দুইপাতা সাহিত্য-পত্রিকা ৯৯তম সংখ্যা ।। রবীন্দ্রনাথ ।। ২০২৫

 

                                                                        দুইপাতা সাহিত্য-পত্রিকা

                                                                                 অণুগদ্য                                                               

তিনি আমাদের কাছের জন

অরবিন্দ সরকার

যখন  তার উপর শরতের আলে পড়ত, সূর্যের আলোয় তার দেহের প্রতি অঙ্গের রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকতো। তিনি বলছেন, আমি কত দূরদূরান্তর কত দেশ দেশান্তরের জল স্হল পর্বত  ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীঢে নিস্তব্ধ ভাবে শুয়ে থাকতুম। তাঁর এই পবিত্র টান পৃথিবীর প্রতি। এই  স্হান ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে চাননি।তিনি আমাদের প্রেরণা। বেঁচে থাকার বলিষ্ঠ রসদ। সংকটে শৌর্য প্রকাশে অলৌকিক জ্যেৎস্না হলেন তিনি। আবার প্রতিবাদী চরিত্র গঠনে তিলি হলেন অগ্রপথিক। আবার নিজ দেশের সম্মান রক্ষার্থে সংস্কৃতিকে পৌঁছে দেবার জন্য  চিন্ময়ী দূত। ভালবাসার টানে তাঁর উত্থান।

পারস্পরিক বোধে সকলের তরে  সকলে আমরা।

 

মন জুড়ে রবির ছোঁয়া

শংকরপ্রসাদ গুড়িয়া

রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে শুধুই একজন কবি নন। তিনি আমার এক নিঃশব্দ সঙ্গী। যখন মন খারাপ থাকে, তখন তাঁর “বিপদে মোরে রক্ষা করো” গানের মধ্যে খুঁজে পাই ভরসা। আর যখন জীবনের আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে, তখন গেয়ে উঠি—“আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে…”

আমার শিশুকাল কেটেছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, মা যখন রান্নাঘরে ব্যস্ত, তখন রেডিওতে বাজত তাঁর গান। তখন না বুঝলেও শব্দগুলো মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। এখন বুঝি, কবিগুরু শুধু সাহিত্য নয়, আমার মানস প্রতিমা গঠনের এক অদৃশ্য কারিগর।

তিনি এমনভাবে জীবনকে দেখিয়েছেন, যেন প্রতিটি অনুভবেই সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। প্রকৃতি, প্রেম, বেদনা, বেঁচে থাকার ছোট ছোট মুহূর্ত—সব কিছুকে তিনি এক অলৌকিক রূপ দিয়েছিলেন। তাঁর লেখার মধ্যে একধরনের শান্তি আছে, যা এই ব্যস্ত, যান্ত্রিক জীবনে এসে আমাদের আবার মাটির কাছাকাছি নিয়ে যায়।

২৫ বৈশাখে তাই আমি শুধু তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই না, যেন তাঁর নিজের সত্তার একটা অংশকে ছুঁয়ে দেখি। কবিগুরু ইহলোকে নেই সত্য, কিন্তু তবুও আছেন—আমার প্রতিটি ভাবনায়, অনুভবে, এমনকি নিঃশ্বাসেও।

তাঁকে  পুরোপুরি বোঝা অসম্ভব, তবে তিনি আমাদের অনুভব ও আবেগকে যে দোলা দিয়ে যান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তো বলি, কবিগুরু—তুমি আছো হৃদয়ে মম!

 

“আমার মাথা নত করে দাও হে-”

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

 

“বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে/কোথা থেকে এলে তুমি হৃদি মাঝারে॥

ওই মুখ ওই হাসি/ কেন এত ভালোবাসি, /কেন গো নীরবে ভাসি অশ্রুধারে।”

তোমারে হেরিয়া যেন জাগে স্মরণে,/ তুমি চির পুরাতন চিরজীবনে।

তুমি না দাঁড়ালে আসি হৃদয়ে বাজে না বাঁশি-/ যত আলো যত হাসি ডুবে আঁধারে।”

বিশ্বসংসারে রবীন্দ্রনাথ হলেন এক অত্যাশ্চর্য প্রতিভাধর মানুষ। যে প্রতিভার জোরে তিনি সমগ্র জগতবাসীর হৃদয়ে একটি স্থায়ী আসন লাভ করে নিয়েছেন। বেঁচে আছেন আমাদের অন্তরে। এমনিভাবেই বেঁচে থাকবেন আগামীদিনেও। তাঁর অতুলনীয় সাহিত্যপ্রতিভা আমাদের কাছে আজও বাঁচার মন্ত্র। হ্যাঁ, আজকের এই দু:সময়ে দাঁড়িয়েও যে কথা নির্দ্ধিধায় স্বীকার করে নেওয়া যায়। বড়ো মাপের একজন শিক্ষক হয়ে তিনি প্রতিমুহূর্তে আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছেন। শুনিয়ে চলেছেন সেই অভয় মন্ত্র যা উচ্চারণ করে আমরা কিছুটা হলেও সাহস পাই।

“বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা-

বিপদে আমি না যেন করি ভয়।”

দু:খতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,

দু:খে যেন করিতে পরি জয়।”

আসলে তিনি তো শুধু কবি ছিলেন না, কেবলমাত্র একজন সাহিত্যিক ছিলেন না – তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই মানবপ্রেমিক, অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ। আনন্দ-খুশির পাশাপাশি রোগে-শোকে-তাপে-দু:খে আর ব্যথায় আর্তিতেও হয়ে উঠেছেন আমাদের একমাত্র আশ্রয়দাতা, পথ-প্রদর্শক। না, রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমাদের একমুহূর্তও চলে না। তাইতো তাঁর অমোঘ বাণীকে সামনে রেখে আজও আমরাও গেয়ে উঠি –

“জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।

সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো॥”

এ তো আমাদের হয়েই তাঁর করুণ আর্তি ঝরে পড়েছে। অতি জোরের সঙ্গে তিনিই তো উচ্চারণ করেছেন

“দুখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে।”

যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় ক’রে ধরিব হে।

আঁধারে মুখ ঢাকিলে, স্বামী, তোমারে তবু চিনিব আমি-

মরণরূপে আসিলে, প্রভু, চরণ ধরি মরিব হে। ”

এই মুহূর্তে আমরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। সমগ্র বিশ্ববাসী এক কষ্টের মধ্যে রয়েছে। একটা অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত আমরা ভারতবাসীরাও। ভয়ের এই কঠিন সঙ্কটকালে রবীন্দ্রনাথই যেন আমাদের ভরসা, অনেকখানি অন্ধকারে আলোর দীপশিখা। তাঁরই গানের মধ্য কালোত্তীর্ণ, বিশ্বজনীন রবীন্দ্রনাথকে আমাদের হৃদয়ের প্রণাম।

“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে

সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।”

 

গানে গানে বিশ্বমানবতা

শিশিরকুমার বাগ

আমরা গড় বাঙালিরা কমবেশি নিজেদের ভাবনা ভাবতেই অভ্যস্ত। মানুষের নিজের পরিবারের কথা ভাবার মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিন্তু নিজের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, জামাতা, নাতি-নাতনিদের কথা অনেক ভেবেছেন, তাঁদের জন্য অনেক সময় দিয়েছেন। রোগশয্যায় পাশে থাকা থেকে শুরু করে তাঁদের সুখ-দুঃখ-ভবিষ্যৎ চিন্তা তাঁকে নানাভাবে ব্যাকুল করেছে। কিন্তু তার পরেও তিনি বলতে পেরেছেন, ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া / বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’

যে কোনো সৃষ্টিশীল শিল্পী, গবেষক, দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা কিন্তু তাঁদের সৃষ্টি বা গবেষণার উপাদানগুলি সংগ্রহ করেন বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে। আবার তাঁদের সৃষ্টি করা সাহিত্য শিল্প এবং ভাবনাগুলি হয়ে ওঠে বিশ্বের সবার কল্যাণের জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক ও চিত্রকলাগুলির মধ্যে রয়েছে সেই বিশ্বভাবনারই প্রতিফলন।

আমরা আজ ভুবনগ্রামের কথা বলি। অথচ আজ থেকে একশো দেড়শো বছর আগে ইন্টারনেটবিহীন সময়েও এ ধরনের একটা কনসেপ্ট আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গোটা বিশ্বের মাঝে নিজেকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন। নিজেকে স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ / তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান - - -’। নিজের মনের মুক্তি না ঘটলে বিশ্বভুবন তো দূরের কথা, পাশের মানুষকেই ঠিকমতো চিনে নেওয়া যাবে না। তিনি লিখলেন - ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে - - - ’। বিশ্বের নানা প্রান্তের জ্ঞান ও চিন্তাভাবনার যোগসূত্র রচনার ইচ্ছা নিয়েই গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বভারতী। নিজের মধ্যে বিশ্বমানব হয়ে ওঠার ইচ্ছা ও সাধনা তাঁর চিরকালের। সেই আকাঙক্ষার কথাই গানের মধ্যে তুলে ধরেছেন – ‘জগত জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে / সে গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া-মাঝে।’ কখনও বলেছেন, - ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ - - -’। আবার এমন কথাও তিনি গানের মধ্যে বলে চলেন, যা তাঁর প্রাণের কথা – ‘বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো / সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।’

নিজের সঙ্গে, নিজের দেশের সঙ্গে, সারা বিশ্বের ভাবনা-প্রাবাহেক সঙ্গে নিজেকে অনায়াসে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। আজ আমাদের চারপাশে যে সব হিংসা, দ্বন্দ্ব, রক্তপাত ও সামাজিক অবক্ষয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে, তিনি অনুভব করেছেন তা কেবল আমাদের রাজ্যের বা ভারতবর্ষের নয়, গোটা বিশ্বে তাই ঘটে চলেছে। এ কারণেই তাঁর লেখনীতে উঠে আসে, - ‘হিংসার উন্মত্ত পৃথ্বী নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব।’ নিজের মাতৃভূমির সঙ্গে অনায়াসে সমগ্র বিশ্বকেও যুক্ত করে নিতে এতোটুকু দেরি করেননি তিনি। তাঁর গান  - ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা / তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’ আর এই জন্যই তো তিনি আমাদের প্রাণের মানুষ, তিনি বিশ্বমানব, তিনি বিশ্বকবি।


যার নাম রোদ

লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল


'তবে পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে 

রূপ না দিলে  যদি বিধি হে ' -

এ আক্ষেপ নিজের কাছেই । ভালোবাসা চাই  - ভালোবাসা চাই  - ভালোবাসতে চাই - ভালোবাসতে চাই , আজ চিৎকার করে বলতে হচ্ছে ।   যেমন করে বিন্দু বিন্দু জলকনা নদী হতে চায়,  স্রোত হতে চায় ,  সমুদ্র হতে চায় । যেমন করে গাছ সবুজ হতে চায় ,  ফুল ফোটাতে চায়,  ফল ফলাতে চায় । এই বোধটুকু জন্মায় তখনই  -  যখন গোপনে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে ওঠে  সত্তা । 

বিপন্নতা না এলে  ঠিক সেখানে যেতে চাই না , যেখানে সুন্দর ।  আশঙ্কা না থাকলে তার ধারও মাড়াতে চাই না , যেখানে সত্য ।  কেননা আমাদের চারপাশে এত রোশনাই , এত সাইনবোর্ড ,  এত কাট আউট  তার নিচে আমরা সব আলেয়া-পথিক । কিন্তু আামাদের  ' আছে আছে স্থান । / একা তুমি, তোমার শুধু এক আঁটি ধান ।  / না হয় হবে ঘেঁষাঘেঁষি  / এমন কিছু নয় সে বেশি - / না হয় কিছু ভারী হবে আমার তরীখান - / তাই বলে কি ফিরবে ?  আছে , আছে  স্থান । '

অন্তিমে এসে মানুষ শুরুর দিকে ফিরে যেতে চাইবে ,  এটাই স্বাভাবিক ।  যেমন এতদিন কেউ পৃথিবীর কথা ভাবতে চায় নি - আগুন জ্বালিয়েছে তার শরীরে - পৃথিবী জ্বলতে জ্বলতে  তার নিজের জ্বালার কথা বলেছে । কেউ অনুভব করতে চায় নি সেই যন্ত্রণা ।  দুষিত হতে হতে সে বলেছ শ্বাসকষ্টের কথা । কেউ শুনতে চায় নি । ধোঁয়ায় ভরা পৃথিবীতে ফুরিয়ে যাচ্ছে শ্বাসবায়ু । অবজ্ঞা করছে চঞ্চলতা ।  তার জন্য মানুষের কোন আবেগই ছিল না ।

কিন্তু হে অন্তর   -  ’ নীরব বাঁশরি খানি বেজেছে আবার  - '

ফিরে আসে আবেগ  , ফিরে আসে তার একেবারে সুচনা কালের ছবি । যাত্রাপথ, স্কুল পালানো , প্রাণের ধ্বনি । সেই মধুর স্বর , সেই মাধবীলতা  ,  সেই ভেজা মাটির গন্ধ ।   যা অবচেতন অন্তরে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার হয়ে কুলুঙ্গিতে গচ্ছিত ছিল।  আজ তীব্র হয়ে ওঠেছে তার স্মৃতি-অতীত আকুতি ; এবং খুবই স্পষ্টভাবে । সহজভাবে  বলতে গেলে, সময় দ্রুত পাল্টে  যাচ্ছে ,  রূপ পাল্টাচ্ছে প্রকৃতির , মানুষের মূল্যবোধে পরিবর্তন আসছে , প্রাকৃতিক  তৎপরতার কারনে আপাত অর্থে চলছে অন্তর শোধনবোধ , ফিরে আসছে  ঐতিহ্য , সাংস্কৃতিক প্রত্যয় , বিলীন হচ্ছে ঝলমলে নিজস্ব প্রকরণ , স্বপ্ন গান কথা গল্প ।

উল্টে যাচ্ছি নিজের পাতাগুলো । কত কিছু লেখা আছে প্রতিটি পঙক্তিতে। পড়ছি 'ছোট খোকা বলে অ আ '। পড়ছি 'কাল ছিল ডাল খালি / আজ ফুলে যায় ভরে।  / বল দেখি তুই মালি হয় সে কেমন করে । ' জানি না ,  আজও বুঝতে পারিনি কেমন করে ফুল ফোটে । এটি যুক্তির ধার ধারে না। এটি বলতে দেয় না ফুল ফোটার শর্ত কি ছিল ।  শুধু অন্তরে জমা ফুল গণ্ডি পেরোতে চায় , বন্দিদশা থেকে চায় মুক্তি ।  মুক্তি বললাম এই কারণে যে, সংগীতের মতন স্বাধীন হবার প্রসঙ্গটি এসে যাচ্ছে বারবার । থেকে থেকে বেজে ওঠে অন্তর  । কেঁপে ওঠে বাদ্য মর্মর ।  কৃতজ্ঞ সুন্দরের কাছে সে সুর ' দে দোল দোল , দে দোল দোল / এ মহাসাগরে তুফান তোল / বধুরে আমার পেয়েছি আবার , ভরেছে কোল  - '/ 

বসবাসের এসব মর্মযাতনা ও বেদনা এখন মিস্টিক হলেও সত্য । জীবনের কালপর্বগুলোর অনিবার্যতা অন্তর্সত্যকে ক্লাসিক্যাল জায়গাটি চিনিয়ে দেয়  - উন্মোচন করে প্রাণের সৌন্দর্য । আমি গুনগুন করে গাইতে থাকি   ' এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ,  প্রাণেশ হে  - '

এই  পাওয়ার মাঝেই আমার বর্তমান । যার নাম রোদ।

 

অন্তর মম বিকশিত কর
মৌ মধুবন্তী 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু একজন কবি নন, তিনি আমার সকালের প্রথম আলো, সন্ধ্যার শেষ রাঙা আভা এবং সারাদিনের অনুরণিত সুর। তাঁর বাণী ও সৃষ্টি আমার হৃদয়ে অমৃতধারার মতো প্রবাহিত হয়, আমাকে স্পর্শ করে প্রতিটি মুহূর্তে। তাঁর কবিতার প্রতিটি চরণ নিয়ন আলোর মতো জ্বলজ্বল করে আমার মননে, চেতনায় ও অন্তরে।  

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম জীবনের গভীরতা ও সৌন্দর্যের এক অসামান্য দর্পণ। "গীতাঞ্জলি"-র আধ্যাত্মিকতা, "শেষের কবিতা"-র প্রেম, "চিত্রা"-র আবেগ—সবই আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। তাঁর গান আমার প্রাণে বাজে, "আমার সোনার বাংলা" থেকে "পুরানো সেই দিনের কথা"—প্রতিটি সুরে মিশে আছে বাংলার মাটি ও মানুষের কথা।  

তিনি আমার চিন্তায়, স্বপ্নে, সংগ্রামে ও আনন্দে সমভাবে বিরাজমান। তাঁর লেখনী আমাকে শক্তি জোগায়, "যেখানে ভয়, সেখানে যেও না"—এই মন্ত্রে আমি পথ চলি। কবিগুরু কেবল ইতিহাসের পাতায় নন, তিনি আমার প্রতিদিনের সঙ্গী, আমার প্রেরণার অক্ষয় উৎস।  

"তুমি আছো হৃদয়ে মম"—এই বোধে আজও রবীন্দ্রনাথ অম্লান। তাঁর জন্মদিনে জানাই অন্তরের শ্রদ্ধা, যাঁর আলোয় আমার জীবন উদ্ভাসিত।


রবে নীরবে

পবিত্রকুমার ভক্তা

আমার আর্ত হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ আলোকবর্তিকা। আমার বালিশ ভেজা দুঃখ রাতে তিনিই ছিলেন সাথে। অনুগত দিন নুইয়ে দিলে দিনের শেষে আরাম পেয়েছি তার গানে, কবিতায়। বিষয়ের বিষ্ময় যন্ত্রণায়, গভীর ভাবনায়, সমস্যার সমাধানে তিনি আমার বন্ধু হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ আমার বাবার মত, যার হাত ধরে রাত্রিবেলায় পড়ার শেষে দোকান থেকে ফিরেছি। শৈশবের প্রীতি আর স্মৃতি। আমার দাদুর মত এক লম্বা মানুষ। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে পুজ্য। ঠাকুর। তিনি আমার কাছে শুধুমাত্র কবি নন, তিনি আমাদের মন–মুহুর্তগুলোর সুরকার, দুঃখজয়ী মহান অভিভাবক। তাঁর রচনাবলী আমাদের দুঃখ ঘুচায়, হৃদয়ে আশার দীপ জ্বালে।

     গরিবের সংসারে খুদকুঁড়া ছাড়া আমার আইমার মত স্নেহ পাই এখন তার কাছে। আমার শাশুড়িমার মত আর আদর কে দেবে? এদেরকে খুঁজি, হয়তোবা পেয়েও যাই। কোথায় ? কোন কোন লেখায়। তার প্রদীপ্ত অনুপ্রেরণায় আজ আমি জীবনের মূলমন্ত্রগুলো খুঁজে দেখি। জীবনের প্রতিটি অন্ধকারে তাঁর বার্তাগুলো আমার পথপ্রদর্শক। স্বাধীনতা-দেশপ্রেম-সমাজ ভাবনা যখন স্বার্থপরতার লাশকাটা ঘরে, ধুকপুকানিটুকু জাগিয়ে রেখেছেন হৃদয়ে তিনি। মানবতা, প্রেমে। প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের নিবিড় রহস্য বুঝিয়েছেন সাংঘাতিকভাবে। সাংসারিক অশান্তির থেকে অবিরত মুক্তির পথে, আত্মার শান্তির পথে তিনি আমার আকর্ষণ। আমার শিক্ষক। এখনো পড়ার ঘরে বইয়ের তাকে সেই বইটা। এতবার পড়েও পড়া হয়নি। সমুদ্রকে কি এত সহজে ধারণ করা যায়? এক আঁজলা শুধু ছোঁয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র। আঙ্গুলের ফাঁকে গলে যাচ্ছে। জীবন যৌবন,অখিল ভুবনে "তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম ,তুমি রবে নীরবে" আমার স্বত্তায়।

 

চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ

অদিতি সেনগুপ্ত

বহুমুখী প্রতিভা বলতে যা বোঝায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁকে কবিগুরু আখ্যা দিলেও সাহিত্য এবং সংস্কৃতির আনাচে কানাচে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, নাট্যকার, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং চিত্রশিল্পী। 

জীবনের বহু বছর পেরিয়ে এসে তিনি গুরুত্ব সহকারে ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন। মূলত ৬৩ বছর বয়স থেকে তিনি চিত্রকলার পরিচর্যা শুরু করেছিলেন। জীবন সায়াহ্নে পরিচর্যা শুরু করেও প্রায় দুই হাজারেরও বেশি ছবি তিনি এঁকেছিলেন। সম্পূর্ণ স্বকীয়তার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় তাঁর চিত্র চর্চায়। চিত্রকলায় কোনোরকম প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। পাণ্ডুলিপি উপর কাটাকুটি থেকে নতুন আকারের সৃষ্টি করতে করতেই তাঁর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটেছিল। আসলে শিল্পী মন মাত্রই সৌন্দর্য প্রিয়। তাই লিখতে লিখতে কাটাকুটি গুলিকেও সৌন্দর্য প্রদান করেছিলেন কবিগুরু। তাঁর ছবিগুলি ছিল মূলত রেখাচিত্র ভিত্তিক। আঁকার মাধ্যম হিসেবে তিনি মূলত কলমের কালি ব্যবহার করতেন। এছাড়াও, ক্রেয়ন, প্যাস্টেল, চারকোল এবং তেল রঙের  ব্যবহারও দেখা গেছে তাঁর আঁকা ছবিতে। কাগজ ছাড়াও বাঁশের টুকরো ও সেরামিকের উপরেও ছবি এঁকেছেন তিনি। এছাড়া জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের প্রভাব দেখা যায় তাঁর চিত্রকলায়।

রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শন হয়েছিল ১৯৩০ সালে, প্যারিসের পিগ্যাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর দেশে-বিদেশে তাঁর আঁকা ছবির বহু প্রদর্শনী হয়েছে। বিশ্বভারতীর কলাভবনে নন্দন আর্ট গ্যালারিতে তাঁর আঁকা ছবি আজও নিয়মিতরূপে প্রদর্শিত হয়। এছাড়াও, বিভিন্ন সময়ে কলকাতা আর্ট কলেজ এবং অন্যান্য আর্ট গ্যালারিতেও তাঁর ছবির প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে।

৬৩ বছর বয়সে এসে শুরু করা কলাটিও এমন ভাবে ডালপালা বিস্তার করেছিল যে, শুধুমাত্র চিত্রশিল্পী হিসেবেও যদি তাঁর উত্তরণ ঘটত তাহলেও এক শ্রেষ্ঠ চিত্রকর হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত হতেন।

 

'তুমি রবে নীরবে

দুর্গাদাস মিদ্যা

 

'তুমি রবে নীরবে ' এই তিনটি শব্দ শুধুমাত্র শব্দ নয়।এই শব্দগুলোর মধ্যে এক গূঢ় তত্ব নিহিত আছে । নীরবতার মধ্য যে জীবন -বোধ তৈরি হয় তা অনুধাবন করা আমাদের মতো মানুষ জনের পক্ষে সম্ভব নয়।কারণ  যতক্ষণ না আমরা স্থিতধী হচ্ছি  যতক্ষণ না আমাদের ভাবনা বা চিন্তাকে সমাহিত করতে পারছি অন্তরে ততক্ষণ আমাদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য পড়ে থাকবে।এই সত্যের উপলব্ধি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ করতে পেরেছিলেন বলেই এমন বোধিপূর্ণ শব্দের সমাহার ঘটাতে পেরেছিলেন।

জীবনের গতিপথ বদলাতে বদলাতে আমাদের চলাচল। সেখানে যেমন শব্দের প্রাবল্য আছে তেমনি নিভৃতিও আছে। মন দিয়ে কাজ করতে গেলে অবশ্যই নীরবতার অনুসঙ্গ প্রয়োজন।

মনোনিবেশ শব্দের মধ্যে নিবিষ্টতার ইঙ্গিত আছে ।নিবিষ্টতা ছাড়া সৃষ্টির মগ্নতা আসে না।তাই যে কোন সফল ব্যাক্তির সাফল্যের কারণ নীরবতা।

'তুমি' কথাটির অনেক ইঙ্গিত পূর্ণ অর্থ আছে ।

কবি যখন ভাবছেন তখন আমাদের মনে হতে পারে যে  তিনি হয়ত বা কোন বিশেষ জনের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন তাঁর স্মৃতি পটে নীরবে অধিষ্ঠান করার কথা বলছেন। তিনি ঈশ্বর বা ঈশ্বরী হতে পারেন তা কিন্তু নয়।

তাঁর কাছে ঈশ্বর বলে কোন বিশেষ দেবতা নেই।

তাঁর কাছে মন্দিরের দেবতার প্রতি বিশ্বাস ছিল না।। তিনি মানবতাবাদী একজন মানুষ। তাঁর কাছে মানুষের সম্মান বড় । তাঁর কাছে বড় সত্য জীবনদেবতা। সেই তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন কবি  -তুমি নীরবে অবস্থান করো ।

তোমার এই নীরব অবস্থানই আমার অর্থাৎ কবিগুরুর চালিকা শক্তি।আর সেই শক্তির বলেই তিনি সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি হবার কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । নীরবতার আশ্রয়ে না থাকলে আমরা সেই অতুল সম্পদের

অধিকারী হতে পারতাম না।

 

তুমি নব নব রুপে এসো প্রাণে

অপর্ণা দেওঘরিয়া

 তুমি আছো নব নব রুপে শয়নে স্বপনে দুঃখ সুখের দোলায়, অতলস্পর্শী সুরে, হিরন্ময় আলোয়,অন্তর জুড়ে --

যখন মন খারাপের জানালায় পাখি বসে না, অস্থির সময় জুড়ে যুদ্ধময় বিষন্নতা,মানবিক মূল্যবোধ মনুষ্যত্ব বিবেক নাড়া দেয়, দূষিত বাতাস বিষ ছড়ায়,

কি ভাবে উড়ায় বলো বিশ্বাসের ধ্বজা, নয়নো জড়িত লজ্জায়,

আমারো পরাণো যাহা চায়,তুমি তাই তুমি  তাই গো---

তোমাকে আগলে রাখি গন্ধ সুধায়, নয়নে নয়নে অবিশ্রান্ত প্রেমের সুধায়, বিশ্বাসে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়, তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমারো প্রাণ।

তবু মনে রেখো যদি দূরে চলে যাই।

শত অপমানেও ইতিউতি খেলায়

অনুরাগে অভিমানে তৃষ্ণায় বড় ভিজতে ইচ্ছে করে, নীলাভ প্রেমের দহনে,রৌদ্রবিলাসে, প্রলয়ে দহনে,

যা না চাইবার তা আজি চাই গো---

কত টা মন খারাপ হলে তাকে ছুঁতে পারিনা, এত আয়োজনের  স্পর্শে ভালোবাসতে পারি না।

তোমার তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নদীতে বয়ে যায় একাকী অজানায় শূন্যতায় পিপাসায়,আগুন খেলায়।

তাই তো ডাকি

হে সখা হৃদয় জুড়ে তুমি শুধু তুমি

আয় না কবি আমার বুকে উথাল-পাতাল কতই সুখ,

আয় না কবি রৌদ্রখেলায়,ভাসছে কেবল তোমার মুখ।

 

তুমি আছো হৃদয়ে মম

শংকর সামন্ত

 বঙ্গ সাহিত্যের কাব্য ভান্ডারের অমূল্য রত্ন কবি কুলপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রতীক, আমার প্রিয় কবি। তার লেখনি কাব্য প্রতিভায় ভাস্বর, জীবনের সুখ-দুঃখ, বিরহ মিলন সৃষ্টি আমাকে অনির্বাচনীয় আনন্দ দেয়, পথ দেখায় । তার কাব্যের প্রতিটি ছত্র প্রেরণা যোগায় । প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তে বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে চলার পথ দেখায় । তার কবিতায় খুঁজে পাই সত্যসুন্দর, মঙ্গলের বাণী, মানুষের প্রতি, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস - এ এক দুর্লভ প্রেরণা।

সরলা দেবীর রচনায় - রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মদিন পালন হয় ৭ই মে ১৮৮৭। ওই সময় থেকেই জন্মদিন পালন শুরু হয়।

তার প্রকৃতি চেতনা, সৌন্দর্জানুভূতি, সত্য-সুন্দর মঙ্গলের প্রতীক। যা সুন্দর - তাই শাশ্বত কল্যাণ-  তাই শাশ্বত সত্য।

কালবৈশাখীর কালোরূপের মধ্যে সৌন্দর্য ও শাশ্বত সুন্দর ও সত্যের প্রকাশ রূপ দেখতে পেয়েছেন। কবি কিটস বলেছেন "Beauty is truth, Truth beauty."

অপরদিকে তার দেশপ্রেম, স্বদেশিকতা বিশ্বপ্রেম, জাতীয়তাবোধ - আপামর জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই তিনি বলেন - "সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে" আবার গেয়ে ওঠেন - "ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা"।

"আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে—

হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ,

পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।" - তিনি এক বাস্তবকে তুলে ধরেছেন।

অপরদিকে -

"বাটি হাতে এ ঐ

হাঁক দেয় দে দৈ।" - আরেক অন্য অনুভূতির প্রকাশ। হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে শিশুমনের দুয়ারের চাবি খুলে দিয়েছেন।

"হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,

জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি" - কবির দর্শনানুভূতিতে মহা-সৌন্দর্যের সন্ধান দিয়েছেন। হৃদয়ের দুয়ার কথা বলেছেন, হৃদয়ের প্রসারতার কথা বলেছেন। মানুষ কর্মের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলুক, প্রতিষ্ঠিত হউক - তিনি পলে পলে অনুভব করেছেন, অনুভবের পথ দেখিয়েছেন।

তিনি সারাজীবন ধরে প্রকৃতি থেকে,  ক্ষয়িষ্ণু জীবনবোধ থেকে - হৃদপিন্ডের নিংড়ে নেওয়া সমস্ত রক্তকে অজ্ঞাতে বিলিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এখানেই তার সাহিত্যকর্মের সার্থকতা। তিনি জীবন সাধন, সমুদ্রের জলরাশির উত্তাল কলধ্বনির সঙ্গে তুলনা করেই নিজেকে কর্মযজ্ঞে উত্তাল হতে বলেছেন।

প্রেমের অতল অতৃপ্তি মানবমনকে এক জটিল অপরিচয়তা থেকে সংযত হতে বলেছেন। চেতনা প্রবাহকে পৃথিবীর জীবন্ত কোষের অনু-পরমাণুতে প্রবাহিত করার কথা বলেছেন। তিনি নরনারীর চিরকালের দন্দকে সহজ সরলতার সঙ্গী করে, আসক্তি কৃপণতা ত্যাগ করে, সন্তানের জন্য - প্রিয়জনের জন্য - সংসারের জন্য ত্যাগের পথ দেখিয়েছেন। তিনি অন্যায়ের সাথে আপোষ কোনদিনই করেননি, তাই বলেছেন - "অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।"

তার লেখা পংক্তির মধ্য দিয়ে অন্যায়কারী ও অন্যায় সমর্থনকারী উভয়কে ঘৃণার চোখে দেখতে বলেছেন। উভয়েই সমাজের কাছে নিন্দনীয়।

"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে"- তিনি চলমান ক্ষয়িষ্ণু সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করেই বলেছেন, প্রতিবাদ করার জন্য কেউ যদি সঙ্গে না আসে তবে একলা চলার - একলা এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তোমাকেই পথ নিরূপণ করে এগিয়ে যেতে হবে।

"জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে

 ভারত ভাগ্য বিধাতা" - তার লেখা জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে তিনি বলেছেন - ভারতবর্ষ সব ধর্ম সমন্বয়ের দেশ তাই সব জাতি সব ধর্মকে একই সূত্রে গ্রথিত করা ও ঐক্যের কথা বলেছেন। তার বাণী জাতীয়তাবোধ উদ্বুদ্ধ করে।

দেশের সম্মান ঐক্য রক্ষা করার জন্য এবং অত্যাচারী ইংরেজের অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ ইংরেজদের দেওয়া নাইট উপাধি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন। দেশের স্বাধীনতার পথ সুগম করেন তিনি জাতীয়তাবাদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে দেশবাসীকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। তার চলার দুর্গম পথকে তিনি সুগম করে পথ চলেছেন ও চলার পথ দেখিয়েছেন। তার কবিতা হল চিরহরিৎ উপত্যকা - রবীন্দ্র কবিতায় বেঁচে থাকার জন্য হৃদপিন্ডের স্পন্দন অনুভব করি। জীবনে চলার পথ খুঁজে পাই। প্রেরণা পাই। নিজেকে প্রতিষ্ঠার রসদ খুঁজে পাই। পলে পলে ব্ধির চেতনা যুগিয়েছেন।

তার প্রেরণায় আবহমানকালের পথের নিশানা দেখতে পাই, প্রাণের পরে বসন্তের বাতাসের ছোঁয়া অনুভব করি, তিনি প্রেরণার উৎস - তার দৃষ্টিভঙ্গিতে এই বিশ্ব এক এবং অখন্ড যা বেঁচে থাকার রস হোক যোগায়।

 

“তুমি আছো হৃদয়ে মম”

সৌগত কান্ডার

 কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শারীরিক ভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন প্রায় চুরাশি বছর আগে। অথচ সে কথা কিন্তু আজও সহজে অনুভূত হয় না। আসলে আমাদের জীবনে ও মননে - সর্বত্র এবং সর্বদাই তিনি এমন ভাবে ব্যপ্ত হয়ে রয়েছেন যে তাঁর ঐহিক অনুপস্থিতি যেন আমরা অনুভবই করতে পারি না। দিন থেকে রাত, জন্ম থেকে মৃত্যু, আনন্দ থেকে শোক - সবখানেতেই তিনি সম ভাবে বিরাজমান।

যখন কোনো স্বচ্ছ সকালে সূর্যের প্রথম কিরণ স্পর্শে স্নাত হয় নীরব প্রকৃতি, তখন মনের আকাশে ভেসে আসে, “আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর”।

আবার যখন কোনো নির্ঘুম মধ্য রাতে রূপালি জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় নিস্তব্ধ চরাচর, তখন মনের আকাশে ভেসে আসে, “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো”।

আবার যখন কোনো বেদনাহত কুয়াশা ঊর্ণনাভর মত পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলে চলিষ্ণুতাকে, তখন মনের আকাশে ভেসে আসে, “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে; তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে”।

আবার যখন কোনো কূলহীন স্রোতের মাঝে হারিয়ে যায় জীবনের ছোটো ছোটো আনন্দ গান, তখন মনের আকাশে ভেসে আসে, “আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান”।

আবার যখন কোনো আঁধার রাতে কঠিন পথে কর্তব্য ছুটে যায় বাকি পৃথিবীর হিসেব উড়িয়ে, তখন মনের আকাশে ভেসে আসে, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে”।

আবার যখন কোনো চিরধ্বস্ত বৃক্ষের মূল থেকে নতুন অঙ্কুর মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায় আকাশের দিকে, তখন মনের আকাশে ভেসে আসে, “হে নূতন, দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ”।

সুতরাং তিনিই যাবতীয় প্রেরণার উৎসস্থল, তিনিই মৃত সঞ্জীবনী সুধা। জীবন যখন শুষ্কতা, রুক্ষতায় শ্লথ হয়ে পড়ে, তখন তাঁরই করুণাধারায় আবার ফিরে পাই জীবনের আনন্দগান। তিনি সর্বব্যাপী, তিনি সর্বস্পর্শী। তিনি কবি সার্বভৌম। তিনিই আমার পরম ভরসাস্থল। জানি যাই ঘটুক না কেন, আমার রবি ঠাকুর আছেন।

 

'তুমি আছো হৃদয়ে মম’

অশোক অধিকারী। 

 মহামানব আসে কোনও একটি আনুষ্ঠানিক সংগীত নয়আন্তর্জাতিকতাবাদের আলোয় সেই পুরুষের আহ্বানযিনি বলতে পারেন,“আমি তোমাদেরই লোক”অথবা“জয় হোক মানুষের  নব- জাতকের,ওই চিরজীবীতের!”আবার বলে ওঠেন নিজের দায়বদ্ধতার নিগড়ে,“এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখেদিতে হবে ভাষা;এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে/ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা” 
    তাইএবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর-শুধু অন্তরের আকুতি নয়মূল্যবোধ বর্জিত অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে রবীন্দ্রনাথকে নতুন রূপে পড়া হোককাঁচের সার্সির ভেতর থেকে যে রচনাবলী বন্দীত্বের হতাশায় কাল গোনে  তাকে বের করে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় রবীন্দ্র পাঠচক্রের আসর আমাদের বসাতে হবেবিশ্লেষিত হোক কবির গান,কবিতা প্রবন্ধের নির্যাসবর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হোক সেই অজানা রবীন্দ্রনাথকেযিনি বিশ্বাসে ভর দিয়ে বলতে পেরেছিলেন , “সাহাদের(মহাজনদেরহাত থেকে শেখদের(মুসলমান প্রজাদেরবাঁচানোই আমাদের প্রধান কাজবলেনবঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মুসলমানদেরও সঙ্গে নিতে হবেনইলে সফল হওয়া যাবে নারাজরোষে জেলে বন্দী কবি নজরুল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর‘বসন্ত’নাটিকা উৎসর্গ করলেন কবিকে। সুভাষ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত হওয়ার মুখে। রবীন্দ্রনাথ সুভাষকে ‘দেশনায়ক’ রূপে বরণ করে নিলেন অন্তরে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডে দেশজুড়ে প্রতিবাদ করতে  চাইলেন সকলকে নিয়ে।সাড়া পেলেন না গান্ধী অথবা দেশবন্ধু বা জওহরলালেরফিরে তাকালেন তিনি একা!কিন্তু এত বড় একটা জঘন্য অপরাধের প্রতিবাদ তাঁকে করতেই হবেসারারাত জেগে চিঠির ড্রাফট বানালেন৩১মে ১৯১৯ চেমসফোর্ডকে লিখলেন,“…অদ্যকার দিনে আমাদের ব্যক্তিগত সম্মানের পদবিগুলি চতুর্দিকবর্ত্তী জাতিগত অবমাননার অসামঞ্জস্যের মধ্যে নিজের লজ্জাকেই স্পষ্টতর করিয়া প্রকাশ করিতেছেবড় দুঃখেই আমি যথোচিত বিনয়ের সহিত শ্রীযুক্তের নিকট অদ্য এই উপরোধ উপস্থাপিত করিতে বাধ্য হইয়াছি যে,সেই ‘নাইট’ পদবী হইতে আমাকে নিষ্কৃতিদান করিবার ব্যবস্থা করা হয়

    আজ নিয়ত ধর্মের আস্ফালন, ধর্ম পরিচয়ে হত্যার বাহুল্য,খুন,জখম নিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে যখন মানবাত্মা ক্রন্দনে পরাহত,তখন কবিকে পূজার ছলে শুধু ডেকে যাব!যে কবি লিখতে পারেন,মানুষ যেখানে ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্নপরস্পরের সহযেগিতা যেখানে নিবিড় নয়,সেইখানেই বর্বরতা।”।‘সভ্যতার সংকট’এ লিখছেন,“মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপসে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবশুধু নীরবে নয়,সরবে ’তোমারি নাম বলব নানা ছলে/ বলব একা বসে আপন মনের ছায় তলে।’ জানি ‘তুমি আছো হৃদয়ে মম।’


এক অন্য ঠাকুরের কথা     

দীপক জানা

 প্রত্যেকের একজন গোপন ঠাকুর থাকে। এক্কেবারে গোপন। তাকে সবকিছু বলা যায়, গল্প করা যায়। তার ওপর রাগ করা যায়। আবার তাকে ছেড়ে থাকতে কষ্টও হয়। খুব কষ্ট। ছেলেটা তেমন কেউকেটা না। বংশ পরিচয়? বুক ঠুকে বলবার মতো না। তবে গোপন সুতো টেনে এগোলে বড়ো সড়ো জায়গায় যাওয়া যেতেও পারে। তবু ওসব না ভেবে সরল পথেই হাঁটা যাক।

গ্রামটা বর্ধিষ্ণু না, পাড়াটাও। লেখাপড়া? বিলাসিতা। বাবুদের ব্যাপার। এমন গ্রামে রবি ঠাকুর, সে কোন ঠাকুর কে জানে। হিন্দুদের কোনো ঠাকুর হবে। ছেলেটা ছিল খ্রিস্টান পাড়ায়। গোয়ালা হিন্দু ঘরে বাস। লেখাপড়া এখানে ছিল জাস্ট স্বপ্ন। বাবা-মা প্রাইমারি। দিনমজুর।

এ গল্পে ভাবা যাক ছড়ি হাতে এক মাস্টারমশাই। মুখভরা দাড়ি। ছাত্র-ছাত্রীদের আতঙ্ক। পড়া হোত- বর্ণপরিচয়, ধারাপাত, এ বি সি ডি। তারপর প্রাইমারিতে ভর্তি। পরিচয় হয় অন্যজগতের সাথে। পাশাপাশি কত গ্রামের কতো ছেলেমেয়ে। 'কিশলয়ে' 'বক ওড়ে সারি সারি, নীচে ছোটে রেল গাড়ি। চক দিয়ে সে আঁকলো ছবি, কবির সেরা রবি কবি।' কবি! কবিতা! রবি! ভাবতে ভাবতে....।

পঁচিশে বৈশাখ। সহপাঠিনী রীনা, দেবযানী, শম্পাদের নাচ, গান, আবৃত্তি। মায়াবন বিহারিণী, পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, আয় তবে সহচরী। সহজপাঠের  কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি, আমাদের ছোট নদী, ঐখানে মা পুকুর পাড়ে, ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি। কথা-ছবি, ছবি-কথা। সব নাকি ওই বুড়ো মানুষটার লেখা। তার আবার নাকি জন্মদিন পালন হয়। তবে না পায়েস, না কেক। ফুলে, মালায়, ধূপে, প্রদীপে। এজন্যই লোকে তাহলে ঠাকুর বলে। হয়তো ইনিও একজন ঠাকুর। শিব, কালী, দুর্গা, গণেশ, লক্ষ্মীর মতোই। হবে হয়তো। হয়তো সবাই জানে শুধু সে-ই জানে না। না, কাউকে জানানো যাবে না, নাহলে যে ওর বন্ধু ওকে মুর্খ ভাববে। তার ধারণা ও সব জানে। কিন্তু ও তো জানে ও কিছুই জানে না। বন্ধুর প্রশ্নে মনগড়া উত্তর দিয়ে মান রক্ষা করে মাত্র। কিন্তু রবি ঠাকুর?

কিশলয়ের রবি ঠাকুরকে বের করে চুপিচুপি ও ফুল দেয়। হে ঠাকুর, দেখো। কেউ যেন জানতে না পারে। আর চুপিচুপি দেখা দাও ঠাকুর, অনেক প্রশ্ন যে বুকের ভেতরে লুকোচুরি খেলছে। ছেলেটার বয়স কতো আর, পাঁচ-ছয়। চুপিচুপি দূরে চলে যায়। অনেক দূরে। উঁহু, একা তো সে যায় না, তার সাথে ঠাকুর থাকে, রবি ঠাকুর। বিশ্বাস হলোনা? বেশ। এইতো সে চোখ বুজলো। ওই তো সাদা দাড়ি, উজ্জ্বল দুটো চোখ, গভীর, গোপনতা ছুঁয়ে অনেক ভেতরের সব পড়ে নেয়। কতো গল্প, কতো কবিতায় এলোমেলো হয়ে যায়। হারিয়ে যায়। কথা বলে। তাইতো ছেলেটা বনে-বাদাড়ে, মাঠে-ঘাটে, খালপাড় ধরে চলে যায় - চলেই যায়।

একার ভেতরে একা থাকার এই এক সুখ। টান নেই, খোঁজও কম। খুঁজলে যাহোক একটা বললেই হোল। একটু একটু বাড়তে বাড়তে হাইস্কুল। রবি ঠাকুর তখন ঠাকুরবাড়ির ছেলে। কিন্তু সেই প্রবীণ বন্ধু, যে গান শোনায়, গল্প শোনায়, নাটকে, কবিতায়, আবার তার লেখা হিজিবিজির খাতায়, সংশোধনে; সেও তো রবীন্দ্রনাথ। রবি ঠাকুর। তবে কী দুই ঠাকুর আলাদা? দেবতা না হোক, বড়ো মানুষ তো? হেড স্যার তাঁর কথা বলেন, দিদিমনি, স্যারেরাও। বলেন বড়োরাও। তাহলে সেই রবি ঠাকুর তো ভীষণ বড়ো। আর ওই বুড়ো মানুষটা? সে কে? ভাবতে ভাবতে সময় হাঁটে। হাঁটে? নাকি ছোটে?

এখন আর চোখ বন্ধ করে ডাকলেও আসেনা। দিস্তা কাগজের সেলাই করা খাতাতে লেখা জমে, অথচ দেখে দেয়না কেউ। সেই কথাবলা, গল্প, কবিতায় ডুব সাঁতার, নাহ্, হয়না আর। মানুষটা আর আসে না। কষ্ট হয় ছেলেটার। কোথায় গেল সেই মানুষটা? ছেলেটা আজো তাকে খোঁজে, কাঠমল্লিকার ডালে, মাধবীলতার থোকায়, হলুদ পাখির ডানায়, লাল কৃষ্ণচূড়ায়, ভ্রমরের গুনগুন গুঞ্জরণে। নাহ্, কোত্থাও নেই। ছেলেটার সব লেখা, সব ভাবনা, সব কথা এলোমেলো হয়ে যায়। আসলে ঠাকুরকে যে পায় না খুঁজে। কোথাও না, কোত্থাও না। শুধু কানে বাজে- 'আজি হোতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছো বসি আমার এ কবিতাখানি কৌতুহল ভরে....'।

 

'তুমি আছো হৃদয়ে মম'

পুষ্প সাঁতরা

 সহজপাঠের মধ্য দিয়ে তোমার সাথে আমার পরিচয়,'ছোট খোকা বলে অ আ শেখেনি সে কথা কওয়া'।কথামালা গাঁথতে গাঁথতে বড় হয়ে ধরেছি তোমার হাত কালজয়ী সৃষ্টির কলমে।তোমার অনন্ত প্রেমে মজে ,জীবনের ধ্রুবতারা করেছি তোমাকেই ।তোমার পদতলে আশ্রয় নিয়ে জীবন কে নবীকৃত করেছি'--- চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে নিয়ো না ,নিয়ো না সরায়ে'- পদতলে বসে পেয়েছি জীবনের দীক্ষা শিক্ষা।'তোমার কাছে এ বর মাগি'-----

তোমার দৃপ্ত কলমের বৈতরনীতে নিজেকে ঋদ্ধ সমৃদ্ধ করে এগিয়ে চলেছি।জীবন যুদ্ধের পথ প্রদর্শক হয়ে শান্তির পারাপারে পৌঁছেছি! তুমি যখন মংপুতে বসে রং তুলির টানে বসন্ত নামিয়ে আনতে,সেই রং তুলিতে

মনে হয় তুমি আমার আশেপাশে আছো।তোমার কাছে জেনেছি যথার্থ দোসরের সংজ্ঞা।সূর্যের মত দীপ্তিমান রবীন্দ্রনাথ অনির্বচনীয় কলমের মাধুরীতে প্রবন্ধ, গান,কবিতায়,তাঁর দৃপ্ত প্রকাশ।টালমাটাল দিনে তোমার গানে পেয়েছি বাঁচার আশ্বাস। 'বারতা পেয়েছি মনে মনে ,গগনে গগনে তব নিশ্বাস পরশনে'জীবনের শোক দুঃখেও দিশাহারা না হয়েও গান গেয়েছেন, সুরে,কথায়,দর্শনে সহজতায়--- রবীন্দ্রনাথ চিনিয়ে দিয়েছেন 'গানের ভিতর আছে আমার ভুবন খানি'।জীবনের পথ কখনও দুর্গম,মসৃন কখনও বা বন্ধুর, সে পথ চিনে চিনে এগিয়ে চলাই জীবন তাই রবীন্দ্রনাথ গাইলেন, 'আমার পথ চলাতেই আনন্দ / খেলে যায় রৌদ্রছায়া বর্ষা আসে বসন্ত '-- সারা জীবন রিক্ত হয়েছেন, তবুও জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারান নি।রবীন্দ্রনাথ ই বলতে পারেন ''যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর'? আসলে রবীন্দ্রনাথ হৃদয় ঘরের রাজা।মনের গোপন রক্ত ক্ষরণে মুক্তির দিশারি ! নিথর নিস্তরঙ্গ

দিঘি বুকে একান্ত প্রিয়জন। তুমি আমার চেতনা,প্রজ্ঞা,প্রেরণা ও ইষ্টদেবতা'---'তুমি আছো  হৃদয়ে মম'

 

"তুমি রবে নীরবে" রবির প্রতি . .

দীনেশ মন্ডল

 আকাশ ভরা সূর্য তারা . . . . . । হিয়ার মাঝে দেখে ছিলেম . . . . . . । দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে . . . . .  । প্রতিটি কথা, প্রতিটি ছন্দ, সুর,মর্মার্থ, কোনো এক গোপন শক্তি আঁধার হতে নিক্ষিপ্ত হয়ে আত্মার অন্তস্থলে কখনো কোমল শীতল সমিরণের আস্তরণে আচ্ছাদিত করে রাখে । কোনো রচনায় অতি সুন্দর বাল্যকালের আত্মভোলা প্রকৃতির বর্ণনা, কোথাও যৌবনের আবেগপ্রবণ অতি উচ্ছ্বাস পূর্ণ জলোচ্ছ্বাসের  মতো বিগলিত ধারা--- তিনিই রবীন্দ্রনাথ । যার সৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে পড়ন্ত গোধূলির করুন দৃষ্টিসম জীবনের অপর প্রান্তের নীরব প্রতিধ্বনি , সে-ই ভানু সিংহ । তার দানপাত্রের অকৃত্রিম সৃষ্টিতে, পরমাণু সম অপূর্ণতা নেই লেশমাত্র, তিনিই রবি ঠাকুর । তাইতো তাঁর সৃষ্টির উৎসে ছোট গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, সমস্ত কিছুতে এক স্বপ্নাতীত বৈচিত্র্যতায় সূর্যালোকের আলোকের মতো আত্মপ্রকাশিত হয়ে স্থির দণ্ডায়মান স্ট্যাচুসম  ধরায় বিদ্যমান । তাইতো আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়, "মোর বীণা ওঠে" . . . .  . " আমারো পরানো যাহা চায় . . . . .  "দিবস রজনী আমি . . . . .  বর্ষার ক্ষণে প্লাবন ধারায় বইয়ে দেয় কখনো শূন্য হৃদয় । আবার কখনো শরতের বিক্ষিপ্ত পুঞ্জিভূত মেঘের মাঝে অর্ধফোটা কুঁড়ির মৃদুমন্দ আবাহনী সংগীত । কখনো হেমন্তের মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ধারা, খুঁজে পায় প্রত্যুষের আলোর মতো একরাশ নবরূপের সৃষ্টি । সেই রবির কিরণের আভায় আবার প্রস্ফুটিত হয়, ঝর্না ধারার মতো আড়ষ্টতাহীন পূর্ণ চিত্তের উদ্বেলিত আনন্দ ধারার গান  "পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে" . . . . সে'ই আন্নাকালী পাকড়াশী । নব বসন্তের হৃদয় দ্বারে যখন মৃদু ছোঁয়ায় বলতে চায়,  "নিল দিগন্তে ওই"  . . . . .  "বসন্ত এসে গেছে" . . . . .  "ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে . . . . . "আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে . . . . . . সে যেনো এক চিরন্তন  নবরূপের সৃষ্টিরহস্য ,কখনো গোপন, কখনো প্রকাশিত, ওই ঐন্দ্রজালিক বিগলিত ধারা । তারা খোচিত নীল নীলিমায় যখন ২৫ শে বৈশাখের দাবদাহে উন্মোচিত হয়ে আত্মপ্রকাশ হল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।  সে যেন অকাল বর্ষণের দামামার ধ্বনী । বাংলা ভাষার অপূর্ব গৃহালয়ে অনন্ত বিচিত্র পুষ্প সজ্জিত হয়ে বীর দর্পে আবির্ভূত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সে যেন রক্তিম লাল পলাশের ছোঁয়া, অন্তরের অন্তস্থলে, লিলি, কামিনী, শিমুল,  হাসনুহানার প্রেমের পরশ । "আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি". . . . .  হয়তো না চাইলেও ফিরে যাবো । তাইতো নিরব অশ্রুতে বলতে হয়, "যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে . . . . . . 


আমার রবীন্দ্রনাথ

নীলোৎপল জানা


        বাঙালির দুর্ভাগ্য যে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে মৃত্যুর পর আরো চুরাশি বছর কেটে গেল ,তবুও সন্দেহ এখনো বুঝতে পেরেছে কিনা !তাই যদি হতো রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তীতে সকালে চার-পাঁচটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর মাইকে হিন্দি লারেলাপ্পা গান বাজত না। আসলে রবীন্দ্রজন্মদিন-পালন আসল উদ্দেশ্য নয়, বাড়িতে বাড়িতে ছুটির মেজাজে মদ ও মাংসের উৎসব পালন।নতুন প্রজন্ম কী শিখবে? এই যদি অবস্থা হয় তবে আমি নিশ্চিত, বাঙালি হৃদয়ের মুক্তি ঘটতে আরো পাঁচশো বছরেও সম্ভব কিনা জানি না। যাই হোক এসব ক্ষোভের কথা। অনেকেই আত্মপক্ষ সমর্থনে আমার বক্তব্যকে খন্ডন করবেন ।

        সত্যি কথা বলতে রবীন্দ্রনাথ কি বুঝতে পারি কলেজে পড়ার সময়। বাড়িতে বাবাকে দেখতাম প্রত্যহ ছুটির দিনে যখন বিশ্রাম নিতেন তখন মাথার কাছে রেডিও রাখতেন আর কলকাতা ‘ক’তে রবীন্দ্রসংগীত শুনতেন। তখন আমার মনে হতো এসব কি শোনেন বাবা। কিন্তু বাবাকে কিছু বলার মত ক্ষমতা আমার কেন, বাড়ির কারোরই ছিলনা ।অগত্যা বাবার কাছে দুপুরে ঘুমোতে হত গান শুনতে শুনতে।বাবা যখন বাড়িতে কোনো হালকা কাজ করতেন ,শুনতাম একটি গান বাবার মুখে- ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’। তখন কিছুই বুঝতাম না ।পরবর্তী সময়ে কলেজে পড়তে বা আরো পরে যখন রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে পারলাম, জানলাম রবীন্দ্রনাথ শুধু মানুষ নয় ,একজন জীবন্ত দেবতা ।তিনি এমন একজন  মানুষ, যাঁর হাত ধরে দুঃখের সমুদ্র যেমন পাড়ি দেওয়া যায়, তেমনি আনন্দের-সাগরেও ভেসে যাওয়া যায়। তিনি পরবর্তী সময়ে আমার সমগ্র চেতনাকে আচ্ছন্ন করে আছেন। যতবার ‘সোনার তরী’ ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ‘ভারততীর্থ’ কবিতা পড়ি, ততবারই আমার চেতনার নবজন্ম ঘটে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতি রচনা করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ আমার ঈশ্বর, আমার শ্রেষ্ঠ কবি। জীবন ও মৃত্যুর  মধ্যে যে কবি সেতু রচনা করেছেন, তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি আজ বড় প্রাসঙ্গিক ।তাঁকে বাদ দিয়ে বাঙালির জীবন বিবর্ণ ।

          তখন রবীন্দ্রভারতী তে পড়ি। এক সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছি, বাস থেকে নেমে ৪-৫ মিনিটের হাঁটা পথ ।এমন সময় মেঘ কালো করে বৃষ্টি নামল। অগত্যা রাস্তার পাশে বাড়ির খোলা বারান্দায় দাঁড়াতে হয়। নির্জন পথ ঘাট। বাজ পড়ছে মুহুমুহু ।সদ্য গ্রাম থেকে যাওয়া ছেলে ,তখও শহরের আলোর রোশনাইতে ভাসতে শিখিনি। এমন সময় ঘরের রেডিও থেকে ভেসে আসছে শুনেছিলাম –

                           ‘গোধূলি গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা

                            আমার যা কথা ছিল, হয়ে গেল সারা…।

                                        ……………………

                            আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে---

                             জনমের মত হায়, হয়ে গেল হারা

                                         হয়ে গেল হারা।

                             গোধূলি গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা।

                                       

 এই গান কার গলায় বলতে পারব না, তবে গানের প্রতিটি অক্ষর আমাকে স্নান করিয়ে দিয়েছিল ।সেই স্নান বৃষ্টির জলে নয়, চোখের জলে। আমি অবাক হয়েছিলাম,এত কান্না কি আমার! সেদিন সমগ্র প্রাণ-মন অধিকার করেছিল রবীন্দ্রনাথ ,আমার ঠাকুর। আজও তাই । তাই কবি রবীন্দ্রনাথ আমার সঙ্গী, ‘পরাণ সখা বন্ধু’। বর্তমান বাঙালি তথা বিশ্বের মুক্তির একমাত্র পথ রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তাই বড়ই প্রাসঙ্গিক।

                                                                                                কবিতা


পঁচিশে বৈশাখ

অমিত কাশ‍্যপ

 

দেওয়ালের গা বেয়ে যখন সকালের রোদ নামে

আমি চমৎকার হয়ে উঠি

আমার ভেতর তখন কোনো অসন্তোষ থাকে না

এলোমেলো রাতের স্বপ্ন ছিঁড়ে যাবার চিহ্ন

তাও কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যায়

 

পবিত্র ভোর এক, তুমি গুনগুন করে

'ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে', ঘরে আস

কেমন এক সুবাস যেন, তোমার শরীর জুড়ে

বারান্দায় এসেই বল, এই দেখ, প্রভাতফেরি

আজ পঁচিশে বৈশাখ, তোমার খেয়াল ছিল না

 

রবীন্দ্রনাথ

নিমাই মাইতি

 

এক নক্ষত্রের আলোয়

পৃথিবী জেগে আছে এখনো

শিশির ভেজা শান্ত সৌম্য

শীতল পরিপাটি দর্শন-ও।

 

ক্ষণ জন্মের অন্তরালে

যে দ্বীপ জ্বেলে গেছ মননে

সে আলো নেভাতে পারেনি কেউ

রয়েছে ঘরে ঘরে যতনে।

 

তুমি মানুষের মহাধা

এক জাতির পথসাথী আজ-ও

চিনিয়ে দিলে সাম্য সুন্দর

বিস্ময় যুগে যুগে বিরাজ-ও।

 

হারমোনিয়াম

উত্তম বেহারা

 

বিশ্বাস ছিলো

জলের ভেতর

শীতের প্রথম রোদ্দুরে

পাখিদের না গাওয়া হারমোনিয়ামে

রক্তবমি না হওয়া শুভ সন্ধ্যায়

 

 

আমাদের  আরো যা যা বিশ্বাস ছিলো

তা সব কিছু ------

তোমাকে না ছাড়িয়ে.....

কর্কটক্রান্তি আর তোমার ইশারায় ঝুলতে থাকা

শূন্য  জানালার  ফাঁকে 

 

ঠাকুর

কবিতা সামন্ত

 

কোন প্রতিবেদন নয়।

একটা মানুষ পুরো একটা জাতির গর্ব।

কখনোবা মনে হয় আমাদের পূর্বপুরুষ।

কোথায় সেই মানুষটা নেই?

শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার অন্তরেই বিরাজমান।

শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসা প্রত‍্যেকটা মানুষ।

শান্তিনিকেতনর প্রতিটা শ্বাসে প্রশ্বাসে বসবাস তার।

দেওয়ালে টাঙানো ছবি কখন যে ঠাকুর হয়ে গেল,

কখন যে ধুপ জ্বেলে প্রণাম করতে শিখেছে সবাই।

এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

কারণ কোন পাথরের মন্দিরে সজ্জিত নয়।

হৃদয়ের কোণায় কোণায় তেনার মূর্তি পুজিত।

দুই পাতার জন্য

 

একাধারে রবীন্দ্রনাথ

ননীগোপাল জানা

 

ভাবনার ভেলায় বোঝাই সোনার তরী

 চেতনায় মহান ঋষির দর্শন।

" আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে"

 বিরাজিত ভাব সাগরের কবি রবীন্দ্রনাথ ।

ভারতে -বিশ্ব,  বিশ্বভারতীর রূপকার ।

হাতে "সহজপাঠ ""গীতাঞ্জলি"

 কণ্ঠে ভরা গান

"ও আমার দেশের মাটি"

"তোমার অসীমে"

সীমার মাঝে অসীম সমর্পিত প্রাণ।

 চির অম্লান মহান রবীন্দ্রনাথ।

 

দীর্ঘশ্বাসের পাশ দিয়ে

গোবিন্দ বারিক

 

প্রকৃতি সাজিয়েছে দুয়ার, বৈশাখ। শূন্যতার মাঝেও জেগে উঠে কোকিল বাঁশির মতো

ভাবায় আমাদের ।

এই যে চারিদিকে যুদ্ধ-যুদ্ধ রব । গোলাবারুদের আয়োজন, রক্তলেখায় বৈসারন। নীরবতার ভিতর অপেক্ষা; প্রতীক্ষার ভেতর সন্ত্রাস, ধর্মের নামে পৈশাচিক উল্লাস

 

 হৃদয়ের কথাগুলো বলা হলো না আর ...

 

বিরহের গানের ভেতর বয়ে চলেছে দগ্ধ সিন্ধু--- অমৃত পাণি, অশনির ডাক। পায়ে-পায়ে সন্ত্রস্ত্র অন্ধকারে বিষন্ন ক্লান্তির সুরেও রবি।

দীর্ঘশ্বাসের পাশ দিয়ে পাইনের ঘন বনে বনে

সমস্ত ঋণ ছড়িয়ে দিয়েছে খচ্চরের সহিস

 

তবুও একেলা বাবলা গাছে ঝিঁ ঝিঁ গ্রীষ্ম

ও রবীন্দ্রনাথ,পাগলপারা, রক্ত শ্রম বারিধারা

 

প্রভু আমার 

মালা ঘোষ মিত্র

 

২৫-শে বৈশাখ এলেই ,

মা সকাল-সকাল

ফুলে ফুলে কবিগুরুকে সাজাতেন ;

আমরা সবাই নাচগান,

কবিতায় দিনযাপনে ব্যস্ত

আনন্দ মুখরিত দিনে

উঠোনের এক কোণে বসে,

কবিগুরু আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসতেন

আজও প্রত্যুষে উঠে

উৎসবের আয়োজন করি

এক নিবিড় ভালোবাসায়।

আমার ঘরের চারিদিকে রবীন্দ্রনাথ,

যাকে দুঃখে-সুখে নিত্যসঙ্গী করি

সেই কবিগুরু----

যিনি সামনে এসে পথ দেখান।।

 

==========================================

পত্রিকাটি পড়ার শেষে LIKE ও কমেন্ট করতে ভুলবেন না।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ