধুর কাছে টাকা চাইতেও পারেননি।  এবার নিরুপায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা রাজেশের বাড়িতে হাজির। বন্ধু তাকে দেখে না-চেনার ভান করে বলল, “কে ভাই, আপনি?”

অশেষ অবাক হলেন। রাজেশ না-চেনার ভান করছে কেন? তবে কি এটা ওর কৌশল, পাছে টাকা চাই! একটু রেগে উঠে বললেন, চিনতে  অসুবিধা হচ্ছে! আমি অশেষ। ধার নেওয়া টাকা শোধ নিতে এসেছি।”

অবাক হল রাজেশ। “টাকা! কার টাকা? কে ধার নিয়েছে?” তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন।

এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না অশেষ। চিৎকার করে উঠলেন। চিৎকার শুনে রাজেশের ছেলে ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

“কী ব্যাপার কাকাবাবু, আপনি!”

“হ্যাঁ, আমি। তোমার বাবার কাছে এসেছি পাওনা টাকা নিতে। গত বছর আমার থেকে ষাট হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। এখন টাকার খুব দরকার। কিন্তু রাজেশ আমাকে না-চেনার ভান করছে।”

“না কাকু, বাবার মাথায় সত্যি গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। উনি নাকি সব ভুলে গেছেন। এই দেখুন না, বাড়ির দলিল চাইলাম, বলে, কোথায় রেখেছি মনে করতে পাচ্ছি না। আচ্ছা  কাকু, একে কী অ্যালজাইমার বলে?”

পরের দিন সকালে পার্কে হাঁটতে গিয়ে অশেষ দেখেন, রাজেশ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে চাইছিলেন। রাজেশ দৌড়ে এল।

“ভাই, রাগ করিস না। একটু আমার কথা শোন।”

“কী শুনব। তুই তো সব ভুলে গেছিস।”

“না বন্ধু, কিচ্ছু ভুলিনি। আমার অ্যালজাইমার রোগ হয়নি। ছেলেকে বোকা বানাতে এই অভিনয় করছি।”

“কেন?”

“ও বাড়ি প্রমোটারের হাতে দেবে, তাই দলিল চাইছে। আমি বেঁচে থাকতে বাড়ি ভাঙতে দেব না। তাই বলেছি, দলিল কোথায় রেখেছি আমি ভুলে গেছি। তুই আমাকে মাপ কর। এই নে তোর টাকা।”

 

সেতু

অন্তরা সরকার

 

দীর্ঘ বছরের জংধরা সেতু ভেঙে পড়েছে নদীর বুকে।

সময়ের ফাঁকফোকরে ক্রমাগত ধুলো জমে

ক্ষয় হতে হতে ফুরিয়ে গেল আয়ু।

বাপ মা মরা ছেলে শৈশব হারিয়ে

হরলিক্স বিস্কুটের লোভে ধরা পড়ে মৃত্যুর কবলে।

পঁচিশ বছরের মেয়েটির চোখে মুখে ডিপ্রেশন।

নো ভ্যাকান্সি ,নো ইন্টারভিউ,নো এমপ্লয়মেন্ট।

খবরের পাতায় পাতায় ধর্ষণ, রাহাজানি,নারী নির্যাতন।

ধর্মান্ধতা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতায়-

এক একটি ডালপালা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।

 সবুজ ছেঁটে  ইমারত হলো,

অন্ধ উপত্যকায় শঙ্খ বাজিয়ে জেহাদ ঘোষণা হলো।

ক্রমাগত পচন হতে হতে,

বিকট শব্দে সেতু ভেঙে পড়ল নদীর কোলে।

তুমি দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখলে,

মেরুদন্ডহীন সভ্যতার চোখে চোখ রাখলে না।

কলমের খোঁচায় আগুন জ্বালালে না!

সেতু ভাঙতেই বিচ্ছিন্নতার ভয়ে কুঁকড়ে উঠলে,

এরপরেও কি নোটপ্যাডে আয়নার জলছবি লিখবে?

 

বড় হয়নি গাছ 

শিখা মল্লিক

 

এখনও বড় হয়নি গাছ।

তাই হাওয়ায় নড়ে নড়ে ওঠে।

মনে হয় সারাটা জীবনই লেগে যাবে

শক্ত হতে।

 

এত ঝড় !

এত উৎপাত !

এত নামানোর চেষ্টা .... !

প্রত্যাঘাত তবুও জমানোই থাকে।

 

শক্ত হলে হয়তো তার দরকারই হত না

লেজ গুটিয়ে, মাথার উপর দিয়ে

শোঁ শোঁ ফিরে যেত হাওয়া।

 

বাঁচতে আর বাঁচাতে

সুধীরচন্দ্র পাল

 

গাছেদের প্রশ্ন করা হলো-

কেমন আছো তোমরা ?

উত্তরে বলল ওরা-

আছি তো ভালই, তবে--

কী তবে?

তবে ওই আইলা, হেরিকেন আর আমফান,

আমাদের মাথাটাকে নুইয়ে দিতে

মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে

ওরা তোলে তুফান।

তখন কি করো তোমরা?

ওই একটু আধটু হার মানি,

যদিও কদিন পরেই আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতেও জানি।

বিরোধ করো না তোমরা ওদের ?

না, ঠিক বিরোধ নয়,

তবে করি - মেরুদন্ড সোজা রেখে তীব্র প্রতিরোধ ।

কি লাভ তাতে?

লাভ? নির্মল আনন্দ বেঁচে থাকে প্রতিটা পাতাতে।

সে আনন্দ কি কেবল তোমাদেরই?

না, না, তা কেন !

পৃথিবীতে আর যারা আছে

এ আনন্দ তো তাদের সকলেরই।

কি স্বার্থ তোমাদের তাতে?

স্বার্থ ! তাতো জানিনা,

তবে জানি কেবল নিজেরা বাঁচতে,

আর সকলকে বাঁচাতে।

 

বর্ষার সুর

মধুসূদন চক্রবর্ত্তী

 

বর্ষারানীর পায়ের নুপুর

বাজে রুমঝুম করে ,

সারাটাদিন টাপুর টুপুর

দেখি অবিরাম ঝরে ।

 

পাখীর দল ডানা ঝেড়ে

বেড়ায় খুঁটে খেতে ,

ছেলের দল পড়া ছেড়ে

খেলায় ওঠে মেতে ।

 

বাগানখানা কদম ফুলে

কেমন গেছে ভরে ,

ময়ূরছানা পেখম তুলে

মায়ের সাথে ঘোরে  

 

উদাসমনে বাহির পানে

তাকিয়ে আছি বসে ,

হৃদপরানে পাখির গানে

পড়ছে স্মৃতি খসে  

 

বৃষ্টিধারার সুর শুনে

মনে এলো শৈশব,

সৃষ্টিছাড়ার সেই দিনে

জমে ছিল বৈভব ।

 

তোমাকে ঈশ্বর ভেবে

শ্রুতি সামন্ত

 

সেদিন তোমাকে ঈশ্বর ভেবে

একরাশ ধোঁয়া উড়ে ছিল

আমার মরচে ধরা মনে,

বাতাসের সাথে বহুদূর।

 

তুমিও হেঁটে ছিলে আমার সাথে,

তোমার ঈশ্বর কণায় জলবিন্দু দেখে

আমারো পরম সাধ জাগে

মেঘ হবার।

 

ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল তাণ্ডবে

মাথা নোয়াবার কিছু নেই,

মুখোমুখি হবার এই তো গোপন সময়।

প্রাণ বন্ধু, বাউল সন্ধ্যায়

বিকিয়ে গেছি প্রান্ত সীমায়।

 

আধখানা চাঁদ উপঢৌকন দিয়ে

ফিরে এলাম লোনা জলে

পা ডুবিয়ে দেখি

ঈশ্বরের মতো তুমি দাঁড়িয়ে

ক্রমশ আলোর কাছাকাছি

আরো বহুদূর হেঁটে গেছি।


শারদ প্রাতে

মহুয়া ব্যানার্জী

 

আশ্বিনের ওই শারদ প্রাতে

কাশের ফুলে সহজ সরল আলো ফোটে-

আশ্বিনের ওই শারদ প্রাতেই প্রায়শই

ঝোপে-ঝাড়ে মাঠে অথবা শারদ অন্ধকারে

মেয়েদের লাশ বিছিয়ে থাকে ঝরে পড়া শিউলির মত!

আশ্বিনের ওই শারদ প্রাতে মা আসেন

অশুভ মহিষাসুরকে দমন করতে।

আশ্বিনের সেই শারদ সময়ের বহু যুগ আগে থেকেই

পেটের জ্বালায় নিজেকে বেচে মাতৃ জাত!

তবুও, যখন শরতের মেঘে আগমনীর

সুর বেজে ওঠে, নিজেদের শক্তি চিনতে

পারে সেই সব মেয়েরা ! তারা লুকোনো অস্ত্র

শানিত করে মেধা প্রজ্ঞা আর সাহসের দীপ্তিতে-

তারপর শুধুই বোধনের শঙ্খ বাজে-

বীরেন ভদ্র ডাক দেয় , জাগো মা...

আশ্বিনের এই শারদ প্রাতে তখন তেজদীপ্ত

মায়ের মেয়েরা সমস্বরে হুঙ্কার দেয়

 গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ়...

মা আসেন, মা হাসেন,  মা ভালোবাসেন সেই ক্ষণে।

 

বিশ্বাস

তৈমুর খান

 

বিশ্বাস কি হারিয়ে গিয়েছিল?

তাই খুঁজতে এসেছিলাম!

খুঁজতে খুঁজতে অনেকদূর চলে এসেছি

অনেক মানববাজার ঘুরে ঘুরে

বাজারের শেষপ্রান্তে চায়ের দোকানে বসেছি।

 

বিশ্বাসের সঙ্গে আর দেখা হবে নাকো?

অনেক বিশ্বাস দেখি বিজ্ঞাপন হয়ে আছে

অনেক বিশ্বাস বিক্রি হচ্ছে অনেক সস্তা দরে

খুলে খুলে দেখাতে চাইছে সব—

যেমন ইচ্ছে নেবেন যাচাই করে!

 

সমস্ত বিষাদপাখি যুগের প্রত্যয় খুঁটে খুঁটে

চলে যাচ্ছে নিঃসীম দিগন্তের পারে উড়ে

আমরা শুধু চা খেয়ে খেয়ে বেহিসাবি দিনপাত করে

ফিরে আসছি আমাদের নিঃস্ব দগ্ধ বাড়ি;

যেখানে সম্পর্কের ফাটলে লুকানো আছে হিংসার তরবারি।

 

ঘূর্ণাবর্ত

তপন মুখার্জি

 

কোকিল ডাকলে, আমার বসন্ত মনে হয়।

অন্ধকার ঘন হলে, কুরুক্ষেত্র।

আমি ধুলো মাখি, মাটি মাখি, ছাই মাখি।

দিন বৃদ্ধ হয়, রাত স্থবির।

বসন্তহাতে যুদ্ধে নামি।

যুদ্ধশেষে নিজেকে ধুতে যাই দ্বৈপায়ন হ্রদে।

দূর থেকে জল কালো কুরুক্ষেত্রের মতো লাগে।

অথচ হাতে তুললেই রংহীন।

সব স্রোত ফিরে গেলে,

বসন্তজাতকের হাতে কি উঠে আসবে

পিপাসিত চন্দ্রিমা?

 

বলো আর কতোদিন

সৌমিত্র মজুমদার 

 

ঘন আঁধারের কালো চাদর সরিয়ে

হঠাৎই সে উঁকি দিলো

রক্তিম নতুন সূর্য, 

নিমেষেই আলোকিত প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ

কিন্তু গতরাতের সেই পাশবিক মলিনতা ! 

কি করে তাকে মুছে দেবে নবোদিত ওই সূর্য 

বলতে পারো কেউ?

বিবেকের দংশন অনবরত কুরে কুরে খায়

হৃদয়ের আনাচে-কানাচে ভয়ের শিহরণ 

পাপবোধের কাহিনী স্বস্তি দেয়না মোটেই....

রোজ তো সূর্য ওঠে নিয়ম করে, 

অস্তও যায় স্বাভাবিকতায়, কিন্তু 

রাতের অন্ধকারকে সেই লুটেপুটে খায়

একদল সুযোগসন্ধানী, 

হয়তো বা সময়ের গাঢ় আস্তরণে 

আমরা ভুলে যাই সব, কিনারাও হয়না

তবু আবারও রাত আসে 

আবারও সেই নতুন-নতুন পুঁতিগন্ধময় মলিনতার গল্প।

 

ছোট গল্প : অন্বেষার বিয়ে

পুষ্প সাঁতরা

 

অর্ক রা চলে যাবার পর,লালমোহন বাবু শোবার ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসলেন।অনেক দিন পর বেশ হালকা ফুরফুরে  লাগছে,এতদিনে তার মেয়ে পাত্রস্থ হতে চলেছে একি কম ভাগ্যের কথা!সারাটা জীবন তো ছাত্র পড়িয়ে আর গ্রামের বিচার আচারেই সময় কেটে গেছে মেয়েটার যে কবে কবেই বয়স পঁচিশের চৌকাঠ পেরিয়েছে বুঝতেই পারে নি,অবশ্য স্নেহলতা বার বার মনে করিয়ে দিলেও আমূল দিত না লালমোহন বাবু।সব যখন প্রায় ঠিকই হয়ে গেল তাহলে তো শুভস্য শীঘ্রম্! আজ যেন মেয়ের প্রতি একটু বেশিই

স্নেহপ্রবন হয়ে উঠছেন! এটাই কি পিতৃস্নেহ,হবেও বা।এতদিন একটার পর একটা সম্বন্ধ ভেঙে যাচ্ছিল কোন অজ্ঞাত কারনে ,তাই খানিক টা বিরক্ত হয়েছিলেন মেয়ের প্রতি ,ওর মায়ের প্রতিও ।যা হয়েছে ভাল হয়েছে যা হবে ভালই হবে।কিন্ত কতগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ,আমার অন্বেষা তো কালো নয় গায়ের রং মাগুর

বর্ণা! কোথাও তেমন মেয়ের খুঁত নেই তবু কত ছেলের বাবা খুঁত খুঁতে মন নিয়ে খুঁত ধরে।এই পাঁচবারের বেলায় গুটি লাগল কিন্ত আবার যদি বিগড়ে বসে ছেলে! তবু মেয়ের বন্ধু দীপা ছিল বলেই এ সম্বন্ধ টা র  কোষ্ঠী, হাত বিচার, কিছুই করতে হয় নি।

               অন্বেষার ও নিজের প্রতি নিজের একটা রাগ অভিমান বুকে জমা হয়েছিল, সেকি এতই ফেলনা ,পাত্র পক্ষের লোক ভুরিভোজ খেয়ে পরে খবর দিব বলে

হাত মুছে চলে যায়! অন্বেষার এখন ভরা যৌবন দোল খাচ্ছে মন, প্রেমিক টিকে পেয়েও পেল না ,উপায় না দেখে বন্ধু দীপাকে ফোন করে।'দীপা আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি তুই একবার আমার সঙ্গে দেখা কর।সত্যিই একদিন দীপা হাজির।অন্বেষা সব কথা খুলে বলে,'তুই একটা কাজের খোঁজ দে না হলে অন্য ব্যবস্থা কর'মা বাবা সবাই কেমন হয়ে গেছে,আমাকে তাড়াতে পারলেই যেন বাঁচে'।

দীপা বলে,আমাদের মত বয়স হলে সব বাবা মায়েরাই এ রকম চিন্তা করে।তবে তোর জন্য রাজপুত্রের খোঁজে আজই আমার যাত্রা হল শুরু---- দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে!

ঠিক সাতদিনের মাথায় দীপা লালমোহন বাবুকে ফোন করে,'জেঠুমনি খুব ভাল ছেলের সন্ধান পেয়েছি ,কলেজে পড়ায়।বিষয় আশয় তেমন নেই কিন্ত বনেদি পরিবার ।অন্বেষার সম্বন্ধে সব বলেছি,কালকেই আমরা যাচ্ছি।তবে দীপা একটা কথা বেমালুম চেপে দিল ,অন্বেষারা ব্রাহ্মণ আর অর্ক রা কায়স্থ কেননা লালমোহন বাবু খুব কাষ্টের বিচার করে।আরে এখন ওগুলো চলে! যথা সময়ে সবাই হাজির,কনে দেখা বলে কথা -- লালমোহন বাবু খাওয়ার ব্যাপারে একেবারেই দিলখোলা আদর আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখল না ,অন্বেষাকে দেখে অর্কের খুব ভাল লাগল,আড়ালে ডেকে কথাও হল।দেওয়া থোওয়ার ব্যাপার টাও সাধ্যের মধ্যে তাই কোন ব্যাপারেই আটকালো না।কিন্ত নাম গোত্র সব অর্ক কে জিজ্ঞেস করতেই, লালমোহন বাবুর চোখ কপালে! অর্ক বাবু

আপনারা কায়স্থ? দীপা তুই আগে বলিস নি কেন? আমাদের কোন বিয়ে কায়স্থ পরিবারে হয়নি' দীপা নতমুখে বলে, 'আগে হয়নি বলে এখন যে হবে না কে বলেছে  জেঠু সবাই কে আপডেট হতে হবে।আচ্ছা ওরা যদি সুখি হয় ভালোই তো ।আমি জানি দেশের আইন এ সম্বন্ধকে নিষিদ্ধ বলে না।তবে আমরা কেন মেনে নেবো না? লালমোহন বাবু বলে ওঠেন, 'তুই চুপ কর আমাকে জ্ঞান দিস না।অনেক আইন আমার জানা আছে।

কিন্ত জেঠু স্বজাতে বিয়ে হয়েও কি সুখি হয়? আপনার আগের মেয়ের তো স্বজাতে বিয়ে  দিয়েছেন কিন্ত সুখ? সারাদিন বর পেটাচ্ছে-----

আপনি সম্মানের ভয়ে চেপে গেছেন।আমি অন্বেষাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি বন্ধু বলে।আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবেন।

উভয় সংকটে পড়ে মন অস্থির হয়ে উঠল লালমোহন বাবুর ,মনের মধ্যে ঝড় বইছে,বাৎসল্য এবং বংশ মর্যাদার টানা পোড়েনে ভেতরটা যেন রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে।

এদের নিয়েই তো  সব কিছু।ওরা যদি দুঃখ পায় আমার বংশের আর গৌরব রইল কি! ভাবতে ভাবতে রাত শেষ,ঐ সূর্য উঠছে -- কিরণ ছড়িয়ে পড়ছে লালমোহন বাবুর চোখে ,পথ দেখতে পাচ্ছে যা অর্গল মুক্ত পথ

দীপাকে ডেকে তার মতামত জানাল ,আমার এ বিবাহ তে মত আছে রে মা -- সব কেমন বদলে যাচ্ছে আমিই বা  কেন বদলাবো না! ভেবে দেখলাম এতে আমার বংশের কোন মানহানি ঘটবে না।এটা যদি খারাপ কাজই হবে তো দেশের সরকার এই বিবাহ কে আইন সিদ্ধ বলবে কেন কি বল দীপা!সবাই এক বাক্যে ,এ বিয়ে হবেই হবে---

         অন্বেষার মনে সানাই বেজে ওঠে!

 

পরিবেশ

সুধাংশুরঞ্জন সাহা

 

আজকাল কারো সঙ্গে বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করে না। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি আর অপেক্ষা করি একটা জুতসই উত্তরের। আদতে নিজের মনে কথার জাল বুনে চলি সারক্ষণ। হঠাৎ পোষা কুকুর টমি-র মৃত্যুর পর থেকেই আমার এমন নাজেহাল অবস্থা। এই শোক দিনরাত আমার বুকে সূচের তীব্রতায় বিঁধতে থাকে। নিজের অদৃষ্টকেই দোষারোপ করি।

এমন মানসিক অবস্থার মধ্যেই ঘরে বাইরে সব দায়দায়িত্ব নিজেকেই সামলাতে হয়। এমনিতেই আমার দৌড়ঝাঁপ বেড়ে গেছে অনেকটা। এক বছর হতে চলল রোড অ্যাক্সিডেন্টে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই খুব একা হয়ে গেছি। তারপর আবার টমি-র মৃত্যু আমাকে আরো একা ও নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে।

একমাত্র মেয়ে, সেও থাকে কানাডায়। কারো সঙ্গে বসে যে দু'দণ্ড কথা বলব, সেই সুযোগও নেই। শুধু হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে মেয়ের সঙ্গে থাকি যতক্ষণ, ততটুকুই আমার রিলাক্সেশন।

একাকিত্ব কাটাতে ইদানিং ওলা, উবের বাদ দিয়ে মিনিবাসে করেই অফিসে! যাতায়াত করছি। বাসস্ট্যান্ড থেকেই খালি বাসে বসে বসে যাই। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর নিত্যযাত্রীরাও মুখচেনা হয়ে গেছে অনেকে। কোনোদিন যেতে দেরি হলে কেউ কেউ আবার সিটও রেখে দেয়। এইভাবে অনেকের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।

মিনিবাসে যাতায়াতের পথে অনেকের সঙ্গে কথা বলা, মতবিনিময় আমার একাকিত্ব  ঘোচাতে খুব সহায়ক হয়েছে। অফিসে যাওয়ার ব্যাপারেও আগের তুলনায় অনেকটা উৎসাহী করে তুলেছে আমাকে। যাত্রীদের মধ্যে এতোটাই হৃদ্যতা যে, প্রায় প্রতিদিনই কারো না  কারো জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ছাড়াও ২৫ শে ডিসেম্বর, ১ লা বৈশাখ, ২৫ শে বৈশাখ ... এইরকম কিছু না কিছু থাকেই। ফলে বাসেই উদযাপন হয়, হৈচৈ,খাওয়া দাওয়া, মিষ্টিমুখের মাধ্যমে। ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে একটা সুদৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে।  বছরে একবার পিকনিক, বেড়াতে যাওয়া সবকিছু নিয়ে এরা খুব সক্রিয় থাকে বছরভর। সব মিলিয়ে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ। এই মূল্যবোধহীন, অবক্ষয়ের সময়ে এটাই বা কম কীসের!

সত্যি কথা বলতে কী, যাতায়াতের এই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ আমার নিঃসঙ্গ ক্ষতবিক্ষত মনকে অনেকটা উজ্জীবিত করেছে। রাতের অন্ধকারে এক ঝলক জোছনা যেমন আলোয় ভাসিয়ে দেয় চরাচর, ঠিক তেমনই। এ যেন দশ পনেরো  বছর আগেকার আমিতে রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছি নিজের অজ্ঞাতসারেই।

 সহযাত্রী

নরেশ জানা

 

ট্রেনের জানালা দিয়ে ঘুড়িদের ওড়াওড়ি দেখছিলেন হৃদয় বাবু। একটা ঘুড়িকে বেশিক্ষণ দেখা যায় না। তবে একটা হারালে আরেকটা এসে পড়ে। এপাশে বিশ্বকর্মা নয় ঘুড়ির দাপট পৌষ সংক্রান্তিতে। ঘুড়ি দেখতে দেখতেই অন্যমনস্ক হয়ে পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বাধা দিল ছেলেটা, কী করছেন মাষ্টারমশাই? এটুকু সামান্য সেবা করার সুযোগ আমাকে দিন। একটা একশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল ছেলেটা। ঘুড়ির রেশটা কেটে গেল। হৃদয় বাবু আড় চোখে দেখলেন চল্লিশ টাকা ফেরত দিল হকারটা। হৃদয় বাবুর বুকটা ধড়াস করে উঠল। খুব বাঁচা গেছে, দুটো কফির দাম ষাট টাকা! একটু হলেই ষাট টাকা খসে যেত! কয়েক দিন হল বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। গরম কফিটা মন্দ লাগছে না। সেই কফি তে চুমুক দিতে দিতে হৃদয় বাবু ভাবছেন, মেমু স্পেশালে সব কিছুরই দাম বেশি। মুড়ি তিরিশ টাকা ঠোঙা, ঘুগনির প্লেট কুড়ি টাকা, ভেজিটেবল চপ পনেরো, সামান্য ডিম সেদ্ধ তাও পনেরো! তিনি হিসাব করে দেখলেন অলংকারপুর থেকে কোঙারপুর অবধি তিনি মোট একশ দশ টাকার খাবার দাবার খেলেন। তিনি নামবেন অনন্তপুর। মেয়ের বাড়ি গেলে তিনি ধুতি পাঞ্জাবি পরেন। তাতেই সম্ভবত গুলিয়ে ফেলেছে ছেলেটি। জীবনে মাষ্টারি করেননি। বিডিও অফিসের বড়বাবু ছিল।  ছেলেটা তাঁকে তার কোনো প্রাক্তন শিক্ষক ঠাউরেছে বোধহয়। তাতেই এত খিদমতগারি। মানুষের এমন ভুলও হয়। যাক গে! তাঁর কিছু টাকা তো বেঁচে গেল। তিনি লোকাল ট্রেনেই যাতায়াত করেন, আজ গাদা খানেক ট্রেন বাতিল তাই মেমু স্পেশাল। টিকিটের দাম কুড়ি টাকা বেশি পড়ল। অবশ্য মাঝের মাত্র পাঁচটা স্টেশনে স্টপেজ দিয়ে ট্রেনটা অনন্তপুর পৌঁছে যাবে। আর এতগুলো টাকার খাবার যে মাগনা খাওয়া হল, কম কী। অলংকারপুর জংশনে গাড়ি প্রায় খালি হতেই উঠেছিল ছেলেটা। বছর আঠাশ তিরিশ, ঝকঝকে চেহারা, কেতাদুরস্ত জামা কাপড়। মাষ্টারমশাই ভালো আছেন? বলেই একটা প্রণাম ঠুকে বসে পড়েছিল তাঁর পাশেই। সেই ইস্তক এটা ওটা খাবার অর্ডার দিয়েই চলেছে আর দাম মেটাচ্ছে নিজেই। পাকুড়িয়া আসছে। ট্রেনটা দাঁড়াবে এখানে। তার মিনিট কুড়ি পরেই নেমে যাবেন তিনি। স্টেশন লাগোয়াই মেয়ের বাড়ি। আগামী কাল ছাদ ঢালাই আছে। একটু দেখভাল করার জন্য মেয়ে ডেকেছে।  ছেলেটা নামল পাকুড়িয়াতেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল।

 

 উঃ! কী বকবক করতে পারে ছেলেটা। আবারও ঘুড়ি দেখতে দেখতে ফোলিও ব্যাগটা কোলে তুলে নিলেন তিনি। একটা লুঙি, ফতুয়া আর মাফলার ছাড়াও হাজার কুড়ি টাকা এনেছেন। মেয়ের বাড়ির ছাদ ঢালাই বলে কথা,খালি হাতে কী আসা যায়? ব্যাগের চেনটা খুলে টাকাটা ঠাওর করার হাত গলিয়ে ছিলেন, হাতটা পেছন দিকে গলে বেরিয়ে এল। ভোকাট্টা! হৃদয় বাবুর হৃদয় থেকে বেরিয়ে এল কথাটা, সংগে একটা দীর্ঘশ্বাস! ট্রেনটা অনন্তপুরে ঢুকছে।

 

ইতিহাসে যা রয়েছে 

শ্যামল রক্ষিত

 

অধ্যাপক, আপনার ইতিকথা  শেষ হোক

আপনি কষ্টে আছেন

মাইনে-করা জুতোজোড়ায় পা গলিয়ে

      আপনি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিখছেন

      দেশশাসনের জন্য কোনো রাজা লাগে না

      প্রজাদের মিথ্যে জয়গানে হাট-করা দরজা খুলে  যায়     

      অশুদ্ধ  বাতাস কড়া নাড়ে অন্তিম ভোরে

 পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে লেখা থাকে : সন্ত্রাসবাদীরা দেশের মানচিত্র 

                   রক্ষাকারী সংসদ দখল করে বসে আছে ।

 

পিছু ডাকে

অরবিন্দ সরকার

 

কাটুমকুটুম আঙিনায় কে ডাকে টঙ্কিত নূপুরে

বেদমন্ত্রে উচ্চারিত ধ্বনি

কেবলই পিছু ডাকে

ফেলে আসা দিনগুলি কাঁটার মতো সচকিত

আড়াল গোপনে একটু গভীর শ্বাস

একটু আলোড়ন

স্পন্দিত চোখের পাশে একটু বেদন

বাউল সুর।

 

বিষণ্ণ পাখির পালক

বিকাশ চন্দ

 

সেদিন রোদের তাপে পুড়েছিল মুক্ত পাখির পালক

অলক্ষ্যে বুকে বাঁধা অস্থির স্বর ঘর ফেরতা পথে

হিরন্ময় শব্দে তখন স্বয়ম্বর ভাবনা বেপথু বালিহাঁস

অলক্ষ্যে ভিজে যাচ্ছে রক্ত ক্ষরণে বুকের পাটাতন

চতুরঙ্গে চতুর্দিক আলো পোড়াচ্ছে সময়

 

সাদামাটা রাজনীতির খেলাঘর বোঝেনি

পোড়া জীবনের গন্ধে ঝলসে যায় অভিমান

স্বৈরিনী সময় জানেনা জন্মের যাপন কথা

মধ্যবিত্ত দেয়ালে কতবার খুঁজেছি জন্ম দাগ

উঠোনের নিমগাছে জড়িয়ে আত্মার সোহাগ

 

কতনা উৎসব বোনে সম্পর্কের জন্মকথা

ফেলে আসা সময় খোঁজে চিরায়ত লালন কথা

ছড়ানো পালকে ঈশ্বর ও জানেনা পাখি জন্ম দিন

মানুষের মতোই আত্মীয় বাঁধা আত্মার বিন্দু আলোয়

তর্পণে বাঁধা মহামিলনের অদেখা সহস্র বাঁধন

 

খোঁজা

তীর্থঙ্কর সুমিত

 

তোমার চোখে যখন চোখ রাখি

মনে হয় ---

ভালোবাসা চিরবসন্তের অধ্যায়ে

নব নব রূপে সেজে ওঠে

এক সমুদ্র উজাড় করা ঢেউ

তোমার ঠোঁটে আগামী লেখে।

এলোকেশী চুলে যত অধ্যায় লেখা ইতিহাস

আমায় বলে,

আর একবার বিহারী হও

আমি বিনোদিনী হয়ে

 

নিজেকে খুঁজবো...

 

পথ কবিতা ও সাহিত্য                                                                          (প্রবন্ধ)

গৌতম সমাজদার

 

"আমার কবিতা গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আক্ষেপ প্রমাণ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাঁর কবিতা পৌঁছায়নি। অর্থাৎ সেই প্রান্তিক মানুষগুলোকে তাঁর কবিতা হয়ত ছুঁতে পারেনি। তাঁর কবিতায় তাদের কথা ঠিকমতো বলে উঠতে পারেননি বা আরো তাদের কথা লিখতে হতো। আবার দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন অংশকে সামিল করানোর ক্ষেত্রে নজরুল অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। তাঁর কবিতা সেইসব প্রান্তিক মানুষসহ প্রায় সব অংশকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য এক অস্থির সময়ে এসেছিলেন যখন তিনি লিখছেন "পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"। অর্থাৎ আবেগময় কবিতা নয়, প্রতিদিনকার সমস্যায় খিদের জ্বালায় চাঁদ আর প্রেমের ভালবাসার হয়ে ওঠে না। শরীর রুটি চায়। আসলে পথ কবিতা ও পথ সাহিত্য বলতে বোঝায় মানুষের জীবন সংগ্রাম এবং বাস্তবের রুক্ষ্ম মাটিতে দাঁড়িয়ে উঠে আসা অনুভূতিগুলো। এই কবিতা বা সাহিত্য হল সমাজের মূল স্রোত থেকে পিছিয়ে পড়া, দূরে থাকা প্রতিদিনকার লড়াই, দুঃখ কষ্টকে শুধু উল্লেখ করাই নয়, তার থেকে উত্তোরণের পথ দেখানো সেই অন্তজ শ্রেণীর মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তির পথ খোঁজ করা এবং প্রয়োজনীয় আন্দোলনে সামিল হবার আহ্বান। আবার অনেকে মনে করেন এই ধরণের কবিতা, যা মূলতঃ শহরের জনবহুল স্থানে ছাপার অক্ষরে নয়, সরাসরি রাস্তার দেওয়ালে, প্রকাশ্য স্থানে, ফুটপাথে কবিতা বা অভিজ্ঞতা কাজ করে। এটি একটি দৃশ্যমান শিল্প হয়ে ওঠে যা পাঠকদের সাথে কবি লেখকদের সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে। কোন কোন কবিতার আবেদন চিরকালের হতে পারে, কোন কবিতা বর্তমান সময়ের শুধুমাত্র মূল্যায়ন করে। সমস্যা মিটে গেলে হয়ত এই কবিতা ভাল লাগে না। আবার কোন কোন কবিতা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়।পথ কবিতা বা সাহিত্য মূলতঃ প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে কোন গল্প, কবিতা। আবার গীতি কবিতার মধ্য দিয়েও মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে ফুটিয়ে তোলা। আবার নাটকের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষের জীবন, লড়াই, দুঃখ কষ্টকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে সাফল্য ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখায়। সমাজের অন্ধকার, বর্ণবাদ, বৈষম্য নিয়েও প্রান্তিক কবিতা রচিত হয়। মূল কথা হচ্ছে, যে মানুষগুলো কোনদিন তাদের নিজেদেরকে সাধারণ কবিতায় খুঁজে পায় না, তাদের জীবনযাপন কষ্টের কথা দেখতে পায় না, সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত মানুষগুলো পথ কবিতায় নিজেদের প্রতিবিম্ব খুঁজে পায়।

এই পথ কবিতা বা সাহিত্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে বাধ্য করে। বলে, সকল মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।আসলে সব দেশে সবকালেই এই প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা বেশী। তবুও সাধারণ সাহিত্যে তাদের কথা প্রতিফলিত হয় না। এই মানুষগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন যুক্তিসঙ্গত কারণেই। কারণ এদের প্রতিদিন যে ভয়ানক দারিদ্র্য, অশিক্ষা, চিকিৎসার সূযোগ না থাকা নিয়ে লড়াই করতেই সময় কেটে যায়, তাতে সমবেত হওয়ার সূযোগ কম থাকে। সেই মানুষগুলো যাতে পেটের খিদে মেটাতে পারে, দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে পারে, অশিক্ষার করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, ন্যূনতম চিকিৎসার সূযোগ যাতে পায়, তার জন্যই পথ কবিতা বা পথ সাহিত্যের জন্ম। প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী আবার ছোট হয়ে আসবে। কিন্তু তার সুফল এই প্রান্তিক মানুষদের কাছে পৌঁছবে না। এদের হয়ে কথা বলে পথ কবিতা, পথ সাহিত্য। কবিতার আবেদন নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছে যায়। সূযোগ দিলে এই প্রান্তিক মানুষরাও সমাজে এগিয়ে আসতে পারে। পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতে পারে। পথ কবিতা ও সাহিত্য সেই বার্তাই দেয়। এই কবিতা বা সাহিত্যের ভাষাও একটু অন্য সুরের। একটি মতবাদকে বর্ণনা করতে একটি বিস্তৃত দৃষ্টিকোণ হতে ব্যবহার করা হয় যা মূল ধারণার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একদম পৃথক। মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস 'হাজার চুরাশির মা' তার সাহিত্যের বাঁক নেওয়া বলা যায়, যেখানে প্রান্তিক মানুষরাই মূল উপজীব্য। বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এলেন সভ্য সমাজকে বাদ রেখে প্রান্তিক মানুষের আখ্যান, জীবন সংগ্রাম। তুলে ধরলেন তাদের কণ্ঠস্বর। হ্যাঁ এটা ঠিক এই কবিতায় অনেক সময় মিছিলের শব্দ শোনা যায়, যা স্লোগান মনে হতে পারে। উচ্চাঙ্গের কবিতা না হতে পারে। কিন্তু সমাজের বেশীরভাগ অংশকে বাদ দিয়ে কবিতার কি প্রয়োজন? আজ আরো বেশী বেশী করে এই মানুষগুলোর কথা বলার জন্য পথ কবিতা ও পথ সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য্য।

 

অনিশ্চিত কিছু ভাবনা

গোবিন্দ বারিক

 

দূরে  সরে যাচ্ছে মিছিল, ক্রমশ মিশে যাচ্ছে বিন্দুতে। রক্ত শুকনো হতে হতে ক্রমশ রক্তিম হয়ে যাচ্ছে পথ । মোছা যাচ্ছে না কিছুতেই ,পায়ের আঙ্গুলের ছাপ, একদল মাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের মিছিল

তবুও তারা এগিয়ে চলেছে লক্ষ্যে

 

লক্ষ্য মানেই এক বুক আশা

মৃত্যুর আশঙ্কা অনিশ্চিত সময়ের হাতছানি

 

লক্ষ্যের কান্ডারী যারা তারাই দোদুল্যমান

কচু পাতার মতো নড়ছে তাদের মুন্ডু

বর্বরতা অবিশ্বাস কেচ্ছা রক্তাক্ত মাটি  উপহার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ কৃষ্ণপক্ষের মতো

 

মায়েরা নক্ষত্রের চেয়ে তীব্র আলোকবর্তিকা

গর্ভে ধারণ করে আকাশ বাতাস সমুদ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড

 

ভেবেছি হয়তো আলোর মতো ভোর আসছে ,

হয়তো মিছিল আরও দীর্ঘতর হচ্ছে,

হয়তো ধর্মের চেয়ে বিবেকের বাণী তীব্রতর হচ্ছে

হয়তো কোনদিন কামিত মানুষেরা মাথা নত করে বলছে, "ক্ষমা করো"।

 

 

গল্প: আতংকের ঋতু

মৌ মধুবন্তী

 

রাতভর চোখে ঘুম নেই। ভোরবেলায় ঘুম চোখে বাথরুম থেকে ফেরার পথে টিভি অন করতেই নিউজ থেকে ভেসে আসে তিন সন্তানের সামনে তাদের বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে,  মধ্যরাতে ঘরে ঢুকেছে কয়েকজন আগুন্তক এবং তিনসন্তানের দিকে বন্দুক তাক করতেই বাবা আগলে দাঁড়াতেই তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায় বন্দুকের গুলিতে। সন্তানেরা জানে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য প্রতক্ষ্যদর্শী হয়ে ট্রমাটিক জীবনের ভারবাহী হয়ে রইলো…

শরতের হালকা রোদে টরন্টোর একটি ক্যাফেতে মুখোমুখি বসে ছিলেন দুই লেখক—নিলয় ও সায়রা। বাইরের বাতাসে পাতারা ঝরে পড়ছে, কিন্তু তাদের চোখে ছিল অস্থিরতা। চারপাশে যেন এক অদৃশ্য ভয় ছড়িয়ে আছে।

"তুমি লক্ষ্য করেছো?" নিলয় বলল, কফির কাপটা হাতে নিয়ে। "প্রতিদিন খবরের কাগজে গুলির ঘটনা। রাস্তায়, দোকানে, এমনকি ঘরের ভেতরেও। মানুষ যেন মানুষকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না।"

সায়রা মাথা নাড়ল। "হ্যাঁ, দাবদাহের মধ্যে মানুষ আরও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আবহাওয়া যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি মানুষের আচরণও। মনে হয়, সমাজের ভিতটাই নড়ে গেছে।"

নিলয় একটু থেমে বলল, "আমার নতুন উপন্যাসের প্লটটা এই নিয়েই ভাবছি। এক শহর, যেখানে আতংকই নিত্যদিনের সঙ্গী। মানুষ ঘুম থেকে উঠে জানে না, দিনটা শেষ করতে পারবে কিনা।"

সায়রা হেসে ফেলল, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল বিষণ্নতা। "আমিও লিখছি। তবে আমার গল্পে একজন বৃদ্ধা আছে, যিনি প্রতিদিন জানালার পাশে বসে অপেক্ষা করেন—তার ছেলে ফিরবে কিনা। সে একদিন বের হয়েছিল বাজারে, আর ফেরেনি।"

নিলয় চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পর বলল, "আমরা লেখকরা কি শুধু documenting করছি, না কি কিছু বদলাতে পারি?"

সায়রা চোখ মেলে তাকাল, "আমরা যদি ভয়কে ভাষা দিতে পারি, তাহলে মানুষ বুঝতে পারবে—এই ভয়টা তাদের একার নয়। তখনই হয়তো তারা একে অপরের দিকে হাত বাড়াবে, অস্ত্র নয়।"

 

ক্যাফের জানালার বাইরে তখন একদল শিশু খেলছিল। তাদের হাসির শব্দে যেন কিছুটা আশার আলো ফুটে উঠল।

নিলয় বলল, "তাহলে ঠিক আছে। চল, লিখি। আতংকের গল্প নয়, সাহসের গল্প।"

সায়রা মাথা ঝাঁকাল, "হ্যাঁ, কারণ সাহসই তো শেষ পর্যন্ত মানুষকে মানুষ করে তোলে।"

সেই মুহূর্তে ক্যাফের দরজা খুলে এক তরুণী ঢুকল, হাতে একটি বই—সায়রার লেখা। সে এগিয়ে এসে বলল, "আপনার গল্পটা পড়ে আমি ভয় কাটিয়ে উঠেছি। ধন্যবাদ।"

নিলয় ও সায়রা একে অপরের দিকে তাকাল। তারা বুঝে গেলেন—তাদের কলমে এখন শুধু শব্দ নয়, দায়িত্বও আছে।

বাইরে তখন সূর্য একটু ঢলে পড়েছে, পাতারা আরও ঝরছে। কিন্তু ক্যাফের ভেতরে আলো যেন একটু বেশি উজ্জ্বল লাগছিল।

 

প্রিয় কবিতার জন্মদিন 

মহুয়া জানা  


ঠিক করে তো জানাও হোলনা 

গলি ঘিঞ্জি , সময়ের ধারাপাত --

তবু আজ ভালোবাসার জন্মদিন ।

ঠিক করে তো ছোঁয়াই হোলনা 

অতলান্ত সমুদ্রের গভীরতা ।

ধাতব দেওয়ালটাতে গতিরুদ্ধ হতেই 

অবলম্বন ছিলো যে হাতটা --

সেই সত্যের আজ জন্মদিন । 

ঠিক করে তো ভেজাই হোলনা ---

করা গেলোনা বিনি সুতোর রহস্যভেদ , 

শুধু নিত্যতার চলন বলনে সঙ্গী ছিলো 

যে চোখ -- সেই সুন্দরের আজ জন্মদিন । 

ঠিক করে তো বলাই হোলনা ,

অনুক্ত পদাবলী আর সাতকাহনের অভিমান ।

তবু আজ প্রিয় কবিতার জন্মদিন । 

 

অবস্থান্তর

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়

 

ছড়ানো জলপাই ফুল চন্দ্ররাত

আর বনছায়া মাখা গভীরতা

এই সবদিন গুলো গড়িয়ে গিয়ে

সরে যাওয়া ঢেউ হয়ে গেলো

 

এখন  চটজলদি বার গুলো

মনে করতে পারি না

কতো তারিখ তাও খুঁজে দেখতে হয়

হরিণবাড়ির চর জুড়ে শুধু নৈ:শদ্য

বাঁকা নদীর মতন অতীতচারী বাল্যকাল

 

আর আকাশজুড়ে ভেসে যাওয়া

পাখির মতন বর্ণমালা

পৃষ্ঠার ওপর কলম ধরলে

থরথর করে হাত কেঁপে যায়

নিজের নামটুকু কখনও কখনও

কেমন না লেখা হয়ে যায়

 

তখন অস্ফুট শব্দে মুহূর্ত ভাঙে

কারও শ্রবণ গ্রাহ্য হয়ে ওঠে না

 

গল্প: স্নানযাত্রা

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

জানলা দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া আসছে। বাইরে আলো।ভেতরেও। সজনে গাছে ফুল। দু একটা হলুদ পাতা এখনও খসে পড়ছে। চারিদিকে ফাগুনের ডাক। নির্মলা ভেবেছিলেন জীবনটা যেভাবে কেটেছে চারদেয়ালের ভেতর সেভাবেই কেটে যাবে সামান্য আর কটা বছর। স্বামির মুখটা আর তেমন মনে পড়ে না একথা সত্যি। হলদেটে হয়ে যাওয়া বিয়ের ছবি আর তরুণ রামপ্রসাদের চেহারা দেখে এখন অবিশ্বাস্য লাগে যে এই পুরুষটির সঙ্গে সহবাস করেছেন কখনও এবং সেই হেতু এক পুত্র রমেশ আজ চল্লিশ।দুটি নাতনি। কন্যা অর্চনার বিয়ে হয়ে গেছে ইস্কুল পার করে। সেও তিন ছেলে মেয়ের মা,গিন্নিবান্নি। জন্ম থেকে শুরু করে এই পঁচাত্তর বছর বয়স অবধি তিনি দুটি জায়গা চিনেছেন এক,বাপের বাড়ি সিউয়ান আর দুই কলকাতা শহর থেকে একটু দুরে কামারকুণ্ডু । সারা জীবনে বারকয়েক দক্ষিণেশ্বর আর কালিঘাট ছাড়া তাঁর দৌড় এলাকার পড়শিদের ঘর আর বাজারে তাঁদের স্বামি শশুরের দোকান যা এখন রমেশ আর তার শালা ব্রজেশ্বর দেখাশোনা করে। কিন্তু সেও দুবছর আগের কথা। বাতে পঙ্গু  এবং নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছে।বুঝতে পারেন সংসারে বোঝা হয়ে উঠেছেন।এই সংসার যা তাঁর ঘাম রক্ত পূর্নিমা একাদশী করৌয়া চৌথ আর রাত জেগে সন্তান মানুষ করে শেষ হয়ে গেছে নিরবে তাঁর রূপ,যৌবন,জীবন।

বিছানা থেকে উঠতেও কষ্ট রোজ পুত্রবধূ আর নাতির গাল শোনেন সামনে নয় আড়ালে। তাই গত সপ্তাহে যখন জামাই ছেলে মেয়ে আর ব্রজ এসে বললে সবাই মিলে মা কে নিয়ে কুম্ভে স্নান করতে যাবে তিনি পাল্টে গেছেন,আনন্দে দিশাহারা হয়ে গেছেন বলতে গেলে শরীর অর্ধেক সেরে গেছে উত্তেজনায়।

তারপর এসেছে তীর্থভূমি।আকাশ আর আকাশের নিচে একটা মস্ত পৃথিবী।একই উদ্দেশ্যেঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে চলেছে মহা সমারোহে।আঁকড়ে ধরেন নির্মলা অন্ধের যষ্টির মত রমেশের হাত।

                 এত মানুষ আর এত আলো এত বিপুল আয়োজন দেখে নির্মলা সেদিন হতবাক। না পাপ না পুণ্য না ছেলে না মেয়ে কিছুই মনে ছিল না। ওরা আছে পাশে আঁচল ধরে,হাত ধরে। ডুবকি দেবার পর সূর্যের দিকে তাকিয়ে সবার মতো হাত জোড় করে ফিরে দেখলেন সহস্র মানুষ তাঁর আগে পরে। সেখানে চোখে পড়ে না কোথাও রমেশ কিম্বা তাঁদের দলের কাউকে। ভিড় কমে না। ভিজে কাপড় গায়ে শুকোয়।বসে বসে আত্মমগ্ন হয়ে সূর্যাস্ত দেখেন নির্মলা আর এক আশ্চর্য র্পৃথিবী।

চারিদিকে ঝলমলে আলোয় রাত এক মহা উৎসব। নির্মলার তেমন ভয় করছে না এভাবে আত্মীয়বিহীন হয়ে গিয়ে বরং কেমন এক পিঞ্জর মুক্ত বিহঙ্গের মতো উপলব্ধি হচ্ছে। দূরে টহল দিচ্ছে পুলিশের দল।মূর্খ একেবারে নন নির্মলা।ঠিকানা বললেই পুলিশ তাঁর মতো বৃদ্ধাকে সযত্নে পৌঁছে দেবে কুলায়ে। নির্মলা তাকিয়ে দেখছেন প্রয়াগের জল।

তিনি কি আবার ফিরে যাবেন তাঁর বিবর্ণ ঘরটিতে! নাকি এই স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করবেন তাঁর শেষের জীবনটুকুতে,হারিয়ে যাবেন এই সুজলা দেশের জনস্রোতে।ভাবছেন নির্মলা দেবী।

 

সাঁতার 

বিশ্বজিৎ রায়

 

তোমার সঙ্গে সাঁতরাতে সাঁতরাতে আঁধার নেমে এলো

একটা উদাসী বক উড়তে উড়তে ফিরে এলো ঘরে

যে হাওয়ারা ভেবেছিল উত্তরের নির্জন বেয়ে

চলে যাবে দক্ষিণে

তাদের ডাকবাক্সে নতুন করে আমন্ত্রণ পত্র এলো 

মনখারাপ করে থাকা নির্জনে ....

 

এখন কি আবার ঢেউ জাগবে নতুন করে?

মেঘের গায়ে ফুটে উঠবে আকাশ জাগানো আলো --

যদি তাই হয়, তাহলে কি আবার আমরা

সাঁতরে পার হবো একটা নদী, বলো?

 

সবুজ

ইলোরা বিশ্বাস

 

পাতার ছিদ্র ছিদ্র রঙে ভরা

পাপড়িরাও বর্ষায় স্নান সমাপনে

ফুটফুটে ফোয়ারা জীবন মূহুর্ত বড় কম

জন্ম হতেই ভালোবাসা প্রতিক্ষণ

কিছুটা ক্লোরোফিল চেয়ে নাও

হোকনা আরো ছোটো এ জীবন

তবু তো ভালোবাসা থাকুক সারাক্ষণ

চাইনা এ ক্লেশ নির্দয়তায় ভরা বদ্ধ জীবন

দিও একমুঠো সবুজ পরেরবার ভিক্ষারদান

শুধু আমরা পারিনা প্রকৃতি হয়ে উঠতে

শূন্য দীর্ঘ জীবন অপার

 

মগ্ন 

মালা ঘোষ মিত্র

 

শরীরের সাঁকো ধরে

পারাপার করে দ্যাখো---

সমস্ত খোলস ভেঙে বেরিয়ে পরে

মাংসল অস্তিত্ব----

দিনান্তের আশ্রয় স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার মতো

ছায়াপথ ধরে---

এগিয়ে চলি, নাভিমূলে চুম্বন আঁকো

গন্ধে মাদকতা জাগে

দামামা বেজে ওঠে----

বোধ অতলান্ত পাহাড়ের চূড়ায় ছোঁয়,

আঁকো যত দংশন ক্ষত

মগ্ন  নিজে, আড়াল থাকে না,

এলোমেলো হয়ে ওঠে জীবনরেখা

অভিমানেও বদলে যেতে

নিশ্চুপ থাকি---

পরিবর্তনে গহীন হয় জারুল ছায়া,

আলোছায়া নিয়ে বাতাস ঘূর্নায়মান,

কানে কানে বলে, ধৈর্য্য ধরো-----।।

 

ছাতা আর জলের বোতল

কৃষ্ণাংশু মাকুড়

 

এখন আবহাওয়ার ফোরকাস্ট্ দেখে বের হই

পথে রোদ, বৃষ্টি

ছাতা জলের বোতল সামলায় ব্যাগ

ওয়ালেট বেশ পিছিয়ে, মোবাইল ত্রাতা

পরম আনন্দময়!

 

যে সময় পকেটে একটা চায়ের পয়সা ছিল মোটে

ছিল না কোন রোদ জল বাঁচানোর ছাতা

চিন্‌চিনে খিদের পেট নিয়ে হেঁটে গেছি

শিবতলা থেকে ঈদগাঁ বেমালুম

চুল থেকে চুঁইয়ে পড়া চালচুলোহীন নোনা বাতাসে

সারাপথ জলের মত ঈশ্বর বয়ে গেছেন

 

বেশ অনুভব করি

ছাতা আর জলের বোতল সাথে রাখার মধ্যে

কোন বাহাদুরি নেই!


 বাঁকা

অনন্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

প্রতিদিন বাঁকা হচ্ছে হাতের লেখা

প্রতিদিন বাঁকা হচ্ছে যত অক্ষর লিপিমালা

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত

ভিতরে বাইরে সর্বত্র ...

চেষ্টা কি করছি না ?

চেষ্টা কি করছি না আমি প্রাণপণে?

 

প্রতিদিনই বক্র হচ্ছে অস্থি পেশি স্নায়ুরাশি

পা থেকে মাথা পর্যন্ত ...

কোথাও কি ব্যতিক্রম থাকতে নেই তার ?

 

প্রতিদিনই বাঁকা হয়ে যাচ্ছে হাতের লেখা

শুধু কি হাতের লেখা?

শুধুই কি হাতের লেখা?

 

সন্ধি খুঁজি

ননীগোপাল জানা

 

আদর মাখা বর্ণগুলো সন্ধি চায়

 আনন্দে সন্ধি করে

শব্দেরা নতুন সংসার বানায় ।

ঐকে বাক্য ও হয়।

 

ছন্দে সমাসে

অলংকারের সুন্দর সৃজন।

 সঙ্গীতের স্রোতে সন্ধি

গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে।

 

ভেদ বুদ্ধির মানুষেরা

ভাঙে আর ভাঙে

ভেদাভেদ বিভাজন

যুদ্ধ অশান্তি

আজ ভাঙলে এ র

কাল ভাঙবে ও র।

 

ইটের কাছে সন্ধি শিখতে হয় ‌

মন্দির বানাতে পারে

মসজিদ ও গড়তে পারে

নির্মাণ করে গীর্জা।

 

শিখতে পারেনি মানুষ

এক বিন্দু জলের কাছে ও

ঐক্যে মহাসিন্ধু

 

আকাশ রামধনু আঁকে কেন?

 

সর্বংসহা মা আসছেন

শংকর সামন্ত

 

শরৎ এলো হিমেল হাওয়ায়,

আকাশে পেঁজা তুলোয় গা ভাসিয়ে,

শিউলি ফুলের চাঁদর গায়ে,

কচুপাতায় রং লাগিয়ে,

সূর্য উঠে আকাশে ঘুমঘুম চোখের তারায়।

মা আসছেন বছর পরে, কৈলাসের ঘুম ভেঙে যায়।

 

সুখ যখন বস্তাবন্দি, দুঃখ জমে চাঁদপাড়ায়—

শিব মহাশয় রেগে আগুন, ভুবন কাঁপানো নাচন নাচায়।

দুঃখ-কষ্ট রইলো দূরে, শিবের নাচন নাচতে থাকি।

নন্দী-ভিঙেরা সব নেশার ঝুঁকি, সিঙ্গা ধরে টানাটানি।

মা পার্বতী ভীষণ কষ্টে—

যাবেন কি যাবেন না বাপের বাড়ি?

লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ—

সঙ্গে বাহন মামার বাড়ি।

 

যাই চলো, মর্ত্যধামে ড্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি বাজে—

সোনার মেয়ে আসবে কবে ধরাধামে?

রোগ-শোক যাই থাকুক, মা মেনকা কাঁদছে বসেই।

যাও গিরিবাজ, যাও—

যাও কৈলাসী জামাইবাবাজির নাচন থামাও।

চারটি দিনের তরে মেয়েকে নিয়ে আসার রথ পাঠাও।

 

মর্তবাসীর সুখ-শান্তি জগৎজননীর কাছে চাওয়া।

কাশফুলের দুলদুলুনি, মাসি-পিসির হয় যে দেখা।

বিপত্তারিণী মতে আসছেন গজের পিঠে চড়ে—

অসুখ-বিসুখ দূর করে শান্তির বার্তা মর্তধামে।

 

সর্বংসহা মা—আমার জগৎ পালনী,

সর্বত্র বিরাজ করেন দুঃখহারিণী।

চোর-চট্টায় মা, ভরে গেছে তোমার ধরণী।

তাই বলি মা, ধরায় এসে সংহার করো,

বিনাশ করো এখনি।

 

আলো ও নিঃশ্বাস

পবিত্রকুমার ভক্তা

 

ভোরের নিঃশব্দ আঙুল ছুঁয়ে যায় মাটির কোণে,

চোখে ভাসে জীবনের অদৃশ্য কোনো ছবি।

ধূসর আকাশের নীচে জমে থাকে স্মৃতির ধুলা,

একটি নীল প্রজাপতির উড়তে থাকে নীরবে।

 

শহরের অলিগলি বুকে গোপনে বয়ে চলে,

অন্তহীন এক সুর, অস্পষ্ট এক বাতাস।

 হুইসেল দূরে বাজে, দীর্ঘ ছায়ার ওপারে

মনের অবচেতনে ভেসে ওঠে বেদনাবিহ্বল তরঙ্গ।

 

শব্দগুলো হাত থেকে ফসকে যায়,

থেমে যায় কথার স্রোত, নিস্তব্ধতা নেমে আসে,

সেখানে সূর্যের আঙুলে পড়ে পলি,

রচিত হয় অন্তর্দৃষ্টির নীরব কাব্য।

 

জীবনের অচেনা কোণে জাগে এক অসম্পূর্ণ আশা,

ছায়ার নীচে লুকানো সমস্ত কথার অনুরণন।

আমি হেঁটে যাই, নিঃশব্দে এসবেরই মাঝখানে,

যেখানে সংসার আর কষ্টের স্বপ্ন বাঁধা।

 

গল্প: পুজোর তত্ত্ব

অশোককুমার মিশ্র

 

ঝুটোল মামা রেগে অস্থির- পুজোর ব্যবসা এবার তো মাঠে মারা যাবে রে দিদি।

মা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললো- কেন রে ঝুটু?ব্যবসার কি হলো তোর?মোবাইল কাজ করছে না নাকি!

-রোজ নেট নেই, আজ আবার আমার সময়েই আলো নেই-বলো এভাবে কি অনলাইন বিজনেস চলে?

মা বললে- এজন্যেই তো তোকে বারণ করেছিলুম ঝুটূ, ওসব অনলাইন-টনটাইন ছাড়।আজকাল দোকানের কী কমি আছে সব এলাকায়? তুই কার না কার কাছে শুনে এসেছিলি অনলাইন বিজনেসে নাকি লালে লাল হয়ে গেছে সে, অমনি তুই ছুটলি অনলাইন বিজনেস করতে!

 

মামা বলল- ক’দিন আর তোর ঘরে বসে কাজ না করে জামাইবাবুর অন্ন ধ্বংস করি বল! তাইতো রোজগারের আশায় ক’দিন আগে রিল বানিলে ছেড়েছিলুম চুপিচুপি তোর মোবাইল নিয়ে।আর দেখ সব রিলে দেখি শুধু দুই কে, তিন কে লাইক; আর আমার রিলে লাইক মাত্র একাশি! একাশি করে দিল আমায়!বল এতে কী রোজগার হবে?পুজোড় খরচা উঠবে! তোকে অন্তত একটা শাড়ি দেওয়া যাবে!বাবা মারা যাবার পর থেকে তো আর তোকে কিছু দিতে পারিনি রে দিদি।

 

মায়ের চোখে জল উছলে উঠলো।

মামা বললে- বুঝলুম এভাবে আমার দ্বারা বিলে রোজগার হবে না।আমি তো ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে রিল করতে পারিনি,পারিনি গলায় গোখরো সাপ জড়িয়ে রিল করতে!

মা শুরে চমকে উঠে বললো- ওসব করে রোজগার করতে হবে কেন তার চেয়ে চাকরী কর,যাহোক একটা কিছু,নইলে ব্যবসা।

মামা লললে- তাইতো এবার তোর মোবাইলে ফেসবুক পেজে অন লাইন শাড়ি বিজনেস শুরু করেছি।তুইই তো পাঁচ হাজার টাকা দিলি পরশু! কাল বড়বাজার থেকে কিনে এনেছি এত গোটা চারেক শাড়ি।

মা হেসে বললে- চারটে শাড়ি নিয়ে শাড়ি ব্যবসা!

 

মামা বললে- এক-একজন তো একটা করে শাড়ি, বড়জোর দুটো শাড়ি কিনবে।কাল এই শাড়িগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে দেখিয়েছি।পাঁচজন লাইভে দেখেছে। লাইক দিয়েছে একজন ।অর্ডার দেয়নি।শাড়িগুলো তো ভাঁজ করতে জানিনি। তাই এক জায়গায় পোঁটলা করে রেখে দিয়েছিলুম। আজ খুলতে গিয়ে দেখি লাট খেয়ে গেছে ওগুলো।আজ যখন বিকেলে কোনরকমে শাড়ি দেখাতে বসেছিলুম,তখনই ঝুপ করে গেল পাওয়ার কাট হয়ে। বিরক্ত হয়ে বসে রইলুম।আলো এল আমার স্লটের টাইম শেষ হবার পার। কিন্তু আমার অবস্থাটা ভাব তোর পাঁচ হাজার টাকা তো অন্তত ফেরৎ দিতে হবে!কি হবে এবার!

মা বললে দেখেনা যদি তোর কপাল খুলে যায়।

সাতদিন পরে ভাইয়ের ব্যববসা দেখতে গিয়ে মায়ের চোখ কপালে উঠে যায়।সাতদিনে একপাও এগোতে পারেনি সে।

মামা কাতর কন্ঠে বললে- দিদি তোকে তো পুজোয় কখনো কিছু দিতে পারিনি।শাড়িগুলো তোকেই দিলুম। একটা তুই নে আর বাকি তিনটের দাম ফেসবুকে বলেছি ছ’হাজার টাকা।তুই ওগুলো নিয়ে যাকে খুশী তত্ত্ব দিয়ে দে।আর আমাকে এক হাজার টাকা দিবি আমার ব্যবসার লাভের টাকায় পুজোর হাত খরচ।।

 

মা দুর্গার মহিমা

মধুমিতা পাল

 

শিশির স্নিগ্ধ ভোরে-প্রভাতী আগমনী সুরে- 

তুমি এলে ধরণী তলে,মহামায়া সর্বশক্তি বেশে...

 

শিউলি সুবাসে-গ্লানি সব মুছে- হৃদয়ের একতায় বাজলো বেনু,

 

শুভ্র মেঘের শরতে,আশ্বিনের উষ্ণ মধুমাখা রোদে

ঢাকির সুরে,উঠল ঘট প্যান্ডেলেতে-

 

পথে ঘাটে, ইঁটভাটাতে,বস্তিতে মলিন দুর্গা- 

সাদা কাশ চূড়া মাথায়-মহা আনন্দেতে,থাকবে না তো অনাহারে চারটি দিন উমার আশিষ জোরে

 

একশ আটটি পদ্ম অর্পিত অষ্টমীর সন্ধিপূজা-

আলোর রোশনাই,মখমলি সাজ,খাওয়ার মজলিস,হাজারো ভিড়- ষষ্ঠী,সপ্তমী,অষ্টমী নবমী

 

দশমীতে সিঁদুর বরন,একাত্মার সৌহার্দ্য বিনিময়, কৈলাশ ফিরে চলেন মা দুর্গা,বিজয়ার বিষন্ন মন

 

আশিষ ভরা হাত, কৃপা সমৃদ্ধ চরণ দুই খানি, ধরিত্রীর সকল প্রলুব্ধ যন্ত্রনার মুক্তি... 

নব সৃষ্টিতে নবজাগরণ,তোমার দুর্নিবার শক্তি-  

আবারও এসো মাগো,শস্য শ্যামলা এই বসুন্ধরায়

 

যেতে পারো

প্রশান্তশেখর ভৌমিক

 

যাবার তো কোনো বাধা নেই

ইচ্ছে করলেই তোমরা যেতে পারো জঙ্গলে

আমরা গেছিলাম গত বছর মার্চ মাসে

বাতাসে তখনও উষ্ণতার বাড়াবাড়ি শুরু হয়নি

না কোনো হিংস্র জানোয়ারের সঙ্গে অবশ্য হয়নি দেখা

তবে তারা যে আমাদের দেখে চোখ বুজে থেকেছে

একথা কে আর হলফ করে বলতে পারে।

 

আসলে জীবনটা এমনই ইচ্ছে হলে যখন খুশি

চলে যাওয়া যায় কেরালা থেকে কণ্যাকুমারি 

হাঁটাপথে উঠে যাওয়া যায় এভারেস্টের চূড়োয়

আমরা সেবার সেই যে মিলন উৎসবের রাতে

আকন্ঠ সুরাপান করে নেচেছিলাম চৌরাস্তার মোড়ে

তারপর নাচতে নাচতে চলে গেছিলাম দীঘার সমুদ্রে

আমাদের সঙ্গী ছিল এক উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত হরিণী।

 

সেদিন সেই হরিণী আমাদের বলেছিল

তার বেড়ে ওঠার কাহিনী কীভাবে একদৌড়ে

পৌঁছে গেছিল সে স্বপ্ন সাগরের শিখরে

তোমরা যারা যেতে আগ্রহী তারা এসো

দাঁড়াও সারিবদ্ধ হয়ে

যাবার তো কোনো বয়স নেই ইচ্ছে করলেই

যে কোনোদিন চলে যাওয়া যেতে পারে

যেখানে খুশি। বন্ধনহীন উড়ুক্কু মাছের মত। 

 

রক্তের কল্লোলে ভাষাহীন পাখি

সৌগত কান্ডার

 

রাতের গভীরে যখন শহরের কোলাহল স্তব্ধ হয়ে আসে,

আমি শুনতে পাই এক অপরিচিত হৃদয়ের স্পন্দন,

যা আমার নিজের বুকের ছন্দের সাথে মিলে যায়।

কে সে? কোন দেশের? কোন ধর্মের? কোন জাতের? জানতেও পারি না।

তবু তার হাসি-কান্না আমার নিজের মনে হয়,

যেন আমাদের উভয়ের ত্বকের নিচে,

একই পাখি ডানা মেলে বসে আছে।

পৃথিবীর মানচিত্রে যে রেখাগুলো আঁকা থাকে,

সে সব রেখা আদতে কলমের খোঁচা, হৃদয়ের নয়।

মানবতা আজ আশ্রয় নিয়েছে ভাঙা ঘরের পাশে বসে থাকা ছোট্ট শিশুটির চোখে,

যে চায় না খেলনা, চায় শুধু মায়ের কোলে বোমাতঙ্কহীন একটি শান্তির ঘুম।

তুমি আমি যে আলাদা, তা কেবল দেহের ছায়া—

আসল সত্য হল, আমরা একটাই আলো থেকে জন্ম নিই,

আবার একই আঁধারে হারিয়ে যাই।

 

হলদে পাখির গান

অসীম ভুঁইয়া

 

রোদ নিভেছে আবার

যেন অনামিকা ছুঁয়ে আছে

গোধূলি...

 

কতদিন হল। রূপসা আসে না ছাদে

দগ্ধতার কাছে।

 

তার বুকের দাগ চাঁদ হয়ে

জ্যোৎস্না ভেজে না আর।

 

অন্ধকার স্তরে স্তরে গভীর হতে থাকে

চোখে জমে যায় বরফের চাঁই

 

সেই মুহূর্তেই

ভেসে আসে কানে

হলদে পাখির গান।

 

গল্প: স্বাগতম

বর্ণালী ভৌমিক দে

 

অবশেষে বড়ো ফোনটা হাতে এলো অপর্ণার।  ছেলের সাথে পুরুলিয়া ঘুরতে গিয়েই তো মধ্য পঞ্চাশের জীবনে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে

সেদিন প্রখর রোদে জয়চন্ডি পাহাড়ের সিঁড়ি ভেঙে উঠছিলো অপর্ণা। খুব ক্লান্ত হয়ে বসে পরে সিঁড়ির উপরেই।  পাশে এসে বসলো অবিনাশ। সৌম্য দর্শন মানুষটি ওকে দেখেই যেনো থমকে গেলো। অবিনাশ হেসে বললো " বেশ অনেক সিঁড়ি তাই না। বেশ কষ্ট হচ্ছে উঠতে ।"

" তাই তো দেখছি। তবে উঠে যাবো ঠিক। "

পথের ক্লান্তি ভুলতে অপর্ণা ও

গল্প জুড়ে দিলো অবিনাশের সাথে। বেশ ভালোই সময় কাটছিল । ওপরে যাওয়ার তাড়া নেই যেনো ওদের।

- কি সুন্দর পলাশ ফুটেছে দেখেছেন !

 

- আগেও এসেছি। খুব ভালো লাগে রুক্ষতার মাঝে এই কমলা ফুলের বাহার। সবাই তো এগিয়ে গেলো আপনি গেলেন না ?

- আমি আসলে শখের ফটোগ্রাফার। আপনি কোথা থেকে ?

-- কল্যানী। ছেলের সাথে এসেছি।

- আপনার হাজবেন্ড আসেনি ?

- উনি নেই। সেনাবাহিনীতে ছিলেন। অনেক দিন আগেই  সীমান্তে মৃত্যুবরণ করেন।

- আমি অবিবাহিত। আসলে ঘুরে বেড়ানোর নেশাতেই আর সংসারী হওয়া হয়নি।

ব্যাগ থেকে একরাশ পলাশ ফুল বের করে অপর্ণার হাতে রাখলো অবিনাশ।

" রাস্তার পাশে একটি গাছ থেকে তুলে নিলাম। রাখুন আপনাকে দিলাম। "

একটু লজ্জা পেলেও হাত বাড়িয়ে ফুল নিলো অপর্ণা।

- আপনার হাতের একটা ছবি তুলবো ? আসলে আঙ্গুল গুলো ভীষণ সুন্দর।

- তাই না কি ?  কেউ কখনো বলেনি তো।

-শিল্পীর চোখ ম্যাডাম। অনুমতি দিলেই তুলতে পারি। আমার গ্যালারীতে রেখে দেবো ম্যাডাম। এটাই আমার পেশা এবং নেশা যাই বলুন।

বেশ। আপনার যদি কাজে লাগে আমার অসুবিধা কোথায়। তুলতেই পারি । দেখিয়ে দেবেন কেমন করে তুলবো আমি ঠিক অভ্যস্ত নই ফটো তুলতে।

দুই হাতে পলাশগুলো ধরুন অঞ্জলী দেওয়ার ভঙ্গিতে। দূরে পাহাড়গুলোর দিকে তাকান। এইতো অসাধারণ।

বলেই কিছু পলাশ অবিনাশ তুলে দিলো অপর্ণার হাতে। বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ফটো তুললো।

তারপর বলেছিলো "স্মার্ট ফোন ব্যবহার করলে অবিনাশ সোম বলে সার্চ করবেন ব্যাস আমি হাজির।"

    ফিরে এসে ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ অপর্ণার । সহজেই খুঁজে পেলো অবিনাশ কে। এই তো ওর হাতের ফটোটা পোস্ট করেছে অবিনাশ। ক্যাপশনে লেখা স্বাগতম ।

 

অসমাপ্ত রাগিনী

অজিত বাইরী

 

পশ্চিম সমুদ্রতীরে এসে দাঁড়িয়েছি;

ঢেউ গুণতে গুণতে

বেলা দ্বিপ্রহর।

 

মধ্যগগনের সূর্য

ঢলে পড়ছে পশ্চিমে।

 

সমুদ্র-চিলের বিশাল ডানা

ছায়া ফেলছে জলের উপর।

 

নিবিড় হল অন্ধকার।

 

ঢেউ গোণা সমাপ্ত হল না;

সূর্য নেমে গেল সমুদ্রে।

 

ফিরে এসো দুর্গা

প্রান্তিক কাপড়ী

 

দূরের তেপান্তরের মাঠে সাদা কাশফুলের ভিড়ে;

রেললাইনের ধারে আজও আনমনা অপু !

তাকিয়ে নীল আকাশে মেঘের পানে।

তোমার কথা ভেবে শুধু তোমার অপেক্ষায় --

একমুঠো দুপুরে বহু পুরনো স্মৃতির ক্যানভাসে -

ফিরে এসো আগমনীর" দুর্গা" রূপে।

আলতা পায়ে আটপৌরে শাড়িতে এসো"উমা "

তোমার হাত ধরে শুধু তুমি আর আমি ,

চলে যাব ধূসর শামিয়ানা ঘেরা ত্রিভুবনের পারে ।

"নীলকন্ঠ" পাখি হয়ে ,হারিয়ে যাবো বাউন্ডুলে ঘুড়ির মতো।

 

আর্তনাদের স্বরলিপি

মধুমিতা বেতাল

 

খনিজ বলতে শুধুই অভিমান আর অভিযোগ,

এর বাইরে তেমন কিছুই আর খনিত হয় না।

ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মতো কান্না ঝরে পড়লে

এলাচের ফুলের সাথে খেয়ে ফেলি প্লাবন।

সেও এক দূর্বিসহ বিষ ফোঁড়ার টনটনানি--

ঠিক যেন কণ্ঠনালীর একেবারে অগ্রভাগেই

বাসা বেঁধেছে ভীমরুলের কঠিন আর্তনাদ।

এখন মাঝ পথ, আরও পুরোপুরি অর্ধেক

পথ বাকি, কালো ভ্রমরের ডানাতেই আমার

সূর্য ওঠে আর ডোবে। বাম বুকে ধিক ধিক করে জ্বলছে

তোমার নাম লেখা উলকি, তবু তোমাতেই ডুবি আর ডুবি।

 

কোথাও তো কিছু ভুলে এসেছি, বিপুল শতর্কতাতেও

আজ আমি নিঃস্ব। কে বলে ছিল এমনতর ডাকতে!

 

স্রেফ তুমি

শ্রীমহাদেব

 

তুমি হাসলেই ফুল ফুটে ওঠে

মুছে যায় অন্ধকার

আলো আলোয় রঙিন সকাল

 

তুমি কাঁদলেই

লোড শেডিং

পৃথিবীর গভীর অসুখ

হাসে মহাকাল

 

জেগে ওঠো রোজ

সূর্য ওঠার আগে

ভুল চুক মায়াগুলো

কোথায় পালিয়ে ভাগে

মায়ায় ছায়ায়

নরম হাওয়ায়

 

মুছে যায় অন্ধকার

আলো আলোয় রঙিন সকাল।

 

আয় ফিরে আয়

রীণা পাল দত্ত

 

কারোও সাথে দিয়ে আড়ি,

সত্যিই কি যাওয়া যায়, বাড়ি।

 

কষ্টেরা তো পিছু নেয়, সারাক্ষণ—

যে দেয় আড়ি, ভালো থাকেনা, তারও মন।

 

হয়তো ঝগড়াটা হলো বলেই, এত পিছুটান—

ভুলগুলো মনে, হুল ফোটায়, বিস্তর অভিমান।

 

মন পোড়ায়, চোখ ভেজায়, বেদনাগুলো রাশি রাশি,

স্মৃতির পাতাগুলোও হেঁটে চলে যায়, বলে আজ আসি।

 

বেলা অবেলায় কখন কেটে যায়, সময় গতিহীন,

মন খারাপের পাপড়িগুলোই, আজ তাজা বেশী, আমি সঙ্গীহীন।

 

আয়না ফিরে 'বন্ধু' আমার, হাঁফ ছেড়ে বাঁচি আমি,

তুই যাওয়ার পর থেকে আজও, কেটেছে বিনীদ্র যামি।

 

সময়ের গতি যে থেমে থাকেনি, গিয়েছে নিঃশেষে ফুরিয়ে—

রাজার মতো আয় ফিরে আয়, মনের শুকনো ধূলো উড়িয়ে।

 

বোবাবুক, চাপা স্বর, বোঝাচ্ছে আমাকে,

আমার ছোট্ট একটি ভুল—

তুই ফিরলেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে,

হবে না দিতে, আমায় মাশুল...।।

 

প্রেমে ও চৈতন্যে

বিধানেন্দু পুরকাইত

 

একটি সকাল জুড়ে ছবি আঁকি

তার শরীর জুড়ে পথ যেন চলে গেছে হলদির চরে

আকাশে নেমেছে শ্রাবণ

তবুও আগুনে দগ্ধ মন তার বুকে পৃথিবীর মানচিত্র আঁকে।

 

সে তো উর্বশী নয় - বিদূষী কিনা জানা হয়নি

কতবার কাছাকাছি এসেও ছোঁয়া হয়নি মিঠে সুরে

তার পায়ের নূপুর আলতায় আরও সুন্দরী হয়ে ওঠে

সে এখন সূর্যোদয়ের দিকে হেঁটে চলে ।

তার ডাকে ঘুম ভাঙে

আড়মোড়া দিয়ে ফিরে যাই

হলদি নদীর চরে তার শরীরের

সুগন্ধি ঘ্রাণ মেখে আমার চৈতন্যে।


 সাতটা সুরে 

সুমিতা মুখোপাধ্যায়


সুপ্তি যখন আদর পেতে চায়

আমার তখন লেখালেখির ভাব

হয়ত সবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে

বেশতো , আমি চাঁদের পাশে বসি ।

রাত্রি যখন জাপটে ধরে বলে

ওরা নয় তুমি আমায় গান শোনাও

হয়ত তখন সমেই মাত্রা কাটে

রোজ ফিরে যাই দিনকে ভালোবেসে ।

ব্যাপ্তি যখন তোলপাড় করে মন

আমি তখন কাঁদবো অঝোর ধারে

সাতটা গর্ত খুঁড়েছে ডোম চাচা

সাতটা সুরে সাত সাগরের পারে


ঝরঝর বাদল দিনে

সন্দীপকুমার মান্না

 

নিরন্তর ভাদ্রের সকালে আত্মতৃপ্তির পরম মমতায়

রেখে গেলে তোমার পদচিহ্ন

বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন

অহঙ্কারের গরিমা মুহূর্তেই লন্ডভন্ড লুপ্ত আধুনিকতা।

মাঠের পর মাঠ সবুজ বিপ্লবে আকাশ'কে চায় ছুঁতে

আহ্লাদে তারা মগমগ গদগদ

অক্ষরেখার ক্রান্তীয় নিম্নচাপ

জলথৈথৈ আশীর্বাদে কাশফুল আগমণি সুর শোনায়।

গ্রামগঞ্জে'র চলমান জীবন এইভাবেই বেশ মানানসই

সকাল সন্ধ্যা চাঁদ নামে কাছে

গর্বিত পদ্মের জন্ম হৃয় পাঁকে

সুদিনে অহঙ্কারী পদ্ম ভুলে যায় ঝরঝর বাদল গাঁ'কে।

প্রাণশক্তিতে ভরপুর প্রত্যয়ী মন আপন করে শত্রু'কে

ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয় কালিমা

বৃষ্টি নামে মুষলধারে নমস্কারে

বৃষ্টি বাদল রামধনু বিস্তারেই তাঁর অস্তিত্ব জানান দেয়

 

হারবেরিয়াম- প্লেরোমা উরভিলিয়েনাম

ডরোথী দাশ বিশ্বাস

 

পাহাড়ী নির্জনতায় রোদে-হাওয়ায় মেলে দিয়ে দল

কাটায় সে মুগ্ধ প্রহর বিষমপৃষ্ঠ পত্র মখমল

 

জড়াজড়ি শিরাজাল জটিল জীবনরেখায় সমতা

আনয়নে সচেষ্ট সে যেন নির্লিপ্ত রূপকথা

 

বেগুনি বিষাদী হাসি ফুল হয়ে ফোটে যেন প্রাণ

মৌমাছি বাতাসের কানে কানে গাহে চুপকথা গান

 

ফুল যেন শত শত শান্ত মুখ শরতে ও গ্রীষ্মে

ঋতুর খেয়ালিপনার ধার ধারে না একটা বড় সে

 

আলগোছে জেগে থাকা পাতাগুলো ম্লান আলোস্নাত

বলছে: 'এখনও নির্জনে আমি জীবিত জাগ্রত।'

 

এতো শুধু ফুল নয়, একটা অভিজাত নীরবতা, 

আত্মমর্যাদার স্পর্শ চায়, ভাষা নয়, উপলব্ধি তা।

 

জীবনের স্পন্দন সব করেছো অনুভব?

 

যার সৌন্দর্য শুধু চোখে নয়, হৃদয়েতে করে বাস,

বয়সের ভারে মখমলি পাতা ছেড়ে দেয় দীর্ঘশ্বাস,

 

প্রণত আভূমি

দেখেছো কি তুমি--- 

 

বেগুনি ফুলের গভীরে লুকিয়ে থাকা নীল বিষাদ

তবুও হাসিতে নিত্য লেগে থাকে আনন্দের স্বাদ।

 

অজর অমর অক্ষয়

অন্তরে মনে রয়

 

পাতা ফুলসহ ডাল শুকিয়ে, চেপে, সময়ের পাতায়---

স্থির, অথচ জীবন্ত ইতিহাস হয়ে সে রয়ে যায়

 

 শুকনো পাতায় আজও কি রয়ে গেছে সেই হালকা সুবাস? 

চোখ বুজে আজও কি পান করা যায় তার বেগুনী নির্যাস?

জাদুকাঠির স্পর্শে ভাঙবে কি ঘুম, ঝরবে অশ্রূ টাপটুপ?

সে তো আজও বেঁচে আছে কবিতার মতো করে চুপ।

 

শরতের কবিতা

আনন্দমোহন দাশ

 

শ্রাবণের হাত ধরে সে এলো

কয়েকটি জল - ফরিঙ সাঁতার কাটছে হাওয়ায়

রূপনারায়ণের চর থেকে ভ্যানরিকসা ঠেলে

বেলেমাটি আনছে রাধেশ্যাম কুমোর।

কচি কলাপাতায় শিশির ও রোদ্দুর ...

 

ভাদর কাটিয়ে কাঁখে ছেলে নিয়ে স্বামীর ঘরে ফিরছে হারার বউ।

পথ প্রান্তে বুনোফুল, ভ্রমর উড়ে যায় ।

 

আকাশ যতটা নীল, তার চেয়েও আরো নীল

আমাদের বাজার - বসতি। এমন মধুর মাসে

আকালের হাওয়া । বেনো জলে হেলে পড়া ঘর

মেরামত করছে নারাণ ও তার ছেলে।

 

পাশে দিঘির বুকে বুড়ি বেশ্যার মতো চোখ টিপে

হেসে উঠছে শালুকগুচ্ছ ...

 

ছবি

রবীন্দ্র সিংহ রায়

 

ভাঙা মন্দির । তার পাশে শুয়ে আছে

ন‍্যাংটো শীত-দুপুর।

আজ বুবু ডোমের পুকুর

বড় শান্ত , মৌন জলপিপি...

ঘাটের ধাপে ধাপে বৃদ্ধ ফকিরের

পদচিহ্ন ; স্তবের স্পর্শ ।

প্রাচীন গল্পের ন‍্যায়

এই প্রহরের গন্ধ । এসবের পাশ দিয়ে

বাড়ি ফিরছে আলো কাকীমা । তার দু-চোখে

ঘুমকণা... পা-এ ধ্বনি;  ক্লান্তি নূপুর ।

 

দুপুরটা নিভে আসছে নীরব মৃত্যুর মতো‌ 

 

অক্ষর-সংরাগ

মনোতোষ আচার্য

 

নিঝুম দুপুরবেলা ক্লান্তপাখা ব্যস্ত সূঁচসুতো

প্রায়শই ঘর ভুল প্রেমকথা কার্পেট বুনন  

অদেখার যন্ত্রণায় স্নায়ুবিকারের পাঠমালা

গোপনীয় আর্তনাদ শুদ্ধতম আত্মখনন

 

স্মরণীয় অন্ধকারে এসো তবে নিদারুণ স্নেহে

সজল প্রশ্বাসে নিই ঋদ্ধতম যাপনের ভাষা

চতুর শরীর ভ্রম ধন-জন-যৌবন বারতা

গাছালির শাখে শাখে মৃত্যুজয়ী পরশের আশা।

 

সোহিনী মুদ্রায় জাগি দুঃখ মাপি প্রাগার্য আগুনে

অনাহত বারমাস্যা গোপন শৃঙখলা খায় ভেঙে

প্রস্রবণ বারিধারা শান্ত করে শরীরের ক্ষত

নিপুন জিজ্ঞাসাগুলি গতি পায় অক্ষর-সংরাগে।

 

কোমল কাজলরেখা স্পর্শ করে লাবণ্যের দ্যুতি

জ্বলে ওঠে দিনপঞ্জি আদিগন্ত অক্ষর-বিভূতি।

 

 

সব ভালো যার

রুমকী দত্ত

 

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো,মেঘের ঘনঘটা

তার সাথে এক বিরহ এলো, ঘড়িতে তখন ক'টা!

ভোরের বেলা, সময়টা ঠিক মালুম হওয়ার নয়

স্বপ্ন ছিল না কি বাস্তব,না কি অহেতুক ভয়!

 

বুঝলাম না,

কোন জগতে কাদের সাথে, তোমার ওঠা বসা

কোনো কারণ নেই

অকারনেই কঠিন অঙ্ক কষা!

কেন যে ভাবি,কঠিন সহজ মনের কথকতা

সুখ অসুখের দ্বন্দ্বে জীবন,নয় তো প্রগলভতা!

 

আমি বেশ ভালোই আছি,ভাবি না আর কিছু

শান্তি এলো,সুখও সাথে ভাবনার পিছু পিছু।

তুমি তবে মিথ্যা কথা বোলো না আর যেন

আর বোলো না প্রতি কথায় "প্রশ্ন করবে কেন?"

 

করব না আর সত্য বলছি,বিশ্বাস টুকু রেখো

সততা আর মানবতায় বিবেকের বাণী শেখো।

তখন দেখবে জগৎটাকে কেবল আলোয় আলো

সব ভালো যার শেষটুকুও হবেই যে তার ভালো!

 

ডুয়ার্স ও মধ্যরাত

রেবা সরকার

 

ভোরের সূর্য মাথার কাছে

ঘুমের চোখে পাহাড় খাল বিলের স্বপ্ন দেখে।

 

শহরের কোলাহলে রেললাইন ধরে যতটা পথ

রূপোলী মাছের আঁশ বিনিময়ে ইতিহাস।

 

তুমি ডুয়ার্সের আঁকিবুকি

হাতে তুলে দিচ্ছ  টিকিট

নিজের পরের তারপরের...

 

একযুগ পেরিয়ে আর এক যুগে

পায়ের কাছে সম্পর্ক লুটোপুটি।

 

ভাঙা কাচে পা কাটলে

অস্থিমজ্জা চুপসে আসে।

রংয়ের তুলিতে আঁকাবাকা দুঃস্বপ্ন।

 

মধ্যরাতের ডুয়ার্স

যুগ যুগ ধরে স্মৃতি অমোঘ

 

আবার উঠে দাঁড়াই

ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্য

 

প্রতিদিন সূর্য ওঠে চোখে

চারিদিক ঝলসে দিতে চায়

চোখ থেকে রক্ত নামে গালে

জলকামান, লাঠি প্রিজন ভ্যানের হাত

অক্ষম করে দিয়ে যায়

রোজই দেখি প্রতিবাদের লম্বা সুতীক্ষ্ণ নখ

খিদের কাছে কতটা ভঙ্গুর

যতবার দুমড়িয়ে মুছড়িয়ে থেঁতো হই

বুঝি, ক্ষমতার ইতিহাস পরিহাসপ্রিয়

স্মরণ করতে নেই কখনও

ক্যামেরার ফুটেজগুলো শাসকের হলুদ টেবিলে

ফাইলের তলায় ধুলো জমায়

আমরা রোজ ভাঙি থেঁত হই, আবার উঠে দাঁড়াই।

 

বে-রঙীন জীবন

মিঠু বারিক

 

অন্ধকারের বুক চিরে আলো খুঁজতে

চোরাবালির তটে স্বপ্ন গেঁথেছি।

জোয়ার ভাটার উদ্দামতা খুব টানতো আমায়,

হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি

রোজ অচেনা হচ্ছে সময় ধারা

চেনা জগৎ হচ্ছে অচেনা; ক্রমশ।

 

থমকে গিয়ে দেখি

বেঁকে গেছে চলার সকল পথ

ভাবনার অক্ষর যত সব ভাঙা ভাঙা ,

যার ছবি দেখে অন্দরে প্রবেশ করি

সে যেন মোহময় চাঁদ, অমল তার প্রকাশ,

কতো প্রশান্তি,  অনন্ত সুখের আশ্রয়।

 

যত্নে রাখো

চিরশ্রী দেবনাথ

 

ভালোবাসা নীরব সেতারের মতো

স্রোতহীন নদীর বুকে জেগে ওঠা অদ্ভুত মিনার

মিনারের ছায়ায় বাকি অর্ধেক জীবন

কেউ যদি বালি খুৃঁড়তে আসো

তবে তাকে জানতে চেয়ো না,  বুঝতে যেও না

আঙরাখা পুরনো হলে ওম হারিয়ে যায়

বাড়ি থেকে পথরেখা বিলুপ্ত হলে

সমাধির মতো হয়ে যায় উচ্ছলতা

দেহ থেকে ঝরে তমিস্রা , ভিক্ষুনীর মতো অপেক্ষা

উষ্ণতার হাত শীর্ণ হলে যেন আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরি

এভাবেই রাখি যত্নে, মৌনতায় , স্তব্ধতায়

 

জৈবিক

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সকালে গোলাপ ছিল সন্ধ্যায় বিপুল হয়ে ফুটেছে অন্যায়।সময়মতো ঝরে পড়েনি বলে প্রজাপতিও তাকায়না ফিরে আর। ওরা ঘরে ফেরে। হাঘরের দল দুটো পেট ভাত জোটানোর তাগিদে শত শত মাইল ছুটে যায়। অঙ্গের কাপড় খসায় রাধিকা সাউ। সকালে একবার ছড়ালো যে সুবাস সেই ফুল রাতহলে পড়ে আছে এইখানে ফুটপাত ধারে।কানা মৌমাছি ওড়ে নয়ানজুলির পাড়ে

ছেঁড়া ঝুনঝুনি যেন কার!

সকালে গোলাপ ছিল রাত হলে দেখেছি পচন ধরেছে তার লাশ।

 

পড়ন্ত বেলা

অশোককুমার আচার্য্য

 

সময় চলে গিয়েছে ঢেউয়ের মতো

স্মৃতির চাবি কাঠি মনের কোঠায়

দেখা হবে কোনদিন তোমার সাথে

কিছু থাকবে অনেক কিছু থাকবে না

অজুহাত বাহানা ছলছল দুটি চোখ

গোপনে অশ্রুপাত সিক্ত দুটি হাত

সমুদ্রতট নতুবা পর্বতের কোন বাঁক

খুঁজবো হারানো মুক্তো পড়ন্ত বেলা।

 

আকাশের নীল রঙে মায়া আছে

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল

 

আকাশের নীল রঙে মায়া আছে স্বপ্ন আছে এমনকি বেঁচে থাকার

কামকলাও আছে, তবু দূর্বোধ্য টেক্সট — ঘুমহীন দীর্ঘ রাতে

পিঁপড়ের ঠোঁটগুলো রজনীগন্ধ্যার ঝাড় থেকে বেরিয়ে আসে

কী অসম্ভব নির্জন আর কাঁচ খণ্ডে সাজানো সমস্ত অস্থাবর নৈবেদ্য

ইচ্ছায় শুধু ঝরে পড়ে আগুন খাওয়া এবস্ট্রাকট ইমেজ

এবার খর্ব করো হিংস্র তেজপুঞ্জ — পতঙ্গের জীবন নস্যাৎ করতে করতে

ভোরের পুব আকাশের তারাটি তুমিই

স্যাঁতসেঁতে ভৌগোলিক মানচিত্রে সাপের জিহ্বা সামনে তোমার ঋষিকল্প

আপনি কিছু বলবেন না জানি – বলার জন্য যে আকাশ দরকার

তার থেকে বেরিয়ে আপনি কানামাছি ভোঁ ভোঁ

অসুখি ময়ূর, দেখো দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে একটি পুরোনো শ্মশান

 

বৃষ্টি কথা

দিলীপ জানা

 

বৃষ্টির গন্ধ ছড়িয়ে পড়তেই

রাস্তার ধারে গাছের পাতাগুলো

ঘ্রাণ নিতে শুরু করেছে তোমার শরীরে।

মিলনের মাদকতায় মেঘ জানে

রজঃস্বলা মাটির আর্তনাদ।

ভিজে যাওয়ার সমূহ নেশা

পেয়ে বসে, গুপ্তহত্যা রহস‍্যের

জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো।

ভিজে যাওয়া শাড়ির মৌনতায়

ভেসে উঠছিল খরস্রোতা লাবণ্য,

ঝরে পড়ছিল নির্জনতার বোবা ইচ্ছা।

বৃষ্টির প্রবল তাপ পুড়িয়ে দিচ্ছে

বুকে লুকানো অনুচ্চারিত বর্ণমালা।

 

ধাঁধা

জুলি লাহিড়ী

 

ধূসর সবুজ ক্ষেতের ফসল সাজে পরিপাটি

চাষী ফলায় সোনালী ধান গায়ে মাখিয়ে মাটি।

গাছের পাতা ছন্দে তালে ঘুঙুর বাজিয়ে যায়

আসমানী রং দেয় যে ঢেলে নতুন এক আশায়।

মাতাল হাওয়া শান্তি ছড়ায় খুশিতে মাতে মন

জমাট মেঘ ভ্রুকুটি নাড়ে লাগে আপনজন।

মন হয়ে যায় অসংযত, বৃষ্টি লাগামছাড়া

শস্যভূমির সবুজ ফসল ভয়েই  দিশেহারা।

প্লাবন নামে নদীর বুকে, কাজলা মেঘ চোখে

সামনে তখন গোলকধাঁধা দুই পা টলে শোকে।

 

অলীক চাওয়া

সৌজন্যা মজুমদার রায়

 

আকাশ থেকে চাঁদখানা নয়,

দিতে পারলে মুঠোরোদ দিও...

উষ্ণতাকে গায়ে জড়িয়ে,

তুষার ঝড়ে হাঁটবো আমি

একলা আমার ভৈরবীতে।

 

মস্ত বড় শহরটা নয়,

দিতে পারলে সবুজ দিও...

আঁচল পেতে ফুলের রেনু

ছড়াবো আমি আলগোছেতে ।

 

মায়ায় ঘেরা সংসার নয়,

দিতে পারলে সন্ন্যাস দিও...

সুরের নেশায় বিবাগী হয়ে

মাতবো আমি একতারাতে...

 

কাল স্রোত

মোনালিসা পাহাড়ী

 

টুপটাপ খই ফোটার মতো

আলো ফুটছে শহরে

নিত্যদিনের মতো পাঁচিলের গা চুঁইয়ে

নেমে আসছে আলোর পানসি তরি...

যে রাত চলে গেল

সে সৃষ্টি করে গেল কতগুলো ক্ষত

বোঝা যাবে খবরের কাগজের পাতায় পাতায়-

 

তবুও চিরাচরিত যাপন

পুজোর ফুল,রান্নাঘর, সিরিয়াল, কর্তার বকবকানি,

ছেলেমেয়ের আব্দার

ছাপোষা জীবন জুড়ে পিঠালুর আল্পনার মতো

নরম ওম

 

হয়তো ভবিতব্য লাল চোখে বসে আছে

এ বাড়ির মেয়েটির দিকে

হয়তো এ বাড়ির ছেলেটিও হারিয়ে যাবে

হঠাৎ একদিন, অন্ধকারে

আর ফিরবে না

অফিস ফেরৎ এ বাড়ির কর্তা পড়ে থাকবে

চৌরাস্তার মোড়ে

কিছুই অসম্ভব নয়

শহর জুড়ে আজ শুধু অন্ধকারের চাষ

রাতের কালোয় যারা

জীবনকে বেচে-কেনে সস্তা দামে

অথবা বিনে পয়সায়

 

আলোর মন্ডপে তারাই বসে থাকে

আলোক সজ্জায়

খবরের পাতা গুলো লাশের রক্ত মেখে

কালো হয়ে থাকে

কাল স্রোত বয়ে যায়

আটপৌরে যাপনের মজ্জায় মজ্জায়।

 

গোপন অর্ঘ্য

সীমা সোম বিশ্বাস 

 

অর্ধচন্দ্র ঝুলে আকাশের ভাঙা ধারায়,

নীরব জলের মতো ছায়া ভেসে আসে শূন্যের প্রান্তে।

 

মায়ার পর্দা ঢেকে দেয় বুকের গভীরে,

যেখানে রাতের হিমবাহও গলে পড়ে মধুর স্রোতে।

 

ঠোঁটের আড়ালে লুকানো নদী,

চুম্বনের অর্ঘ্য ছড়িয়ে দেয় ছায়ালীন দ্বীপে।

 

দুটি হাত মিলিত হয় মধুর নদীর স্রোতে,

গোপন লকার খুলে দেয় অচেনা আনন্দের প্রবাহ।

 

বুকের গহ্বর—নির্জন আকাশ,

মেঘ ভেঙে যায় নীরব পূর্ণতার সন্ধানে।

 

কোমর—প্রবাহমান নদীর বাঁক,

স্রোতের ছোঁয়া নিয়ে আসে মিলনের ছায়াবীথি।

উরু—দুটি স্তম্ভের মতো অটল

যেখানে অন্ধকার মন্দিরে জন্ম নেয় নীরব পূজা।

 

অভিব্যক্তি—রাগিণীর মন্ত্র,

শিখর স্পর্শ করে অদৃশ্য চেতনার ধ্বনি।

 

সঙ্গমের অর্ঘ্য—লুকানো রত্নভাণ্ডার,

যেখানে প্রেম পূর্ণ,

শুধু দুটি হৃদয় একে অপরকে খুঁজে পায়,

পূর্ণতার নীরব প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে যায় অনন্ত আকাশে।

 

বেঁচে থাকার দিকে

খুকু ভূঞ্যা

 

ভালো লাগছে না প্রতিদিনের একঘেঁয়েমি

সবই রংচটা, অন্তর এখন ছেঁড়া ছেঁড়া গদ্য

চোখের উপবন ভরে আছে সরজলে

 

আমগাছের ফাঁক দিয়ে একফালি আকাশ

আমার মুক্তির কথা ভাবত

এখন শুধু মেঘ আর গুমোট

কতদিন যোগাযোগ নেই রোদের সঙ্গে তার

জোসনা ঘোড়া হারিয়ে গেছে ঝাঁকড়া মেঘের গুহায়

 

পাড়ার খোঁড়া বিনিদিদি আর খোঁজ নেয় না

কুয়াশা ভোরে পুকুর ঘাটে কে করে ঝনঝান

বৃষ্টির ঝাঁপটায় ভেসে গেছে কুমোরে পোকার ঘর

সব ভাঙনের মাঝেও দেখি, বিদগ্ধ জীবন হাঁটছে

প্রচণ্ড বেঁচে থাকার দিকে

 

এক একটা দুপুর

ইরা দোলুই

এক একটা দুপুর নিজেকে বাজিয়ে নেওয়ার

বুকের খাদে অজস্র পাথরের মরণ দৌড় !

সব আলগা ভালোবাসার খেয়ালী ঝুরো মাটি

এতোটা আলগা যখন তখন খাদানের চমক !

অপছন্দের জিনিস কত বয়ে বেড়ানো যায়?

নড়বড়ে কল কব্জার মত এখন শরীরও ভাঙছে...

যখন খিদে ছিল খাবার ছিল না পর্যাপ্ত

এখন পর্যাপ্ত খাবার পেলেও খিদে উধাও!

জীবন জুড়ে কানামাছি মেঘ রোদের প্রবাহ...

দূরে বাঁশি বাজে ধ্বনির সুখে পিছু পিছু

আমিও হাঁটি চুঁইয়ে পড়া অভিমান নিয়ে।

 

মায়াচন্দন

অমৃতা খেটো


থোকা থোকা, অন্ধকারের ললাটে

বিষাদের মায়াচন্দন এঁকে  দিই

টলটলে দিঘির কাছে রেখে আসি

নম্র, নত,ভোর

তখন এক দিকে আজানের সুর

অন্যদিকে "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি"

ঈশান কোণে মেঘ রোদের মৃদু আলাপ ...

 

জীবনটা নিতান্ত আটপৌরে

আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বের ভেতর

জীবনকে আলগোছে তুলে নিয়েছি

জীবন এখন সহজ সুরে গান গায়....

 

মুহূর্তেরা প্রতিমুহূর্তে অন্তর্ধান করলে

পড়ে থাকে  নৈঃশব্দ্যের বুদবুদ

অক্ষর পিপাসা নিয়ে জেগে থাকে

কয়েকটি ফুটফুটে জোনাকি...

 

আলোর বন্যা

পার্থ প্রতিম চ্যাটার্জী

 

ঘরে ঘরে উঠবে জ্বলে শারদ সুখের  আলো

মনের ঘর যে ছন্নছাড়া বিষণ্ণতায় কালো!

হাসির বন্যা সুখের বন্যা আসেনা জীবন জুড়ে

তীব্র দহন আর মনখারাপ নিরন্তর অন্তঃপুরে।

শুকালো ফুল ঝরেছে পাতা শূন্য বাগানখানি

শরৎ রাতেও তাপিত বুকে পীড়ন দিলো আনি।

আকাশ কালো মনও কালো আকাশ জুড়ে তারা

মনের ভিতর সুখের কণা সকলই হলো সারা।

আনন্দতো করতেই হবে জীবনে করেছি পণ

জ্বালিয়ে আপন আলো খুশিতে থাকবো আজীবন।

জগৎ টাকে ছোট্ট করে গন্ডি দিয়ে নিলাম ঘিরে

শারদীয়ার  অমল আলো জ্বলুক আমার নীড়ে।

দুর্গা  মায়ের চরণ তলে জগৎ হোক আজ আলো

দূরে যাক সবার বিষাদ শোক থাকুক সবাই ভালো।

 

সোনালী মৌমাছির ডানায় আলোর ঘর

চায়না খাতুন

 

একটা ভিড় জন্মের পর থেকেই আমাকে তাড়া করছে

ঠিক লোহা ঠিকরানো আগুন

আর থেঁতলে যাওয়া মুখ মরুভূমির

 

হেলিকপ্টার স্রোতে অদৃশ্য বাঁক

ইউক্যালিপ্টাস গাছের ছায়ায় বৈশাখী মুখ

সমুদ্রবেলায় গুলিবিদ্ধ পায়ের ছাপ থেকে সুগন্ধ

উদ্ধত হুরহুরের গন্ধের চেয়েও তীব্র,

রাইফেলগুলির মদির বক্ষে মুখ রেখে

দেখতে চেয়েছিলাম সোনালী মৌমাছির ডানায় নিষ্পাপ আলোর ঘর

 

একটা ভিড় লোহা ঠিকরানো আগুন হয়ে এখনও ধাওয়া করে

গোটা শরীরে তরবারির লালছাপ

লিবিয়ায় তৈরি তার সুরভি সভ্যতার শৃঙ্খলে এখন মুমূর্ষু,

ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই

আর একটা জাদুসূর্যের জন্ম

সোনালী মৌমাছির কন্ঠ থেকে আলোর সুবাস সংগ্রহ করে আনা।

 

খিদে

পম্পা মণ্ডল

 

গাছের নীচে নোংরা শতরঞ্জিতে শোয় মেরুদণ্ডহীন ছায়া।

কর্পূরের মত উবে যায় সালোকসংশ্লেষ।

 

নীলাকাশে চপারের শব্দে

গাছের সীমা ছেড়ে চোখ তোলে ছায়া।

 

ফিরে এসে পেটে গামছা বেঁধে উপুড় হয়।

খিদেরা জাগ্রত।

 

দৃশ্য

ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না

 

নরম আলোর জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে উড়ন্ত পাখির ছায়া

ঘরে ফেরার আগে জোড়া চিলের বৃত্তাকার প্রদক্ষিণ দৃষ্টিতে আঁকা থাকে।

ঢালু ঘাসের জমিতে গড়িয়ে নামে শাঁখ ঘন্টা।

ধ্বনিকে দৃশ্যে ধরে রাখা যায় কিনা ভাবছে হয়তো

আবছা রেখার সরু পথ,

আর ঘাসের

ওপর

ছোট্ট তরঙ্গ তুলল খেলনা ঘরের ভাব বিনিময়।

প্রকৃতদুটি চরিত্র দুদিকে হাঁটতে থাকলে  আলোয়

তাদের ছায়ারা একজন আগে আগে

আর একজন পেছন পেছনই যাবে

এ পর্যন্ত সমস্যা নেই

পেছনের ছায়া হঠাৎ দাঁড়িয় পড়ল যে

পথ ছেড়ে দেয়া চরিত্রটি সারা বিকেল জানালার পাশে বসে থাকে

শেষ পোকাটি খুঁটে নিয়ে ফিঙে উড়ে যায়...

 

প্রজাপতির মৃত্যু

বীথিকা পড়ুয়া মহাপাত্র

 

উদ্দাম হাওয়া বয়ে যাচ্ছে শরীর ঘেষে,

অপরাধের রঙ যদি কালো হয়

সেই কালো ময়লা মাখিয়ে দিচ্ছে 

উৎকট গন্ধওয়ালা বাতাস,

উদ্দাম কৌতুকে নারী শরীর থেকে

ওড়না উড়ে যায়!

 

পানাসক্ত হলে বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত হয়,

আসুরিক শক্তি রাহুর মতো

জ্ঞানালোক গিলে খায়,

ধূর্ত শেয়ালেরা তখন মাংসাশী হয়ে ওঠে,

খুব ভোরে খবর এ গলি, ও গলি হয়ে

আছড়ে পড়ে ঝড়ের পূর্বাভাসে।

 

লাল,নীল প্রজাপতিটি ডানা ভেঙে

পড়ে থাকে ঝিলপাড়ের

ঘাসের উপর!

সম্বিৎ ফিরলেও উত্থান শক্তি থাকে না,

মৃত প্রজাপতিকে বয়ে নিয়ে যা


 দ্বেষ 

গুরুপ্রসাদ যশ 


দ্বেষ অনেকটা বাল্যবিধোবার মতো 

ছোট্ট মুহূর্তকে দিশাহীন বয়ে চলতে হয় 


এ-ই ভাঙনের গতি মজা নদীর ঢেউ 

শরীরে মেদ মজ্জা আছে। শিরা

উপশিরা সচল  তবু খেসারত গুণতে হয়

 

মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটায়,  খসে পড়া 

পালোক বাতাসে  ওড়ে

ইচ্ছার টুটি টিপে বসিয়ে রাখতে হয়

জোনাকি আলোর নিচে । 

 

বার্গার

শিশির আজম

 

'এই শীতের রাতে তুমি কি বার্গার খাইতে চাও?' -- জিগাইলাম ওরে।

'চাই তো।' --উত্তর দিলো ও।

বেসিনে ও মুখ ধুইতেছিল, চুলগুলা ছাইড়া দেওয়া আর ওগুলা

বারবার ঢাইকা ফেলতেছিল ওর মুখ,

যেহেতু মুখ ছিল নিচু করা

আমি দেখেছি কোন মেয়ের মুখ নিচু হলে

তার ছাইড়া দেওয়া চুল তা ঢাইকা ফেলে।

আমার ভিত্রে খিদা আসতেছিল।

'আমি চাই না,'

কইলাম আমি, 'শীতের রাতে তাজা ভাঁপ-ওঠা বার্গার

খুবই পছন্দ আমার

কিন্তু আজ রাতে আমার দরকার নাই বার্গার।'     

 

সম্পর্ক

বৈদ‍্যনাথ ধাড়া

 

ছোট সংসার তবুও বাঁচতে

আঁটছি নানান ফন্দি,

সম্পর্কেরা ছোট হতে হতে

আমি তুমিতেই বন্দি।

 

হারিয়ে যাচ্ছে কত গাছপালা

পোকামাকড় পশুপাখি,

হারিয়ে ফেলছি মানবিকতা

দুর্নীতির মাখামাখি।

 

যে যত মহান তার অন্দরে

এখন খারাপ ভরা,

শৃঙ্খলা নেই শুধু চিৎকার

দেখানো মিছিল করা।

 

কালো অন্ধকার ধেয়ে আসছে

বুঝছি না তার কিছু,

আঘাত লাগছে সবার গায়ে

মেনে নিচ্ছে সবকিছু।

 

এমন সমাজ ছুটতে থাকলে

হবে না তো কাজ সারা,

উঁচু মাথাগুলো বাজারি হবে

বিকোবে শিরদাঁড়া।

 

এভাবে চললে আগের মতন

ডুবে যাবো গভীর পাঁকে,

যতই দেখাও আধুনিকতা

আলো আসবে না গলির ফাঁকে।

 

চক্রব্যূহ        

দীপক জানা

 

কোত্থাও কোনো সম্পর্ক নেই

ভোগের রেস্তোরাঁতে লালায়িত জিভ লকলক

জানালা দিয়ে মিথ্যে ঢোকে -

লাল, নীল, সবুজ, হলুদ

সম্পর্ক ডোডো হয়ে যায়

 

জঙলি হাঁসের মতো ডানা মেলে মিথ্যে স্বপন

সুখ খায়। হাঁটতে হাঁটতে থপ্ থপ্ পা ও থাবা

ওকে রাহু বলতে পারো, অথবা কালো ছায়া মেঘ

বৃষ্টি পড়েছিল কাল রাতে

 

মশারির ভেতর ঢুকে পড়েছিল, আচমকা

ভিজে ন্যাতা স্বপ্ন, আশাও

ষড়যন্ত্রের বত্রিশ সিংহাসনে কোথাও ফাঁক-ফোকর নেই

চক্রব্যূহে তুমি ক্রমশ একক অভিমন্যু -

এক অসম সমরের অদ্ভুত জাদুর ভেতর।

 

 রক্ত মাংসের দুর্গা

বনশ্রী রায় দাস

 

কে তুমি , চাঁপার পাপড়ি আঙুলে

রঙ মাখিয়ে দাও শিউলি বোঁটায় ,

একটু ছুঁইয়ে দিও দুধেল গাভির স্তনে

আর একটু প্রেমিক বুকের খাঁচায় !

 

তুমি কে, জড়িয়ে ধরে আদর করো

তরুণ কাশের চামর শুভ্র দোসর ,

শরৎ মেঘ বলে গেল আড়চোখে

ওতো বাবুর বাড়ি কাজ করে, মোহর ।

 

তুমি কে, আলগোছে খসিয়ে আঁচল ,

ছুটছে স্কুটি হোক না সে রাত দুপুর

বরাভয়ী রূপে সহায়হীন এর সম্বল

সন্তান তার দেখবে তবে আলোক-পুর

 

কে তুমি, অন্ধকার ঘরে উসকে বাতি

শরীর দিয়ে শান্ত কর ভীষণ রতির ,

ঘরেতে তার কালো অসুখের ছায়া

বিনিমরে সে ওষুধ কেনে রুগ্ন পতির।

 

সেই মাটিতেই নিজ মূর্তি করো স্থাপন

মা ই যখন ব্রহ্মময়ী দুর্গতি নাশিনী ,

কেমন করে নষ্ট হয় রক্ত মাংসের দুর্গা ?

সব মেয়ের ভিতর বসত করেন তিনি।

 

শিউলি সুবাস

ত্রিদিব রায়

 

উনিশের ডাগর তুমুল বৃষ্টিধারা

ভেঙে পড়েছে রস হীন পৃথিবীর বুকে

সিক্ত ও সরস ভূমি ফুলে ও ফসলে

ঝলমল করে উঠেছে। এই উচ্ছ্বাসে

হরষিত প্রকৃতি অরণ্য থেকে প্রান্তরে

 দ্বিধাহীন মেলে দিয়েছে নিজেকে।

রূপসী সবুজের বিপুল সমারোহ---

হাতছানি দিয়ে ডেকে বলছে, এসো সখা

আমরা রচনা করি  অন্য এক স্বর্গভূমি

অন্য এক হিংসা হীন গৃহী ধরাতল

যেখানে শুধুই প্রেম, শুধুই আনন্দ গান

সৃষ্টির উল্লাস আর মৃদুমন্দ অভিমান

আকাশে নির্ভার মেঘ মুক্তির ডানা

মাটিতে হলুদ শস্য মৃগনাভি শিউলি সুবাস

রোগ শোক গ্লানি হীন সাহচর্য সহবাস

পল্লবিত কুসুমিত নান্দনিক প্রেমের সুষমা।

                  

সামঝোতা

কৃপাণ মৈত্র

 

এ শুধু বেঁচে থাকা সামঝোতা পরস্পর

এ শুধু ছুঁয়ে থাকা জীবনের কিছু স্তর।

হিসেবটা মেলে না মেলানো সহজ নয়

কোথায় জমা কত, কোথায় শুধু অপচয়

এ শুধু বেঁচে থাকা সামঝোতা পরস্পর।

 

জোয়ারে কী গেল ভেসে ভাটার দুঃখভার

সবকূল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বিপুল পারাবার,

গতিময় জীবন ধাবমান মৃত্যুপানে সদা

জনারণ্যে দ্যুতিময় ছিল যে একদা

অন্ধকার স্তব্ধতার এক মহা বিষ্ময়

আলোর বিপরীতে শুধু তার ক্ষয়,

কে বা স্মরণে রাখে আছে কার অবসর,

এ শুধু বেঁচে থাকা সামঝোতা পরস্পর।

 

ফেরা

শামীম নওরোজ

 

একটি ষাড় তেড়ে আসছে আমার দিকে

 

খাতা থেকে মুছে যাচ্ছে সংখ্যার শরীর

ছাত্র পরাজিত, নাকি শিক্ষক

 

বিদ্যালয়কে গোয়ালঘর বলে মনে হচ্ছে

বিদ্যালয়ের মাঠে অগণিত ছাগল

 

সবাই লজ্জিত নয়

কেউ কেউ কপট লজ্জায় নুয়ে পড়ছে

সব মিথ্যা, ছল-চাতুরী

 

ষাড়টি ফিরে যাচ্ছে গেরস্তের বাড়িতে

 

আমিও লজ্জাহীন এক ষাড়

ফিরে যাচ্ছি মায়ের হেঁশেলে

 

ইচ্ছে ফানুস

বরণ বর্মণ

 

ইচ্ছে মতো ছিটাই আকাশ -মেঘ

অফিস থেকে স্বাস্থ্য কার্যালয়,

ইচ্ছে মতো দেওয়ালে রং ঢালি

দেখেই পুষি আমার দিক্বিেজয়।

 

ইচ্ছে টাকি এমনি এমনি জাগে ,

ভালো লাগে বলেই নাহি ছাড়ি;

লোনের সুদ পাবেই পাবে ছাড়,

বাড়ি বিল্ডিং প্রিন্টি তাড়াতাড়ি।

 

নবাব গঞ্জে মস্তোবড়ো সভা,

প্রমাদ গুনে নোংরা দৃশ্য দূষণ;

সামনে পর্দা অনেক উঁচুতে টাঙ্গা,

গন্ধ ঢাকা যায় কি বিলক্ষণ।

 

অশ্বমেদে ঘোড়ায় পড়ল টান,

জনস্বার্থে মামলা নোটিশ জারি;

জেব্রাক্রসিং যা রং আছে বহাল,

কেন পাল্টাতে হিসেব দেবে তার ই।

 

নড়ল টনক এবার ইচ্ছে ফানুস,

নিতেই‌ হবে সূচক বিন্দু গুটে

যেতেই পারো উচ্চ আদালতে;

যদি কোনো ঝিঙে ফুল ফুটে।

 

সৃষ্টির উৎসে

দীনেশ মন্ডল,

 

জীবনের অক্ষর বিন্যাসে তুমি লুব্ধক

বিচ্যুত প্রস্থর খন্ডে খোদিত প্রেম,

হারিয়ে যাওয়া অম্রকুঞ্জে, নদীর কলরবে

অম্বরের অগনিত প্রচ্ছন্ন ছায়ায়

ধাবিত হয় প্রতিপলকে ।

পদ্ম, পলাশ, লিলি, শালুক,

সবই দ্বিখন্ডিত স্তরিভুত শিলারুপ ।

পল্লবিত শাখাপ্রশাখায় আজ আমি ধ্যানমগ্ন,

শঙ্খচিল নয়, নয় দাদুরী ।

শুধু সহমরন, কুট কৌশলে আবদ্ধ,

ক্ষনজন্মার পদস্খলনের মতো মৃত্যু ।

দৃষ্টি গোচরে আবদ্ধ নও

চলমান অশরিরীর মতো বহমান . . . . . . ।

শুধুই অনন্ত প্রতিক্ষা ।

 

বিভ্রাট

সোমা ভট্টাচার্য্য

 

আশাপূর্ণা বড়োই ভাবুক স্বভাবের মধ্যবয়স্কা মহিলা, সরকারি চাকুরীরত, কিন্তু তার শুধুই চাকরি, সংসারে মন বসে না। যেহেতু আশাপূর্ণা দেবী একজন অন্যতম নামকরা সাহিত্যিক ছিলেন, সেই নামের সুবাদে তাঁর অনেক পৃষ্ঠপোষকতা, ভক্ত , অনুগামী অফিস থেকে ফেসবুক পাড়ায়, এমনকি ইনস্টাগ্রাম অবধি! তাঁর স্বামী আবার এইসব ফেসবুক পাড়াকে ফালতু পাড়া নাম দিয়ে, অনলাইন ফুড কলোনি যেমন Zomato,swiggy ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেন এবং তার ফলপ্রসু একটু স্থুল মানে এই আশি কেজি ছুঁই, ছুঁই। আশা আবার প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় ভুগছেন কারণ ফেসবুকে কোনো সময় বরের সঙ্গে ছবি না দিলে ভালো দেখায় না, স্ট্যাটাস মেনটেনের ফ্যআক্টর এগুলো, কিন্তু কে বোঝায়!! অবশ্য কিছু পৃষ্ঠপোষক যারা প্রতিনিয়ত সুপ্রভাত, শুভসন্ধ্যা ইত্যাদি ইত্যাদি পাঠিয়ে থাকেন,তাঁরা আবার একটু চটে যান.... কিন্তু কি করা যাবে,যেটা সিস্টেম সেটা তো মেনে নিতেই হবে। তাই সুযোগ পেলেই বরের সঙ্গে ছবি তুলে রাখেন যখন দুজনে একসাথে বেরোচ্ছেন,সেই সময় বরের অনেক অনেক বদ আচরণ বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়, কতটা কম্প্রোমাইস তিনি করেন তা একমাত্র জানে প্রিয় বান্ধবী মন্দাক্রান্তা। মন্দাক্রান্তার অবশ্য একজন গৃহবধূ একই সমস্যায় ভোগেন, তাঁর নামে এক কবি কতো সুন্দর কবিতা লিখে চলেছেন,আর এই মন্দাক্রান্তা ভেবে পান না বদ্ধ গৃহকোণে কিভাবে ফ্যাশান করা যায়,বরের যখন তখন রান্নার ফরমাশে বিরক্ত।এই তো সেদিন একটা শাড়ির হাফ করে,স্কার্টের সঙ্গে মিক্স ডিজাইনে তৈরি হচ্ছিলেন এমন সময় বেগুনী, চায়ের ফরমাশ কি ঠিক, আপনারাই ভেবে বলুন তো,এই রকম তবু নানা ধরনের পোশাকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।একই সমস্যায় ভুগছেন আশাপূর্ণা দেবী, যাইহোক এইভাবেই চলছিল,বয়স বাড়লেও গ্ল্যামার কিছু কম হয় নি, বরং নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বেড়েই চলেছে... কিন্তু হঠাৎ একদিন রাতে প্রচন্ড পিঠে, কোমরে ব্যাথা , আশাপূর্ণা দেবী ডাক্তার দেখালেন,ডাক্তারবাবু বেশ কিছু টেস্ট লিখে দেন, আশাপূর্ণা দেবী অগত্যা মেকআপ নিয়েই টেস্ট করাতে রান, বান্ধবীকে বলেন মনের জোর রাখতেই হবে তাই একটা সেল্ফি আপলোড করে টেস্ট করাতে যআচ্ছই, মন্দাক্রান্তা বলে একই অবস্থা নলিনীর,ওর আবার পেটের সমস্যায় বিদ্রোহী ব্যাপারটা কেমন কমে যাচ্ছে, কিন্তু নারী শক্তি আমরাই পারি অসুস্থতা করে জয় ফ্যাশন রকমারি...... কিন্তু যেদিন টেস্ট রিপোর্ট আনতে গেলেন সেদিন নিয়তিতে অন্য কিছু লেখা ছিল, রিপোর্ট দেখিয়ে ডাক্তার দেখালেন,ডাক্তারবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন আপনার মেরুদন্ডের ফ্লু্ইড শুকিয়ে যাচ্ছে,যার চিকিৎসা দূরহ.. ফিরে এসে নেট সার্ফিং করতে থাকলেন আশাপূর্ণা, একটা সময় মনে হলো ওনার আয়ু বোধহয় আর বছর দুই থেকে পাঁচ। বরকে রাতে সবরকম ভালো রান্না করে খাওয়ালেন অসুবিধা সহ্য করে, রাতে রিপোর্ট দেখাতে গিয়ে ও দেখালেন না, তার বদলে আশাপূর্ণা বরকে বললেন তোমার তে দুটো শার্ট তুমি খুঁজে পাচ্ছিলে না আসলে আমি লুকিয়ে একজনকে দান করেছি, কারণ ওই শার্ট পরলে তোমাকে আরো মোটা লাগে ছবিতে, তুমি রাগ করো না, এরকম আরো অনেক কথা আছে, আমি তোমাকে লিখে জানাবো, তুমি রাগ করবে না, এটা আমার কনফেশন বলতে পারো, একটু চোখ ছলছল জলে ভরে, আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না... কর্তা বুঝলেন কোথাও কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে, বললেন বেশি কনফেশন না শোনাই ভালো,কাল আমি ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে জানবো। সেদিন রাতে আশাপূর্ণা অনেক কনফেশন লিখে রাখলেন, তাঁর মনটা কেমন যেন উদাস হালকা,ভোর হয়ে এসেছে, অনেকদিন পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন কি সুন্দর প্রকৃতি, কি সুন্দর পৃথিবী, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস... সকালে অফিসে বেরোনোর সময় আশাপূর্ণা টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে দিলেন কর্তার হাতে,কর্তা বললেন গান শোনো মন ভালো থাকবে, আমার মনে হয় কোনো একটা ভুলভ্রান্তি হচ্ছে, আশাপূর্ণা বলেন আমায় সান্ত্বনা দিতে হবে না, আমি সব পরিস্থিতিতে প্রস্তুত। প্রায় ঘন্টাখানেক পর একটা ফোন,যে মেডিকেল ল্যাব থেকে পরীক্ষা করিয়ে ছিলেন সেখানে ভুল করে অন্য একজনের রিপোর্টে আশাপূর্ণা দেবীর নাম প্রিন্ট হয়েছে, ওনার সেরকম কোন সমস্যা নেই। আনন্দে মন ভরে ওঠে আশাপূর্ণার,উচ্ছ্বসিত হয়ে কর্তাকে ফোন করে জানাতে,কর্তা হেসে বলেন খুব ভালো, আরো যে কনফেশন লিখেছিলে কি করবে সেগুলো? আশাপূর্ণা লাজুক হেসে বলে এইতো রেডি হচ্ছি ডিলিট করার জন্য, তুমি কি করে বুঝলে আমি আরো লিখেছি? কর্তা হাসেন হা হা.. জানতে হয় বৈকি....

 

অভাব এক শূন্য গ্রহ

নীলোৎপল জানা

 

মানুষ হারানোর যন্ত্রণা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো—

দেখতে শান্ত, ভেতরে অস্থির ঘূর্ণি।

হৃদয়ের প্রতিটি ধ্বনি হয়ে ওঠে প্রতিধ্বনি,

যা শূন্য ঘরে বাজতে বাজতে কেবল

অসীম নিঃসঙ্গতার সুর তোলে।

 

অভাব হল এমন এক শূন্য গ্রহ,

যেখানে আলো নেই, বাতাস নেই,

তবু শ্বাস বন্ধ হয় না—

মানুষকে বাধ্য করে বেঁচে থাকতে।

কিন্তু সেই বেঁচে থাকা মৃত্যু-সম জীবন।

 

স্মৃতি যখন শিকল,

অশ্রু যখন অগ্নি,

ভাষা যখন নীরব—

তখন সবচেয়ে নির্মম বিচার।

মানুষ চলে যায়, কিন্তু অভাব থেকে যায়

মৃত্যুর চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে।

===========================

যাঁরা দেখছেন like  ,কমন্ট  ও ফলো করে দিন।এর পর যা  আপলোড করব দেখতে পাবেন।








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ