দুইপাতা ১০০তম সংখ্যা ২০২৫

 



নজরুল ,আমাদের নজরুল 
সৌমিত বসু

বেঁচে আছো তুমি একটি হারমোনিয়ামে
বেঁচে আছো তুমি শুদ্ধ কোমল ' নি ' তে
আত্মাকে কেটে গাছের উপরে তুলে
জল দেয় যারা ছিন্ন কঠিন শিখরে।
চিরদিন তুমি থুতু ছিটিয়েছো  তাদের
বাজপাখি আর তীক্ষ্ণ শকুন যাহারা
একটি দেশকে মুঠোয় কব্জা করে
শস্যশ্যামল করে তোলে ঘোর সাহারা।

বেঁচে আছো তুমি ফেজটুপি আর পানে
বেঁচে থাকো তুমি কথায় এবং গানে
কলমীলতারা হেসে ওঠে ঘোর কবিতায়
শ্যামাসংগীত নেমে আসে ভরা বরসায়।
বেঁচে আছো তুমি যাত্রা, লেটোর  দলে
বেঁচে আছো তুমি ভেঙ্গে ফেলা সংগ্রামে
ভৃগু হয়ে তুমি লাথি মারো তার বুকে
ছেলেকে কাঁদিয়ে মাকে দেয় ধুপধুনা।

বেঁচে আছো তুমি একটি হারমোনিয়ামে
বেঁচে থাকো তুমি ,কথায় এবং গানে।


নজরুল
গুরুপদ মুখোপাধ্যায় 

লাঙ্গলের ফলায় যে চাষ
বীজের চোখ মাটির গভীরে 
সাম্যের চারাগাছ ডালপালা মিলেছিল সেদিন... 

ক্রান্তিলগ্নের পথিক
ছায়াগুলো রেখে গেছ মাটির উপর 
জলে ধুয়ে যায় ঝিঙেফুল বাসর...

তুমি এক প্রলয়,মায়া!
মাটির শরীর জুড়ে অদৃশ্য কথন
শিকড়ের শরীরে তেত্রিশকোটি শ্বাস... 

এখন মলোমাস!
মেঘও নামেনা এখানে 
বিদ্রোহ ধূসর পান্ডুলিপির...

বাঙালি আজো ছুঁয়ে তোমার নিঃশ্বাস 
জলের সরে ভাসে কাশ
এই বালুকাবেলায় নবান্নের রোদ মাখে বসন্ত কোকিলা... 

কবি ঢাকাতে ঢাকা আজো তোমার  কফিন 
তুমি নও ছবি 
বাংলার ঘরে ঘরে তুমি আজো কবি...


জ্যৈষ্ঠের কবি 

রবীন বসু 


দুখু মিয়া কবি বাঁশি বাজান যিনি 

গানের সুরে শুধু মন মাতান তিনি।

লেটোর দলে ভিড়ে যাত্রাপালা করেন 

দুঃখী মনের কথা তিনিই শুধু বোঝেন!

সেনাদলে ঢুকে আরবি ফারসি শেখেন 

সাম্যবাদের কথা স্পষ্ট দৃপ্ত লেখেন।

কাঠবিড়ালি ছড়া খুকির জন্য লেখা 

আবৃত্তিতে সবার প্রথমে তা শেখা। 

ধূমকেতু এই কবি আগুন ভাষা বলেন 

গানের বুলবুল শেষে বাক্যহারা হলেন।

জ্যৈষ্ঠ মাস এলে মনে পড়ে তাঁকে 

সেলাম করে সবাই জন্মদিনে যাঁকে!


নজরুল: আগুনের পংক্তিমালা
পলাশ পোড়েল

নজরুল যেন বজ্রের নাচন, অন্ধকারে দীপ্তি ছড়ায়,
তাঁর ভাষা খরতাপে ঝলকে, বিদ্রোহের ছায়া গড়ায়।
কলম ছিল শানিত তরবারি, কাব্যে বাজে যুদ্ধ-সুর,
দগ্ধ বুকের যন্ত্রণাতে গাইতেন ছুঁয়ে থাকেন কবি নূর।
শব্দে যেন জাগে আগুন, উপমায় ছিল ঝড়ের তান,
ভাঙার মাঝে গড়ার আশায় ছুটেছেন মুক্তি জোয়ান।
তার কবিতায় চাঁদের হাসি, আবার বজ্রের তীব্রতা,
মানবতার বীণায় বাঁধেন, ভালোবাসার গভীরতা।
নজরুল, তুমি জাগার বীজ—শত হৃদয়ে তুমি ধ্বনি,
তোমার ছন্দে জাগে প্রাণে প্রেম ওঠে বিদ্যুৎ ঝলকানি।


নজরুল

মাথুর দাস


কাব্যে গানে সুরে ও তানে   একাই তিনি একশো,

লেটোর গানে জীবন আনে   প্রাণটি ভরে দ্যাখ্ শো ।


কষ্টে যে তাঁর জীবন ভরা   সৃষ্টি কত উজ্জ্বল !

উন্নত শির দৃপ্ত সাহস   বুকে নিয়ে খুঁজ্ বল ।


বিদ্রোহ প্রেম ভক্তিগীতি   শক্তিশালী লেখনী তাঁর,

মজার ছড়া ছোটদেরও   তোলে অন্তরে কী ঝঙ্কার !


সাম্যবাদের কাম্য সে পথ   তাঁর রচনায় পাই যে ঢের,

উঁচিয়ে মাথা বাঁচার গাথা   শোনায় কথা সংগ্রামের ।


সরব কবি নীরব হয়ে   কাটান জীবন শেষদিকে,

মরণ পরেও চির অমর   সৃষ্টি কি তাঁর হয় ফিকে ?


নজরুল 
নবীন মণ্ডল 

এলে ধূমকেতু হয়ে কোটি নক্ষত্রের মাঝে
মানবের পতি রূপে চির উজ্জ্বল সাম্য একতার সাজে।
লেখনীর দ্রোহে বিদ্রোহী হলে,
কেবলই মানবতা মনুষ্যত্ব বলে--
তত্ত্ব তাত্ত্বিক জ্ঞান দিলে চুলায়,
মানুষের মাঝে তোমারই প্রেম প্রীতির দোলায়
আজও প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক প্রতি লেখনী সমান
বারে বারে এসে যায় তোমার নৈকট্য মানান।
শ্রেষ্ঠ স্রষ্টার সৃষ্টি সব মানবতার গান
তুমিও তাই দিলে আকণ্ঠ পরিপূর্ণ দান।
    

দহন বেলার কবি
পুষ্প সাঁতরা

দহনের স্বরলিপিতে রামধনু ওঠে
অক্ষরে আগুন গান
বহতা নদীর সুরসুধা ভাসে
অসম্ভবের সুধা পান।
রাগ- সুরের দোলন- চাঁপা
ঐশী প্রেমের বাণী
রক্ত কলম ডুবিয়ে লেখেন
রাধা প্রেম উন্মাদিনী।
শোকের আঁচে দুর্ভাগ্যের স্তব
ছায়ানটের বিলাপ
নীলকন্ঠ হৃদয়ে ব্রহ্মকমল
দীপকের সংলাপ।
সৃষ্টির সৈকতে প্রেমের নির্যাস
বাঁশরীতে মন্দাকিনী
দহন বেলার কবি নজরুল
বহুমুখী সঞ্চারিনী।


কবি নজরুল স্মরণে
নন্দিতা পতি ভট্টাচার্য

আজ এই অস্থির সময়ের স্রোতে ,
তোমাকে স্মরণ করি হে বিদ্রোহী কবি ।
আজও প্রতি মুহূর্তে তোমারই নিবিড় সান্নিধ্য অনুভব করি ,
প্রতিক্ষণে প্রতি পলে -পলে তোমারি বাণীর দৃপ্ত পদসঞ্চার শুনি।

ওগো কবি ,শুনতে কি পাওনা আজও -
উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে ।
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিত হচ্ছে।

বিদ্রোহী রণক্লান্ত কবি ,জানি  আজও  তুমি হওনি শান্ত  -
আজও মানবতার অপমানে তোমার চোখ ফেটে আসে যদি জল,
তবে ফিরে এসো কবি, আমাদের মাঝে -
বিষের বাঁশী হাতে জন্ম নাও আর একবার ,
শোনাও আরেক নববোধনের গান বুলবুল হয়ে । 


'কারার ঐ লৌহ কপাট'
অমিত কাশ‍্যপ

সে এক বিকেল তখন, ঘন ঘোর করে আকাশ 
কালবৈশাখী
তখন হত, মাঠের বুক থেকে তাপ সরেনি
পাঠে যেতে সূর্যদেবের কিছু বাকি
আমরা চাদর বিছিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী করব
ভাঙা একটা চৌকি এল, এল মা-কাকিমা
মঞ্চসজ্জা যার যার মতো, কেমন একটা খবর 
যতীনস‍্যার পড়ন্তবেলায় সুরু করলেন রবীন্দ্রগান

অনির্বাণ, বাচ্চু হোঁচট খেতে খেতে ধরল
'কারার ঐ লৌহ কপাট 
ভেঙ্গে ফেল, কররে লোপাট 
রক্তজমাট...রক্তজমাট...' আর এগলো না 
হাততালি পড়ল, আকাশ নেমে এল কালো করে 


নজরুল 

প্রশান্তশেখর ভৌমিক

প্রেমের কবি মুক্তির কবি
নজরুল যার নাম 
এই বাংলায় জন্ম তাহার
চুরুলিয়া সেই ধাম। 

খ্যাতির শীর্ষে থেকেও তিনি
অবিচল থেকে যান 
প্রতিবেশী দেশ দিয়েছিল তাকে
জাতীয় কবির মান।

সুশীল সমাজ শাসকের তালে
মস্তক দেয় বেচে 
নজরুল কখনো বিবেক বিসর্জন
দেয়নি কোথাও যেচে।।


কবিতা আমার নজরুল
সুমিতা মুখোপাধ্যায়

ধূপ পোড়ে অগ্নিশিখাও...তবু
তুমি ধূপের মত নীরব প্রলয় শিখা -
তুমি সাম্যবাদীর গান,
তুমি প্রদীপ শিখার মত কল্লোহ দহন,
তুমি বিদ্রোহী , তুমি মুক্ত আকাশে এক উজ্জল ঢেউ!
আনন্দে অনাবিল তুমি অগ্নীবীণায় বেজে  ওঠা
সন্ধ্যার তারার ফুল.
ঘাসের অনুপম অবিন্যস্ত পথে 
খাঁচার আবদ্ধতা নয়,
তুমি চঞ্চল হৃদয় শান্তির
আবহমান চলার ছন্দ।
অরন্যকান্তিময় অনন্ত সবুজ মাঠে তোমার বাণী রণতরিতে ফিরে এসো আর ও একবার
 আমার কবি নজরুল।।



তাঁর ভাগ হয় না
দেবাশীষ ঘোড়‌ই 

ভাগ হয়ে যায় দেশ নদী জল,
ভাগ হয়ে যায় করিডোর দুই কুল… 
তবুও ভাগ করা যায় না তো নজরুল। 

বয়ে চলে রক্তের চোরা স্রোত… 
হিংসাদীর্ণ কাঁটাতার ছিঁড়ে খায় বুক; 
রক্তগঙ্গা ভাগীরথী হয়ে বয়ে চলে কুল কুল, 
তখনো শান্তির প্যাগোডায় খুঁজি নজরুল। 

তার কথা নিয়ে করি মশকরা,
একই বৃন্তে দুইটি কুসুম___
ঈর্ষায় সিলেবাস করি ভন্ডুল, 
তবুও রক্তের স্রোতে থেকে যায় নজরুল।

মেঘ দিয়ে ঢাকা যায় না সূর্য 
যুগে যুগে সে যে সত্যি নির্ভুল___
তাই হৃদয়ে আজও চির ভাস্বর রবি… 
চেতনায় নজরুল। 


সুরের বুলবুল
আসগার আলি মণ্ডল 


চুরুলিয়ার পাহাড় চূড়ার
গুলবাগিচার ফুল
কর্ম গুণে মানব মনে
রয়েছেন বিলকুল।

জ‍োষ্টি মাসের প্রখর তাপের
তিনিই ঝিঁয়াফুল
ব্রিটিশ রাজের ত্রস্ত-ত্রাস
কবি কাজী নজরুল।

শোষণ-শাষণ অত‍্যাচারের
লৌহ কপাট-শিকল
বিদ্রোহেরই মন্ত্রবলে
দিলেন করে বিকল।

নজরুল
তারকনাথ সাহা

গুলবাগিচার বুলবুলি তার
আজও গায় বেদগান,
অবোধ মানুষ ভেদ করে আজও
আল্লা ভগবান।

দুখু-মিঁয়া ভগ্ন হৃদয়ে
কাঁদে সদা বসে স্বর্গে,
এ পোড়া দেশ অবহেলায়
সাম্যে পাঠায় মর্গে।

বিষের বাঁশী বাজায় আজিকে
কাল ভৈরবী সুর,
নজরুল দেখা স্বপ্নগুলো
ভেঙে করি চুর-চুর।

কলকাতা তথা ঢাকার মাঝে
ঘটে চলে শত ভুল,
চক্ষুর জলে বক্ষ ভেজান
মানুষের নজরুল।


কোনো দিন জন্ম হয়নি
শান্তনু প্রধান


আমি কোনো দিন জন্মায়নি
তাই ভূত এবং ভগবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছেনা।


হাঁটতে হাঁটতে বিকেল তারপর রাত্রি নেমে এলো ঘন চুলে
স্তব্ধ পাতার ফাঁকে দু'চারটে জোনাকি লিখে ফেলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।
বর্ষার ভোর তখনও ঢোকেনি রাজশাহি নতুবা ঢাকায় 
ধানক্ষেতে চিরে উঠে আসছে অন্ধ মিছিলের স্লোগান।
মানুষ কি জানে না, বজ্রপাত মানে বজ্রপাত ইঁদুররা পছন্দ করুক নাই বা করুক 
হে কবি, শাসন থেকে মুক্তির পথ কি তবে স্বাধীনতা? 
এইতো সুযোগ  আপনি এবার লিখে ফেলুন এপিটাফ। 

এই নকশাকাটা দৃশ্য ভূত নাকি ভগবানের কারুকৃতি? 
রাতের অন্ধকারে পায়ে পায়ে বেজে উঠছে মৃত মানুষদের স্বগতোক্তি ‌
এক মুঠো আলো হারালো যারা অন্যেরা কি পেল সেই আলো নাকি
এইমুহূর্তে একটি গোটা দেশ জুড়ে ফুটে উঠলো নষ্টচাঁদ!

কোনদিন জন্ম হয়নি আমার। কারা তবে জন্মালো?
বর্ণপরিচয় থেকে ঘাসের বীজ খুঁটে নিয়ে
বজ্রপাতের মাঠে ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে যাচ্ছি 
দেখা যাক এবার যদি কোনদিন সত্যি সত্যি আমাদের জন্ম হয়। 

আমরাতো এখন কেবল মাত্র ছাত্র, কেউ দেখিনি একাত্তর ।
রক্তে জেগেছে -
'কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী '

পরস্পর চিরকাল  ফাটল বেড়ে যায়।



হৃদয় জুড়ে  
মালা ঘোষ মিত্র

উদাসী মনে বাঁশির সুর
জীবন জুড়ে শুধুই অস্থিরতা,
বিদ্রোহ আর শিকল ভাঙার গান,
দীপ্ত সূর্যের অগ্নিবীণায়
মুক্তির দিশারী জাগে-----
তোমার খুকু আজ অনেক বড়ো
সংসারের বাঁধন তাকে বাঁধতে পারে।
হৃদয় আকাশে তোলপাড়----
লক্ষ্মী আজ ধূলো বসে
বাণের জলে ভেসে যায়
জন্ম মৃত্যুকে উপেক্ষা করে।
এতো রঙ, এতো মুখোশ----
শুধুই চেয়ে থাকা  নীরব কন্ঠস্বর---
বাঙালির প্রাণের কবি নজরুল ইসলাম
রইল শতকোটি প্রণাম।।


অগ্নিবীনার আশ্বাস 
পবিত্রকুমার ভক্তা 

তোমার স্পর্ধা আকাশ ধর্মনিরপেক্ষতায়
মুক্তির গান বিদ্রোহী সত্ত্বায়, হৃদয়ে জাগে আশা। 
আমার আমি, সাহস সঞ্চারী হয়ে অসহায়তাকে 
তোমার চরণে সঁপে দিয়ে দাবানল হয়ে ওঠে 

সব বাধা বিপত্তি ওস্তাদহীন হয়ে বিশৃঙ্খল
শক্তি তোমার বাণী, বিশ্বাসে জোর, যেন রেজিমেন্ট 
তুমি জ্বলন্ত আগুন, আমি নিজে আবেগে, 
এখনও তোমাকে অনুসরণ করি, বাঁধনহারা

বিশ্ব গভীর বিপদে পড়ে, ধুমকেতু খুঁজে ফেরে  
সেই হৃদয়ে জাগে অগ্নিবীণার আশ্বাস 
ব্যথার দান বাজে অবিরাম,  ভাঙ্গে পাড়
আমাদের আজ, সৃষ্টি সুখের উল্লাস। 



কাজী প্রণাম
সৌগত কান্ডার


তুমি যুদ্ধ , তুমি শান্তি।
তুমি প্রেম, তুমি বিরহ।
তুমি দ্রোহ, তুমি কাব্য।
তুমি বারুদ , তুমি গোলাপ।
তুমি টংকার,তুমি সঙ্গীত।
তুমি অন্তর, তুমি প্রান্তর।
তুমি দুর্দম, তুমি মেদুর।
তুমি পূর্ব, তুমি পশ্চিম।

তবু এই সব কিছু নয়,
তোমার আসল পরিচয় 
জানে ঝিঙে ফুল।
আর জানে বাঁশিখান,
এই মাটির সন্তান 
তুমি কাজী নজরুল।


আমার হৃদয়ে নজরুল
সুদেষ্ণা গারু ( সুমি )

জাগো রে হৃদয়, শুনি তাহার ধ্বনি,
নজরুল নামটি বহে বিজয়গাথা ধ্বনি।
বাঁধনছেঁড়া বাণী তার, অগ্নিবীণার রাগে,
চেতনাহীন স্বপ্ন জাগে নব আলোয় জাগে।

ধূপ-ধুনো মন্দিরে, আযানে মসজিদ,
তব কণ্ঠে শোনা যায় মানবতার গীত।
ভ্রাতৃত্বের ভাষ্যে তুমি চিরঋণী কবি,
অভিমানী আত্মা তব ব্যথাতুর স্বরলিপি।

সুরে সুরে বলেছো, শোষণের অবসান,
দুখিনী জননীর মুখে ফেরাও সম্মান।
বিদ্রোহে, প্রেমে, দানে তুমি চিরজ্যোতি-ধারা,
নজরুল, তুমি আমার হৃদয়ের অমর তারা।


কে বলে- তুমি দুঃখু মিঞা
শঙ্কর সামন্ত


কে বলে- তুমি দুঃখ সাগরের দুঃখু মিঞা 
তুমি তো চুরুলিয়ার দুঃখ মিঞা নও, 
তুমি তো সারা বিশ্বের নজরুল।

কে বলে-তুমি নজরুল, তুমি তো প্রতিকদী নজরুল
তোমার রক্তে কনায় কনায় প্রতিবাদ, 
কলমে প্রতিবাদ, মননে প্রতিবাদ, গানে প্রতিবাদ,
মজ্জায় প্রতিবাদের সুর।

কে বলে -"শিকল পরাচ্ছল" তুমি তো ভয় ভাঙ্গিয়ে
বলেছিলে-"ও শিকল করব মোরা বিকল।"

কে বলে - তুমি মুসলমান, তুমি তো জাতি-ধর্মের উর্দ্ধে মহাপ্রাণ, 
তুমি তো গেঁথে ছিলে মালা - "একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান"।
কুসংস্কার, অসাম্য, দমন-পীড়ন, জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে তোমার কলম, তুমি নির্ভীক,
মাভৈঃ মন্ত্রে - বলহীনের বল,

কে বলে- তুমি নজরুল, তুমি মুক্তি পথের দিশারী,
গজলে, সাহিত্যে, অগ্নিঝরা ডালি নিয়ে
অগ্নিবীনার সুর সর্বত্রই, তুমি অক্ষয়, তুমি অব্যয়, তুমি অমর,
তুমি শিশু ণও-অগ্নি, তুমি বজ্র, 
তুমি বন্ধন হীন আকাশজয়ী বলাকা।


হৃদয়ে নজরুল
রাজীব ঘাঁটী 


আমাদের ছিলো দুখু মিঞা
এক বড় সাহিত্যিক 
প্রতিভা তাঁর বহুমুখী আর
মানবতায় নৈতিক।

শিখেছি তাঁকে বারবার পড়ে
সম্প্রীতির  পাঠ যত
প্রতিবাদী ছিলো কলম সতত
তিনি ঠিক তাঁর মত।

চুরুলিয়া থেকে ঢাকার পথে
শুনি তাঁর জয়গান
উঁচু করে রেখেছেন বাঙালিকে
নিজ বলে বলীয়ান। 

খুকু মণি ডাকে লিচুচোরকে
আজকে সকাল বেলা
নজরুল সুরে গাই গান আর
নজরুল কথা বলা। 

কাণ্ডারী কবি
বনশ্রী রায় দাস 


গোলাপের মায়া জড়ানো 
একই বৃন্তে নতজানু ,একরোখা 
একই গন্তব্য শুধু পথটাই ভিন্ন 

দুধসাদা জ্যোৎস্নায় গলে যায় 
মৈত্রী সুরের পুতুল 
অক্লান্ত জলে পরিণাম রেখে 
কাণ্ডারী কবি তুমি দেখলে 
আলোর নাচন 

কালো মেয়ের পায়ের তলায়


বিদ্রোহী অগ্নিশীলা

মৌ মধুবন্তী 


আগুন জ্বলেছে  তোমার কবিতা গানে 

শোষকের বাঁধন করেছে ছিন্ন, তোমার আহবানে! 

সত্যের জন্য তুলেছ  বজ্র ধ্বনি, 

            ধরার বুকে পাতিয়া বুক  অমনি। 

বুকের ভিতর জাগিয়েছিলে বিদ্রোহের ঢেউ, 

বাঁধন ছিঁড়ে চলার জন্য লিখেছিলে, 

                                                  মানোনি কাওকেউ ! 

বাংলার মাঠে বাজিয়েছিলে উচ্চকিত গানের সুর, 

বিদ্রোহ তুমি, সাম্য তুমি, 

মানবতায় তুমি প্রেমের নূপুর। 

দুঃখ-জয়ের মহা বারতা, জাগাতে চেয়েছিলে তুমি মানবতা। 

নজরুল তুমি সবার কবি, জাগরিত এক অগ্নি-ছবি!


বিদ্রোহী কবি বীর

বিধানেন্দু পুরকাইত


ভারতের বুকে ধর্মের গেরো

বিঁধে গেছে জম্পেশ

কোন ধর্মই ভাবতে পারে না

এটাই আমার দেশ। 


যবন নাকি কাফের

কে যে কোন দলে থাকে

দু'জন মারছে দু'জনকেই

যে যখন পায় যাকে। 


হা-হুতাশ আজ বিদ্ধ করছে

মানবিকতার শির

তুমি ছাড়া তাই ভারতবর্ষ

হয়ে ওঠে অস্থির। 


প্রেম নেই কোন প্রেমের ভণিতা

সন্দেহ ছায় দেশ

ফিরে এসো তুমি প্রেমের কবি

দাও কিছু সন্দেশ। 


অষ্টপ্রহর জংলি মানুষে

মানবচেতন অস্থির

তোমার জন্যে দিন গুণি প্রিয়

বিদ্রোহী কবি বীর। 


মানুষের কবি নজরুল।
দুর্গাদাস মিদ্যা

মানুষের কবি নজরুল গেয়েছেন সাম্যের গান 
প্রেমের স্রোতেও ভাসিয়েছেন জীবনের তরীখান
তাঁর কাছে মানুষ বড় আল্লাহ ঈশ্বর বড় নয়
সে ভাবনার ভাবে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়।
বিদ্রোহী বলে তাঁকে জানি আমরা তিনি শুধু বিদ্রোহী নন
অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা সচেতন
তিনি চির প্রণম্য তিনি বাংলার বুলবুল 
দুখু মিঞা তিনি তিনি আমাদের প্রিয়  কবি নজরুল।

দুখু মিঁয়া

মহুয়া ব্যানার্জী

পৃথিবীর বুকে ধুমকেতু তুমি বাঙালির জনজাগরণ,

তোমাকে নিয়েই দুখু মিঁয়া, কেটে গেল

এ অকিঞ্চিৎকর জীবন।

তুমি না জন্মালে জানা হত না

বিদ্রোহের প্রকৃত পরিচয়,

তুমি না বোঝালে বোঝা হত না

সাম্যবাদ খায় না মাথায় দেয়।

শ্যামা মা যে তোমার আপন মা

তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল না জানো!

তোমার অগ্নিবীণার সুরে জনগণ মন অধিনায়িকা ভারত মায়ের চোখের জল মুছে যেত।

অথচ আজ এই অন্ধকার সময়ে দেখো

তোমাকেও কেমন কালিমালিপ্ত করছে শেয়ালেরা-

যদিও তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না।

কারণ আমাদের চেতনার নাম নজরুল ইসলাম।


মৃত মানুষের নিস্তব্ধতা

গোবিন্দ বারিক


মৃত মানুষের  মতো পড়ে আছে টুকরো টাকরা অপরাহ্ন। গোপনে ছড়ানো সাদা ফুল ঢেউ উঠে প্রাণের স্পন্দনে। নিরস্ত্র বিকেল প্রতিটি প্রাণ বুলেট অক্ষরে  জ্বলছে রাঙা জবার মত উঠোনে রক্তের লালসা। এভাবেই পথহারা মানুষের উদভ্রান্ত জ্যোতির্ময়...

সর্বহারার মতো একপলক বাতাস বাইছে নজরুল।

পড়শী ভেবেই বুকে টেনে নিয়েছি তোমাকে। তোমাকে দিয়েছি সংযম সংহতি ধর্মনিরপেক্ষতা। তুমি বোঝনি এই নীল আকাশের বুকে লেগে আছে শান্তি। থরে থরে সাজানো পাহাড়ের বুকে  ঝরে পড়ছে নিরালা নিস্তব্ধতা, আনন্দ প্রকৃতি। আমি তো প্রকৃতিকে নিয়ে সংহতির পর্বত তাক করে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছি আমার ভূমি। তবে কেন হত্যা লীলায় রাধা হয়েছে পাথর, উত্তরের আগুন- সিঁদুর ।

মাটি, মাটি মানেই মা। অন্তরের বিনয় রাগিনী, দাও বাঁচতে আকাশের মত তারাদের মত আমাদের মত। দাও অন্ন , রুটি দাও, দাও ফিরে মানুষের প্রাণ।

প্রাণের বিনিময় কি যুদ্ধ নাকি ধূলোর শস্যক্ষেত ? 


অণুগদ্য

নজরুল: কবিতা, গান ও হৃদয়ের স্পন্দন

শংকরপ্রসাদ গুড়িয়া


২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সাল, আমি তখন এক স্কুলছাত্র। সেই দিনটির কথা আজও মনে পড়ে—রেডিওতে ভেসে এল একটি সংবাদ, যা আমার কিশোর হৃদয়ে শোকের ছায়া ফেলেছিল। বলা হলো, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর নেই। ঢাকায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হল বটে, কিন্তু তাঁর কবিতা, গান, এবং বিদ্রোহী আত্মা চিরকালীন হয়ে রইল আমার মনে।

নজরুলের অনেক কবিতা আমার প্রিয়, বিশেষ করে—" বিদ্রোহী:বল বীর বল, উন্নত মম শির" কিংবা "ফরিয়াদ"—যেখানে তিনি দুর্বলের পক্ষে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। তাঁর ভাষা আগুনের মতো, কিন্তু সেই আগুনে রয়েছে প্রেমেরও উষ্ণতা। নজরুল গীতিও আমার অন্তরের গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। "তুমি আমার সকাল বেলার ফুল", "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে", "নয়ন ভরা জল গো আমার"—এই গানের পংক্তিগুলি আমার শৈশব-কৈশোরের আবেগ জাগিয়ে তোলে।

একসময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের থেকেও নজরুল গীতি ছিল বেশি জনপ্রিয়। আজ সে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। দুঃখজনকভাবে পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের রচনাবলীর সংরক্ষণে তেমন কোনো একাডেমিক উদ্যোগ দেখা যায় না। বাংলাদেশে কিছু উদ্যোগ হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রায়ই বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

নজরুল এমন এক কবি যিনি ধর্মের বিভাজনকে অতিক্রম করে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি শুধু বিদ্রোহী নন, তিনি প্রেমিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, এবং সর্বোপরি এক মানবতাবাদী। আজও আমার হৃদয়ে নজরুল তাজা, প্রাসঙ্গিক এবং অমর



আমার দৃষ্টিতে কাজী নজরুল

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

 

আমি তখন ছোট, খুবই ছোট। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। নিজের দাদা, পাড়ার দাদারা এ সময় নাটক করত। আমি অনেক দাদারই নাটকের রোল খাতায় তুলে দিতাম। একদিন একটি নাটকের রোল তুলতে গিয়ে এক চরিত্রের সংলাপে পেলাম এই লাইন কটি – “মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হব শান্ত,/ যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দণরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ ভীম রণভূমে রনিবে না/ বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হব শান্ত”। কেন জানিনা এই লাইন কটি সেই অল্পবয়সেই আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। আগ্রহভরে মুখস্থও করে ফেললাম। আর যখন তখন আওড়াতাম। পরে বড়ো হয়ে জানলাম এটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতার অংশবিশেষ।

   স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল। একটি কবিতা একটা জাতিকে কিভাবে মুহূর্তের মধ্যে বীর্যবান করে তুলতে পারে, দেশের মরাগাঙে প্রাণের জোয়ার আনতে পারে, জীবনকে নতুন করে চেনাতে পারে, শোষণমুক্ত একটি সমাজের সুখস্বপ্ন দেখাতে পারে বিদ্রোহী কবিতা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।

   কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে কবির যে রূপটি আমাকে উদ্বোধিত, উদ্বেলিত করেছিল এবং এখনো করে তা হল কবির বিদ্রোহাত্মক মেজাজ। কবি স্বভাবগুনেই একজন প্রতিবাদী বিদ্রোহী কবি ছিলেন। তাঁর প্রতিবাদ ছিল অন্ধসংস্কার-কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ছিল ধর্মব্যবসায়ী ও মৌলবাদী পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যেখানেই শাসন-শোষণ-ত্রাসন লক্ষ্য করেছেন সেখানেই কবির লেখনী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তাঁর লেখন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলীয়ান করে তোলে, জাতপাতের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির বাইরে মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে শেখায়, শোষণমুক্তির সংগ্রামে প্রেরণা পাওয়া যায়। বাইশ বছরের সাহিত্যজীবনে তিনি শুধু গান-কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি, তাকে তিনি জীবনযুদ্ধের শাণিত হাতিয়ার করেছেন।

   “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত্‍ খেলছে জুয়া”, “কারার ওই লৌহকপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট,” “রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা”, “ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান”, কিংবা “মসজিদ এই মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়”, কিংবা “গাহি সাম্যের গান”- এগুলি  নিছক কথার কথা নয়, অনাচারকীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে বদলে দেবার এক একটি আগুন ভাষা। যতদিন পৃথিবীতে হানাহানি-রেষারেষি থাকবে, শাসন-শোষণ-ত্রাসন-অত্যাচার থাকবে, অন্ধ-বিশ্বাস, কু-সংস্কার থাকবে- ততদিনই থাকবে কাজী নজরুল ইসলামের এই সব কালজয়ী কবিতার আবেদন।



মননে নজরুল 

কবিতা সামন্ত


কাজী নজরুল ইসলামের নামটা মনে আসলেই প্রথমেই পুরো শরীরের লোমকূপ খাড়া হয়ে যায়।

ছোট থেকেই নজরুলের ছড়া কবিতা পড়ে বড় হয়ে ওঠা। তখন এতোটাও বোধগম্য হয়নি কবি নজরুল ইসলাম একজন সৈনিক দেশ প্রেমিক সেই সঙ্গে অসংখ্য ভক্তি গীতি রচনা করেছেন।

ভাবতাম এমনিই কিছু গান যা ছোটদের নাচের জন‍্য রচনা করেছিলেন।

এমনিতেই ছোট থেকেই ছবি আঁকতে ভীষণ ভালো লাগে তাই নজরুল ইসলামের ছবি আঁকতাম, স্কুলে নজরুল জয়ন্তীতে ছবি এঁকেছি কিংবা কর্মশিক্ষার পাতায় যখন সবাই কেনা ছবি লাগিয়ে যেত তখন আমি হাতে এঁকে নিয়ে যেতাম।

এমনও গেছে স্কুলের স‍্যার বলেছেন এটা তুই এঁকেছিস নাকি অন‍্য কেউ এঁকে দিয়েছে?

তারপর যখন নজরুলের আরও কবিতা পড়তে থাকলাম মনে মনে ভাবতাম সত্যিই এত কষ্টের জীবন কারো হয়!

ধীরে ধীরে দুখু মিঞার জীবনী পড়ার আগ্রহ জাগে মনে। কিন্তু কিভাবে পড়া যায়!

বাংলা আমার সব থেকে প্রিয় বিষয় ছিল।

তাই নজরুলের যত কবিতা পড়তাম কিংবা তার সম্বন্ধে লেখা পড়তাম বা শুনতাম কেমন যেন চোখের সামনে সবটা ভেসে উঠত।

ছোটবেলায় এফ এম রেডিও শোনার খুব ঝোঁক ছিল।

যেকোন মানুষের কাহিনী আমার যেন নেশা হয়ে গিয়েছিল।

একদিন নজরুল সম্বন্ধে শুনতে পেলাম।

যার জীবনটা এত কষ্টের যার সংসারজীবন সন্তানের মৃত শরীর ফেলে রেখে বুকে পাথর চাপা দিয়ে কবিতা গান রচনা করতে হয় তাকে জানা কি এতটাই সহজ!

প্রশ্ন করতে করতে "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে..."

গানটা বারং বার শুনে বুঝলাম কেন তিনি এই গান রচনা করেছেন!

কেন একজন বিদ্রোহী কবি গীতিকারের মধ্যে এতটা পরিবর্তন এলো!

এতো  লাঞ্ছনা এতো অপমান সত্যিই কি তার প্রাপ‍্য ছিলো!

ভারতবর্ষের মাটি কামড়ে এতো বিপ্লবের জোয়ার বয়ে নিয়ে আসা,মানুষে মানুষে সাম‍্যের ঐক্যবদ্ধের জন‍্য এতো লড়াইয়ের পরও কেন তিনি কলমের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও বোবায় পরিণত করেফেললেন তা বোধহয় আমাদের বোধগম্যে বাইরে। 

হৃদয়ে নজরুল,মননে নজরুল,শ্রদ্ধায় নজরুল থাক চিরতরে।


অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে!

নীলোৎপল জানা


            শুকনো খটখটে, এবড়োথেবড়ো, উঁচুনিচু, ঢেউখেলানো ভূমি। শুকনো রুক্ষ মাটি রোদে পুড়ে খাঁখাঁ করছে। কৃষির জমির সামান্য মাটিটুকুও পাথর, কাঁকর আর বালির মিশেলে কালচে হয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ ধু-ধু মাঠে ঝাঁকড়া মাথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু তালগাছ। একটা মাত্র নদী নাম ‘অজয়’ মৃতপ্রায় অবস্থায় বেঁচে আছে। গ্রীষ্মের সময় জল শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। শুকনো মরসুমে নদীর উপর দিয়ে চলে ঘোড়ার গাড়ি। বর্ষার প্রারম্ভে এই নদীই দুকূল ছাপিয়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। এদিকে ওদিকে ছোট বড় পাহাড় জঙ্গল থাকলেও কয়লা খনির দূষিত বাতাসে চারিদিক বিষণ্ন হয়ে থাকে সব সময়। এই স্থানের নামই চুরুলিয়া, যা বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমায় অবস্থিত। প্রকৃতির এই বিরুদ্ধ পরিবেশের ছোঁয়ায় মানুষের চালচলন, মেজাজ-মর্জিও প্রকৃতির মতোই রুক্ষ কর্কশ হয়ে যায়।

        এই বিরুদ্ধ পরিবেশেই ১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে, বাংলা সন ১৩০৬, তারিখ ১১ই জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার কাজী ফকির আহমদের ষষ্ঠ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। নবজাতকের সন্তানের নাম রাখা হয় কাজী নজরুল ইসলাম। মুঘল সম্রাট শাহ আলম-এর শাসনকালে বিহারের রাজধানী পাটনার হাজিপুর থেকে নজরুল পরিবার চুরুলিয়ায় আবাস গড়ে চলে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সম্রাটের আদেশে স্থানীয়ভাবে আদালত স্থাপন করা হয়। সম্রাটের প্রতিনিধি সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না। নতুন আসা পরিবারের একজন সদস্য সমস্যার সুন্দর সমাধান করে দেন। দুপক্ষই তাঁর রায় মেনে নিলে সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে কাজী উপাধিতে ভূষিত করা হলো। সম্রাটের দরবার হতে দান হিসেবে দেওয়া হয় বেশকিছু জায়গাজমি। তখন থেকে পরিবারটির উপাধি হয়ে যায় কাজী পরিবার। এই পরিবারেরই সদস্য ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

        নজরুলের বাড়ির পাশে ছিল নরোত্তম রাজার গড়। গড়ের উলটো দিকে হাজী পালোয়ানের পুকুর। পুকুরপাড়ে ছিল হাজী পালোয়ানের মাজার। মাজারের পাশে ছিল একটি মসজিদ। বাল্যকালে নজরুল এই মসজিদে আজান দেওয়া, নামাজ পড়ানো ছাড়াও ছোটদের হাদিস পড়াতেন। এখান থেকেই তিনি কোরআন-হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। চাচা বজলে করিমের কাছ থেকে ফারসি ভাষা এবং কবিতার পাঠ নিয়ে আরবি ফার্সির সমন্বয়ে একদিন নজরুল লিখে ফেলেন একটি পদ্য। এটাই নজরুলের হাতে লেখা প্রথম কবিতা।

মেরা দিল বেতার কিয়া তেরে আক্রয়ে কামান;

জ্বলা যাতা হ্যায় ইশক মে জান পেরেশান।’

এরপর অসংখ্য পালাগান ও নাটক রচনা করেন। লেটো গানের দলে তাঁকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। কিন্তু নজরুল বাল্যকাল থেকেই ছিলেন বাঁধনহারা। একদিন দলের ধরাবাঁধা নিয়মকানুন ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, দল ছেড়ে যাত্রা করেন অজানার পথে। হাজির হন আসানসোলে। নজরুল হয়ে উঠেছিলেন আসানসোলের বেকারি বয়। রুটির দোকানের পাঁচ টাকা মাইনের ভৃত্য হয়ে কাটালেন কিছুদিন। সেখান থেকে ময়মনসিংহ দরিরামপুর গ্রাম। ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে ছুটে গেলেন করাচিতে। নজরুলের জীবনই যেন একজন বাউন্ডুলে যাযাবরের আত্মকাহিনি।

        তাঁর জীবনের বাঁধনহারা উল্লাসের রূপক হয়ে বারবার আবির্ভূত হয়েছেন আরবের বেদুইন, ভবঘুরে আর বাউন্ডুলেরা। আর তাই তো চেঙ্গিস, কালাপাহাড়, গজনী মামুদরা বারবার উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে। এই স্কুলেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে। নজরুল, শৈলেন আর শৈলজা মুসলমান, ক্রিশ্চান আর ব্রাহ্মণ এই তিনজনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় সমপর্ক। জ্ঞান অর্জনের পথে ভাষা কখনো তাঁর কাছে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি।

নজরুল কারো দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। মৌনি ফকিরের মৃত্যুতে ব্যথাতুর কবি সেদিনই (১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসের এক রাতে) একটি কবিতা লেখেন। কবিতার নাম ‘ক্ষমা’। ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য’ পত্রিকায় ১৩২৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় (১৯১৯ সালের জুলাই-আগস্ট) ‘ক্ষমা’ কবিতাটিই ‘মুক্তি’ নামে প্রকাশিত হয়। মুক্তি নজরুলের প্রকাশিত প্রথম কবিতা। ১৯১৭ সাল, নজরুল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। মেট্রিক পরীক্ষার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে চুরুলিয়াকে বিদায় জানিয়ে যোগ দেন বেঙ্গল রেজিমেন্টে। লাহোর থেকে পেশোয়ার, পেশোয়ার থেকে করাচি নৈশেরা শুরু হয় সৈনিকজীবন। সেনানিবাসে থাকাকালীন তিনি দ্রুতই হাবিলদার পদে উপনীত হন।

         ১৯২০ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল কলকাতায় ফিরে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে আসেন। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সহকারী সম্পাদক মুজফফর আহমেদের সঙ্গে ছিল নজরুলের প্রগাঢ় সমপর্ক। ১৯২০ সালের ১২ই জুলাই দুজনে একসঙ্গে ‘নবযুগ’ নামের সান্ধ্য পত্রিকা বের করেন। নজরুল বারবার প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু কুমিল্লার পল্লিবালা নার্গিসের প্রেমের বারিধারায় সিক্ত হয়েছিল তাঁর মনপ্রাণ। নার্গিসের সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলে বেদনার আগুনে দগ্ধ হয়ে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিবীণা । কুমিল্লা থেকে ফিরে নজরুল কলকাতায় এসে মুজফফর আহমেদের ৩/৪-সি তালতলা লেনের বাসায় ওঠেন। এই বাড়িতেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে কবি রচনা করেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’।

১৯২২ সালে তাঁর প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকায় আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা প্রকাশের কারণে রাজদ্রোহিতার অপরাধ এনে নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যন্ত্রণার নীল হয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি হিসেবে কবিতা লেখার জন্য কারাদণ্ড স্বীকার করে নেন। কারারুদ্ধ অবস্থায় বন্দীদের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদে তিনি অনশন করেন। তাঁকে নাকে নল ঢুকিয়ে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলো। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কবি বদ্ধ ঘরে উচ্চারণ করেন ‘কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’—অর্ফিয়াসের মতো তাঁর হিরন্ময় সুরে চারপাশে সাড়া পড়ে যায়। চিরবিদ্রোহী নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অর্ফিয়াস। তাঁর উদয়ে থেমে গিয়েছিল বাংলা কবিতার চিরন্তন ভাষা। ছন্দের অক্ষরে সূচিত হয়েছিল বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ। নতুন জোয়ার উঠল বাংলা সাহিত্যে।পালবদল ঘটলো চির চেনা পথের।

তথ্যসূত্র-

পত্রপত্রিকা ও গুগল





==============================================


like ও কমেন্ট করতে ভুলবেন না







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ