রবীন বসু
দুখু মিয়া কবি বাঁশি বাজান যিনি
গানের সুরে শুধু মন মাতান তিনি।
লেটোর দলে ভিড়ে যাত্রাপালা করেন
দুঃখী মনের কথা তিনিই শুধু বোঝেন!
সেনাদলে ঢুকে আরবি ফারসি শেখেন
সাম্যবাদের কথা স্পষ্ট দৃপ্ত লেখেন।
কাঠবিড়ালি ছড়া খুকির জন্য লেখা
আবৃত্তিতে সবার প্রথমে তা শেখা।
ধূমকেতু এই কবি আগুন ভাষা বলেন
গানের বুলবুল শেষে বাক্যহারা হলেন।
জ্যৈষ্ঠ মাস এলে মনে পড়ে তাঁকে
সেলাম করে সবাই জন্মদিনে যাঁকে!
মাথুর দাস
কাব্যে গানে সুরে ও তানে একাই তিনি একশো,
লেটোর গানে জীবন আনে প্রাণটি ভরে দ্যাখ্ শো ।
কষ্টে যে তাঁর জীবন ভরা সৃষ্টি কত উজ্জ্বল !
উন্নত শির দৃপ্ত সাহস বুকে নিয়ে খুঁজ্ বল ।
বিদ্রোহ প্রেম ভক্তিগীতি শক্তিশালী লেখনী তাঁর,
মজার ছড়া ছোটদেরও তোলে অন্তরে কী ঝঙ্কার !
সাম্যবাদের কাম্য সে পথ তাঁর রচনায় পাই যে ঢের,
উঁচিয়ে মাথা বাঁচার গাথা শোনায় কথা সংগ্রামের ।
সরব কবি নীরব হয়ে কাটান জীবন শেষদিকে,
মরণ পরেও চির অমর সৃষ্টি কি তাঁর হয় ফিকে ?
নন্দিতা পতি ভট্টাচার্য
আজ এই অস্থির সময়ের স্রোতে ,
তোমাকে স্মরণ করি হে বিদ্রোহী কবি ।
আজও প্রতি মুহূর্তে তোমারই নিবিড় সান্নিধ্য অনুভব করি ,
প্রতিক্ষণে প্রতি পলে -পলে তোমারি বাণীর দৃপ্ত পদসঞ্চার শুনি।
ওগো কবি ,শুনতে কি পাওনা আজও -
উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে ।
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিত হচ্ছে।
বিদ্রোহী রণক্লান্ত কবি ,জানি আজও তুমি হওনি শান্ত -
আজও মানবতার অপমানে তোমার চোখ ফেটে আসে যদি জল,
তবে ফিরে এসো কবি, আমাদের মাঝে -
বিষের বাঁশী হাতে জন্ম নাও আর একবার ,
শোনাও আরেক নববোধনের গান বুলবুল হয়ে ।
নজরুল
প্রশান্তশেখর ভৌমিক
অবোধ মানুষ ভেদ করে আজও
আল্লা ভগবান।
দুখু-মিঁয়া ভগ্ন হৃদয়ে
কাঁদে সদা বসে স্বর্গে,
এ পোড়া দেশ অবহেলায়
সাম্যে পাঠায় মর্গে।
বিষের বাঁশী বাজায় আজিকে
কাল ভৈরবী সুর,
নজরুল দেখা স্বপ্নগুলো
ভেঙে করি চুর-চুর।
কলকাতা তথা ঢাকার মাঝে
ঘটে চলে শত ভুল,
চক্ষুর জলে বক্ষ ভেজান
মানুষের নজরুল।
উদাসী মনে বাঁশির সুর
জীবন জুড়ে শুধুই অস্থিরতা,
বিদ্রোহ আর শিকল ভাঙার গান,
দীপ্ত সূর্যের অগ্নিবীণায়
মুক্তির দিশারী জাগে-----
তোমার খুকু আজ অনেক বড়ো
সংসারের বাঁধন তাকে বাঁধতে পারে।
হৃদয় আকাশে তোলপাড়----
লক্ষ্মী আজ ধূলো বসে
বাণের জলে ভেসে যায়
জন্ম মৃত্যুকে উপেক্ষা করে।
এতো রঙ, এতো মুখোশ----
শুধুই চেয়ে থাকা নীরব কন্ঠস্বর---
বাঙালির প্রাণের কবি নজরুল ইসলাম
রইল শতকোটি প্রণাম।।
মৌ মধুবন্তী
আগুন জ্বলেছে তোমার কবিতা গানে
শোষকের বাঁধন করেছে ছিন্ন, তোমার আহবানে!
সত্যের জন্য তুলেছ বজ্র ধ্বনি,
ধরার বুকে পাতিয়া বুক অমনি।
বুকের ভিতর জাগিয়েছিলে বিদ্রোহের ঢেউ,
বাঁধন ছিঁড়ে চলার জন্য লিখেছিলে,
মানোনি কাওকেউ !
বাংলার মাঠে বাজিয়েছিলে উচ্চকিত গানের সুর,
বিদ্রোহ তুমি, সাম্য তুমি,
মানবতায় তুমি প্রেমের নূপুর।
দুঃখ-জয়ের মহা বারতা, জাগাতে চেয়েছিলে তুমি মানবতা।
নজরুল তুমি সবার কবি, জাগরিত এক অগ্নি-ছবি!
বিদ্রোহী কবি বীর
বিধানেন্দু পুরকাইত
ভারতের বুকে ধর্মের গেরো
বিঁধে গেছে জম্পেশ
কোন ধর্মই ভাবতে পারে না
এটাই আমার দেশ।
যবন নাকি কাফের
কে যে কোন দলে থাকে
দু'জন মারছে দু'জনকেই
যে যখন পায় যাকে।
হা-হুতাশ আজ বিদ্ধ করছে
মানবিকতার শির
তুমি ছাড়া তাই ভারতবর্ষ
হয়ে ওঠে অস্থির।
প্রেম নেই কোন প্রেমের ভণিতা
সন্দেহ ছায় দেশ
ফিরে এসো তুমি প্রেমের কবি
দাও কিছু সন্দেশ।
অষ্টপ্রহর জংলি মানুষে
মানবচেতন অস্থির
তোমার জন্যে দিন গুণি প্রিয়
বিদ্রোহী কবি বীর।
দুখু মিঁয়া
মহুয়া ব্যানার্জী
পৃথিবীর বুকে ধুমকেতু তুমি বাঙালির জনজাগরণ,
তোমাকে নিয়েই দুখু মিঁয়া,
কেটে গেল
এ অকিঞ্চিৎকর জীবন।
তুমি না জন্মালে জানা হত না
বিদ্রোহের প্রকৃত পরিচয়,
তুমি না বোঝালে বোঝা হত না
সাম্যবাদ খায় না মাথায় দেয়।
শ্যামা মা যে তোমার আপন মা
তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল না জানো!
তোমার অগ্নিবীণার সুরে জনগণ
মন অধিনায়িকা ভারত মায়ের চোখের জল মুছে যেত।
অথচ আজ এই অন্ধকার সময়ে দেখো
তোমাকেও কেমন কালিমালিপ্ত
করছে শেয়ালেরা-
যদিও তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না।
কারণ আমাদের চেতনার নাম নজরুল ইসলাম।
মৃত মানুষের নিস্তব্ধতা
গোবিন্দ বারিক
মৃত মানুষের মতো পড়ে আছে টুকরো টাকরা অপরাহ্ন। গোপনে ছড়ানো সাদা ফুল ঢেউ উঠে প্রাণের স্পন্দনে। নিরস্ত্র বিকেল প্রতিটি প্রাণ বুলেট অক্ষরে জ্বলছে রাঙা জবার মত উঠোনে রক্তের লালসা। এভাবেই পথহারা মানুষের উদভ্রান্ত জ্যোতির্ময়...
সর্বহারার মতো একপলক বাতাস বাইছে নজরুল।
পড়শী ভেবেই বুকে টেনে নিয়েছি তোমাকে। তোমাকে দিয়েছি সংযম সংহতি ধর্মনিরপেক্ষতা। তুমি বোঝনি এই নীল আকাশের বুকে লেগে আছে শান্তি। থরে থরে সাজানো পাহাড়ের বুকে ঝরে পড়ছে নিরালা নিস্তব্ধতা, আনন্দ প্রকৃতি। আমি তো প্রকৃতিকে নিয়ে সংহতির পর্বত তাক করে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছি আমার ভূমি। তবে কেন হত্যা লীলায় রাধা হয়েছে পাথর, উত্তরের আগুন- সিঁদুর ।
মাটি, মাটি মানেই মা। অন্তরের বিনয় রাগিনী, দাও বাঁচতে আকাশের মত তারাদের মত আমাদের মত। দাও অন্ন , রুটি দাও, দাও ফিরে মানুষের প্রাণ।
প্রাণের বিনিময় কি যুদ্ধ নাকি ধূলোর শস্যক্ষেত ?
আমার দৃষ্টিতে কাজী নজরুল
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
আমি তখন ছোট, খুবই ছোট। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। নিজের দাদা, পাড়ার দাদারা এ সময় নাটক করত। আমি অনেক দাদারই নাটকের রোল খাতায় তুলে দিতাম। একদিন একটি নাটকের রোল তুলতে গিয়ে এক চরিত্রের সংলাপে পেলাম এই লাইন ক’টি – “মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হ’ব শান্ত,/ যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দণরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ ভীম রণভূমে রনিবে না/ বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হ’ব শান্ত”। কেন জানিনা এই লাইন ক’টি সেই অল্পবয়সেই আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। আগ্রহভরে মুখস্থও করে ফেললাম। আর যখন তখন আওড়াতাম। পরে বড়ো হয়ে জানলাম এটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অংশবিশেষ।
স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল। একটি কবিতা একটা জাতিকে কিভাবে মুহূর্তের মধ্যে বীর্যবান করে তুলতে পারে, দেশের মরাগাঙে প্রাণের জোয়ার আনতে পারে, জীবনকে নতুন করে চেনাতে পারে, শোষণমুক্ত একটি সমাজের সুখস্বপ্ন দেখাতে পারে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে কবির যে রূপটি আমাকে উদ্বোধিত, উদ্বেলিত করেছিল এবং এখনো করে তা হ’ল কবির বিদ্রোহাত্মক মেজাজ। কবি স্বভাবগুনেই একজন প্রতিবাদী বিদ্রোহী কবি ছিলেন। তাঁর প্রতিবাদ ছিল অন্ধসংস্কার-কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ছিল ধর্মব্যবসায়ী ও মৌলবাদী পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যেখানেই শাসন-শোষণ-ত্রাসন লক্ষ্য করেছেন সেখানেই কবির লেখনী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তাঁর লেখন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলীয়ান করে তোলে, জাতপাতের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির বাইরে মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে শেখায়, শোষণমুক্তির সংগ্রামে প্রেরণা পাওয়া যায়। বাইশ বছরের সাহিত্যজীবনে তিনি শুধু গান-কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি, তাকে তিনি জীবনযুদ্ধের শাণিত হাতিয়ার করেছেন।
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত্ খেলছে জুয়া”, “কারার ওই লৌহকপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট,” “রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা”, “ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান”, কিংবা “মসজিদ এই মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়”, কিংবা “গাহি সাম্যের গান”- এগুলি নিছক কথার কথা নয়, অনাচারকীর্ণ সমাজব্যবস্থাকে বদলে দেবার এক একটি আগুন ভাষা। যতদিন পৃথিবীতে হানাহানি-রেষারেষি থাকবে, শাসন-শোষণ-ত্রাসন-অত্যাচার থাকবে, অন্ধ-বিশ্বাস, কু-সংস্কার থাকবে- ততদিনই থাকবে কাজী নজরুল ইসলামের এই সব কালজয়ী কবিতার আবেদন।
কবিতা সামন্ত
কাজী নজরুল ইসলামের নামটা মনে আসলেই প্রথমেই পুরো শরীরের লোমকূপ খাড়া হয়ে যায়।
ছোট থেকেই নজরুলের ছড়া কবিতা পড়ে বড় হয়ে ওঠা। তখন এতোটাও বোধগম্য হয়নি কবি নজরুল ইসলাম একজন সৈনিক দেশ প্রেমিক সেই সঙ্গে অসংখ্য ভক্তি গীতি রচনা করেছেন।
ভাবতাম এমনিই কিছু গান যা ছোটদের নাচের জন্য রচনা করেছিলেন।
এমনিতেই ছোট থেকেই ছবি আঁকতে ভীষণ ভালো লাগে তাই নজরুল ইসলামের ছবি আঁকতাম, স্কুলে নজরুল জয়ন্তীতে ছবি এঁকেছি কিংবা কর্মশিক্ষার পাতায় যখন সবাই কেনা ছবি লাগিয়ে যেত তখন আমি হাতে এঁকে নিয়ে যেতাম।
এমনও গেছে স্কুলের স্যার বলেছেন এটা তুই এঁকেছিস নাকি অন্য কেউ এঁকে দিয়েছে?
তারপর যখন নজরুলের আরও কবিতা পড়তে থাকলাম মনে মনে ভাবতাম সত্যিই এত কষ্টের জীবন কারো হয়!
ধীরে ধীরে দুখু মিঞার জীবনী পড়ার আগ্রহ জাগে মনে। কিন্তু কিভাবে পড়া যায়!
বাংলা আমার সব থেকে প্রিয় বিষয় ছিল।
তাই নজরুলের যত কবিতা পড়তাম কিংবা তার সম্বন্ধে লেখা পড়তাম বা শুনতাম কেমন যেন চোখের সামনে সবটা ভেসে উঠত।
ছোটবেলায় এফ এম রেডিও শোনার খুব ঝোঁক ছিল।
যেকোন মানুষের কাহিনী আমার যেন নেশা হয়ে গিয়েছিল।
একদিন নজরুল সম্বন্ধে শুনতে পেলাম।
যার জীবনটা এত কষ্টের যার সংসারজীবন সন্তানের মৃত শরীর ফেলে রেখে বুকে পাথর চাপা দিয়ে কবিতা গান রচনা করতে হয় তাকে জানা কি এতটাই সহজ!
প্রশ্ন করতে করতে "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে..."
গানটা বারং বার শুনে বুঝলাম কেন তিনি এই গান রচনা করেছেন!
কেন একজন বিদ্রোহী কবি গীতিকারের মধ্যে এতটা পরিবর্তন এলো!
এতো লাঞ্ছনা এতো অপমান সত্যিই কি তার প্রাপ্য ছিলো!
ভারতবর্ষের মাটি কামড়ে এতো বিপ্লবের জোয়ার বয়ে নিয়ে আসা,মানুষে মানুষে সাম্যের ঐক্যবদ্ধের জন্য এতো লড়াইয়ের পরও কেন তিনি কলমের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও বোবায় পরিণত করেফেললেন তা বোধহয় আমাদের বোধগম্যে বাইরে।
হৃদয়ে নজরুল,মননে নজরুল,শ্রদ্ধায় নজরুল থাক চিরতরে।
অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে!
নীলোৎপল
জানা
শুকনো খটখটে, এবড়োথেবড়ো, উঁচুনিচু, ঢেউখেলানো
ভূমি। শুকনো রুক্ষ মাটি রোদে পুড়ে খাঁখাঁ করছে। কৃষির জমির সামান্য মাটিটুকুও পাথর, কাঁকর আর
বালির মিশেলে কালচে হয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ ধু-ধু মাঠে ঝাঁকড়া মাথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে কিছু তালগাছ। একটা মাত্র নদী নাম ‘অজয়’ মৃতপ্রায় অবস্থায় বেঁচে আছে।
গ্রীষ্মের সময় জল শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। শুকনো মরসুমে নদীর উপর দিয়ে চলে ঘোড়ার গাড়ি।
বর্ষার প্রারম্ভে এই নদীই দুকূল ছাপিয়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। এদিকে ওদিকে ছোট বড়
পাহাড় জঙ্গল থাকলেও কয়লা খনির দূষিত বাতাসে চারিদিক বিষণ্ন হয়ে থাকে সব সময়। এই
স্থানের নামই চুরুলিয়া,
যা বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমায় অবস্থিত। প্রকৃতির এই বিরুদ্ধ পরিবেশের
ছোঁয়ায় মানুষের চালচলন,
মেজাজ-মর্জিও প্রকৃতির মতোই রুক্ষ কর্কশ হয়ে যায়।
এই বিরুদ্ধ পরিবেশেই ১৮৯৯
সালের ২৪ শে মে, বাংলা
সন ১৩০৬, তারিখ
১১ই জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার কাজী ফকির আহমদের ষষ্ঠ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। নবজাতকের সন্তানের
নাম রাখা হয় কাজী নজরুল ইসলাম। মুঘল সম্রাট শাহ আলম-এর শাসনকালে বিহারের রাজধানী
পাটনার হাজিপুর থেকে নজরুল পরিবার চুরুলিয়ায় আবাস গড়ে চলে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার
জন্য সম্রাটের আদেশে স্থানীয়ভাবে আদালত স্থাপন করা হয়। সম্রাটের প্রতিনিধি সমস্যার
সমাধান করতে পারছিলেন না। নতুন আসা পরিবারের একজন সদস্য সমস্যার সুন্দর সমাধান করে
দেন। দুপক্ষই তাঁর রায় মেনে নিলে সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে কাজী উপাধিতে ভূষিত করা
হলো। সম্রাটের দরবার হতে দান হিসেবে দেওয়া হয় বেশকিছু জায়গাজমি। তখন থেকে
পরিবারটির উপাধি হয়ে যায় কাজী পরিবার। এই পরিবারেরই সদস্য ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের বাড়ির পাশে ছিল
নরোত্তম রাজার গড়। গড়ের উলটো দিকে হাজী পালোয়ানের পুকুর। পুকুরপাড়ে ছিল হাজী
পালোয়ানের মাজার। মাজারের পাশে ছিল একটি মসজিদ। বাল্যকালে নজরুল এই মসজিদে আজান
দেওয়া, নামাজ
পড়ানো ছাড়াও ছোটদের হাদিস পড়াতেন। এখান থেকেই তিনি কোরআন-হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান
অর্জন করেন। চাচা বজলে করিমের কাছ থেকে ফারসি ভাষা এবং কবিতার পাঠ নিয়ে আরবি
ফার্সির সমন্বয়ে একদিন নজরুল লিখে ফেলেন একটি পদ্য। এটাই নজরুলের হাতে লেখা প্রথম
কবিতা।
‘মেরা
দিল বেতার কিয়া তেরে আক্রয়ে কামান;
জ্বলা যাতা হ্যায় ইশক মে জান পেরেশান।’
এরপর অসংখ্য পালাগান ও নাটক রচনা করেন। লেটো গানের দলে তাঁকে নিয়ে টানাটানি
পড়ে যায়। কিন্তু নজরুল বাল্যকাল থেকেই ছিলেন বাঁধনহারা। একদিন দলের ধরাবাঁধা
নিয়মকানুন ছেড়ে, গ্রাম
ছেড়ে, দল
ছেড়ে যাত্রা করেন অজানার পথে। হাজির হন আসানসোলে। নজরুল হয়ে উঠেছিলেন আসানসোলের
বেকারি বয়। রুটির দোকানের পাঁচ টাকা মাইনের ভৃত্য হয়ে কাটালেন কিছুদিন। সেখান থেকে
ময়মনসিংহ দরিরামপুর গ্রাম। ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে ছুটে গেলেন করাচিতে। নজরুলের
জীবনই যেন একজন বাউন্ডুলে যাযাবরের আত্মকাহিনি।
তাঁর জীবনের বাঁধনহারা
উল্লাসের রূপক হয়ে বারবার আবির্ভূত হয়েছেন আরবের বেদুইন, ভবঘুরে আর
বাউন্ডুলেরা। আর তাই তো চেঙ্গিস, কালাপাহাড়, গজনী মামুদরা বারবার উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় বিদ্রোহের
প্রতীক হিসেবে। এই স্কুলেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে। নজরুল, শৈলেন আর
শৈলজা মুসলমান, ক্রিশ্চান
আর ব্রাহ্মণ এই তিনজনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় সমপর্ক। জ্ঞান অর্জনের পথে ভাষা কখনো
তাঁর কাছে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি।
নজরুল কারো দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। মৌনি ফকিরের মৃত্যুতে ব্যথাতুর কবি
সেদিনই (১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসের এক রাতে) একটি কবিতা লেখেন। কবিতার নাম ‘ক্ষমা’।
‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য’ পত্রিকায় ১৩২৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় (১৯১৯ সালের
জুলাই-আগস্ট) ‘ক্ষমা’ কবিতাটিই ‘মুক্তি’ নামে প্রকাশিত হয়। মুক্তি নজরুলের
প্রকাশিত প্রথম কবিতা। ১৯১৭ সাল, নজরুল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা
বেজে উঠেছে। মেট্রিক পরীক্ষার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে চুরুলিয়াকে বিদায় জানিয়ে যোগ
দেন বেঙ্গল রেজিমেন্টে। লাহোর থেকে পেশোয়ার, পেশোয়ার থেকে করাচি নৈশেরা শুরু হয়
সৈনিকজীবন। সেনানিবাসে থাকাকালীন তিনি দ্রুতই হাবিলদার পদে উপনীত হন।
১৯২০ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্ট
ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল কলকাতায় ফিরে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য
সমিতির অফিসে আসেন। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সহকারী সম্পাদক মুজফফর আহমেদের
সঙ্গে ছিল নজরুলের প্রগাঢ় সমপর্ক। ১৯২০ সালের ১২ই জুলাই দুজনে একসঙ্গে ‘নবযুগ’
নামের সান্ধ্য পত্রিকা বের করেন। নজরুল বারবার প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু কুমিল্লার
পল্লিবালা নার্গিসের প্রেমের বারিধারায় সিক্ত হয়েছিল তাঁর মনপ্রাণ। নার্গিসের
সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলে বেদনার আগুনে দগ্ধ হয়ে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিবীণা । কুমিল্লা
থেকে ফিরে নজরুল কলকাতায় এসে মুজফফর আহমেদের ৩/৪-সি তালতলা লেনের বাসায় ওঠেন। এই
বাড়িতেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে কবি রচনা করেন তাঁর কালজয়ী কবিতা
‘বিদ্রোহী’।
১৯২২ সালে তাঁর প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকায় আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা প্রকাশের
কারণে রাজদ্রোহিতার অপরাধ এনে নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যন্ত্রণার নীল হয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি হিসেবে কবিতা লেখার জন্য কারাদণ্ড
স্বীকার করে নেন। কারারুদ্ধ অবস্থায় বন্দীদের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদে তিনি অনশন
করেন। তাঁকে নাকে নল ঢুকিয়ে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলো। তাদের প্রচেষ্টা
ব্যর্থ হয়। কবি বদ্ধ ঘরে উচ্চারণ করেন ‘কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে
লোপাট’—অর্ফিয়াসের মতো তাঁর হিরন্ময় সুরে চারপাশে সাড়া পড়ে যায়। চিরবিদ্রোহী নজরুল
ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অর্ফিয়াস। তাঁর উদয়ে থেমে গিয়েছিল বাংলা কবিতার চিরন্তন
ভাষা। ছন্দের অক্ষরে সূচিত হয়েছিল বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ। নতুন
জোয়ার উঠল বাংলা সাহিত্যে।পালবদল ঘটলো চির চেনা পথের।
তথ্যসূত্র-
পত্রপত্রিকা ও গুগল
0 মন্তব্যসমূহ