অণু-প্রবন্ধ
পয়লা বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ
সিদ্ধার্থ সিংহ
হিসেব অনুযায়ী বাংলা অব্দ হাজার দেড়ের বছরের পুরনো হলেও এটা কিন্তু উৎসবের
রূপ নিয়েছে এ দেশে ইংরেজ আসার পর থেকে। পলাশি যুদ্ধের পরে ইংরেজদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র
হয়ে ওঠে কলকাতা। তখন জীবিকার সন্ধানে গ্রামগঞ্জ থেকে দলে দলে লোকেরা আসতে থাকেন এই
শহরে। গড়ে উঠতে থাকে দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য। বাঙালিরাও উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁরাও
হয়ে উঠলেন পাক্কা ব্যবসায়ী। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে, ইংরেজদের বদান্যতায় হয়ে উঠলেন
জমিদার।
এই সময় বাঙালিবাবুরা তাঁদের ‘প্রভু’ ইংরেজদের ইংরেজি বছরের শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বরের
মধ্যরাত থেকে হই-হল্লোড় করে ‘নিউ ইয়ার’ পালন করতে দেখে, উৎসাহিত হন। এবং তাঁদের অনুকরণ
করেই বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে নাচ-গানের মজলিস বসাতে শুরু করেন।
ওই সব আসরে আসতেন বাগবাজার, শোভাবাজার, পাথুরিয়াঘাট, জোড়াসাঁকো, চোরবাগান থেকে ফুলবাবুরা।
চুনট করা ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবি আর সারা গায়ে আতর মেখে। ঘোড়ায় টানা টমটমে চরে।
রাজসিক খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে চলত কালোয়াতি গান, কোথাও কোথাও হত বাঈজির নাচ। সেই সব বাঈজিদের আনা
হত শুধু বাংলা নয়, বাংলার বাইরে থেকেও। কে কোন নামজাদা খানদানি বাঈজিকে আনতে পারেন,
সেই নিয়েও চলত রেষারেষি।
কেউ কেউ বলেন, সে যুগের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র
গুপ্তই নাকি ছিলেন এই নববর্ষের মোচ্ছবের মূল হোতা। তিনি নাকি বাংলা নতুন বৎসর উপলক্ষ্যে
সংবাদ প্রভাকরের আলাদা একটা বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করতেন।
যদিও বাংলা সন বা অব্দ, যাকে বলে--- বঙ্গাব্দ, সেটা যে কে প্রথম চালু করেছিলেন
এবং কবে থেকে তা বলবৎ হয়েছিল, তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে।
সাধারণত কোনও রাজা বা সম্রাটের রাজ্যাভিষেকের দিন, কিংবা তাঁর কোনও বড়সড় জয়ের
কীর্তি, অথবা কোনও ধর্মীয় নেতার জন্মগ্রহণ, নয়তো তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ঘটনাকে স্মরণীয়
করে রাখতে অব্দের প্রচলন হয়। যেমন যিশুখ্রিস্টের জন্মকে কেন্দ্র করে গণনা করা হয় খ্রিস্টাব্দ,
বা হজরত মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার সময় অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই
থেকে গণনা করা হয়--- হিজরি অব্দ।
এই ভাবেই এক সময় এই দেশে রমরম করে চালু হয়েছিল বুদ্ধ নির্বাণ--- বুদ্ধাব্দ,
মহাবির নির্বাণ--- মহাবীরাব্দ, ভাস্করাব্দ, শকাব্দ, শঙ্করাব্দ, চৈতন্যাব্দ, কলাব্দ, বার্হস্পত্যবর্ষ, বিক্রম সংবৎ-এর মতো বহু
অব্দ। যদিও চালু হলেও তেমন ভাবে ব্যবহার না হওয়ায় কালের নিয়মে তা ধীরে ধীরে ব্রাত্য
হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে একমাত্র টিকে আছে--- শকাব্দ। ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জি বলেই হয়তো!
কারও কারও মতে, সপ্তম শতাব্দীর বাংলার প্রথম দিকের রাজা শশাঙ্কই প্রচলন করেছিলেন বঙ্গাব্দের।
যদিও এর স্বপক্ষে তেমন কোনও জোরালো ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর তিনি যদি
প্রচলন করেও থাকেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু সেই বর্ষ গণনাও অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল।
ইতিহাস ঘেঁটে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেটা হল--- সম্রাট আকবর তাঁর জ্যোতির্বিদ ফতুল্লাহ
সিরাজিকে একদিন আদেশ দিয়েছিলেন, ইসলামিক চন্দ্র ক্যালেন্ডার আর হিন্দু সৌর ক্যালেন্ডার---
এ দু'টিকে মিলিয়ে মিশিয়ে নতুন একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করার জন্য। কারণ, তখন হিন্দু আর মুসলিম ক্যালেন্ডারের মধ্যে বারো
দিনের একটা ফারাক ছিল। সে জন্য বাঙালিদের কাছ
থেকে কর সংগ্রহ করতে নানা সমস্যা হত। এর ফলে, ওই দুটো ক্যালেন্ডারকে মিশিয়ে ফতুল্লাহ
সিরাজি যে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি করলেন, তার নাম রাখা হল--- ফসল-ঈ-শান। অর্থাৎ,
ভাল ফসলের বৎসর। প্রথমে ওই নামে সনটিকে অভিহিত করা হলেও পরে তা আস্তে আস্তে ‘বঙ্গাব্দ'
নামেই পরিচিত হয়। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, যে যা-ই বলুক না কেন, আসলে সম্রাট আকবরের
সময় থেকেই বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছিল।
তখন এত চ্যানেল ছিল না। সাকুল্যে একটাই চ্যানেল, তার নাম--- দূরদর্শন। এই দূরদর্শনই
অন্যমাত্রা যোগ করেছিল পয়লা বৈশাখে। কলকাতা শাখা শুরু করেছিল--- নববর্ষের বৈঠক। কোন
শিল্পী আসেননি সেখানে? শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটা এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, লোকের
মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এই অনুষ্ঠানের কথা। সকাল হলেই লোকে সব কাজ ফেলে বসে পড়তেন
টিভির সামনে।
তারও অনেক আগে হাজরা মোড়ের বসুশ্রী সিনেমার মন্টু বসু পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে
বসুশ্রী হলে শুরু করেছিলেন বৈশাখী অনুষ্ঠান। তার টিকিটের জন্য আগের দিন রাত থেকেই লম্বা
লাইন পড়ে যেত। একটা টিকিটের জন্য সে কী হাহাকার।
তবে এই বাংলা নববর্ষের সব থেকে বড় প্রাপ্তি হল--- বাংলা বর্ষপঞ্জি। মানে পঞ্জিকা।
অন্যান্য প্রচলিত অব্দগুলোর মতো বঙ্গাব্দেও বারোটি মাস আছে। কিন্তু দিনের সংখ্যাগুলো
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মতো নির্দিষ্ট নয়। কারণ, তিথি নক্ষত্রের সময় অনুসারে বাংলার বিভিন্ন
মাসের দিনের সংখ্যা বদলে বদলে যায়। কোনও মাসের দিনের সংখ্যা কখনও ২৯, কখনও ৩০, কখনও
আবার ৩১। কখনও কখনও সেটা বেড়ে ৩২-ও হয়ে যায়।
আসলে বিভিন্ন মতের এই পঞ্জিকাগুলোর রূপকার ছিলেন প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্যোতিষীরা।
তাঁরা মূলত চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, দিন-রাতের চুলচেরা হিসেব কষে বিভিন্ন
রকমের তথ্যের ওপর নির্ভর করে নানা রকম সিদ্ধান্ত লিখে রাখতেন। আর তার ওপরেই ভিত্তি
করে তৈরি হত পঞ্জিকা।
কবে থেকে বাংলায় পঞ্জিকা শুরু হয়েছিল বহু চেষ্টা করেও তার হদিশ পাওয়া যায়নি।
তবে এটুকু জানা যায়, অনেক অনেক বছর আগে হাতে লেখা পঞ্জিকার চল ছিল। কোনও কোনও গবেষকের
মতে, সব থেকে প্রাচীন বেদাঙ্গ জ্যোতিষ পঞ্জিকা নাকি সংকলিত হয়েছিল ১৮৫০ খ্রিস্টপূর্বে।
পরে হাতে লেখা পঞ্জিকা শুরু হলেও সেটা ব্যবহার করার অধিকার এবং সামর্থ--- কোনওটাই সাধারণ
লোকের ছিল না। ধরা-ছোঁয়া তো দূরের কথা, চোখের দেখা, দেখারও অধিকার ছিল না নিম্নবর্ণের।
একমাত্র রাজা, মহারাজা, জমিদার বা ওই রকম অভিজাত
শ্রেণি কিংবা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরাই কেবল ব্যবহার করতে পারতেন সেই পঞ্জিকা।
এই পঞ্জিকা অনুসারেই সমস্ত ব্যবসায়ীরা বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে শুভদিন মনে
করে আগের বছরের যাবতীয় হিসেব-নিকেশ বছরের শেষ দিনটিতেই চুকিয়ে দিতেন। এবং বছরের প্রথম
দিন থেকে নতুন করে লেখা শুরু করতেন খাতা। যাকে বলা হয়--- হালখাতা। রাত থাকতে দীর্ঘ
লাইন দিয়ে কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে সেই খাতা নিয়ে ভক্তিভরে পুজো দিতেন।
এখন অবশ্য আর চিরাচরিত ঐতিয্যবাহী লাল শালু কাপড়ে মোড়া খাতা নয়, তার জায়গায়
অনেকে ল্যাপটপ নিয়েও পুজো সারেন। নিমন্ত্রিতরা এলেই তাঁদের হাতে ডাবের জল, লস্যি কিংবা
ঠান্ডা পানীয় তুলে দেন। তুলে দেন মিষ্টির প্যাকেট এবং অবশ্যই সব চেয়ে লোভনীয়, পঞ্জিকার
মিনিয়েচার--- বাংলা ক্যালেন্ডার।
এই উপলক্ষ্যে বইপাড়ায় থাকে সাজো সাজো রব। শুধু বড় বড় প্রকাশকেরাই নন, ছোট,
তস্য ছোট প্রকাশকেরাও প্রকাশ করেন একের পর এক বই। যদিও বইমেলা রমরম করে শুরু হওয়ার
পরে পয়লা বৈশাখে বই প্রকাশ করার রীতি এখন অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তবু এ দিন প্রকাশকদের
দফতরে দফতরে দেখা যায় কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের ডমজমাটি ভিড়।
এক সময় বাংলা বছরের শুরুয়াতের দিনে নতুন জামাকাপড় পরার একটা অলিখিত রীতি ছিল।
সেই রীতি পালন করার জন্য, যাদের আর্থিক অবস্থা অতটা সচ্ছ্বল নয়, তারাও বৈশাখ মাসের
আগে, গোটা চৈত্রমাস জুড়ে চলা সেল-এ তুলনামূলক ভাবে সস্তায় জামাকাপড় কিনে রাখতেন।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, সেই স্টক ক্লিয়ারেন্সের বাজারও কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই।
একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারণ, বিভিন্ন ব্র্যান্ড আজকাল কোনও উৎসব-উপলক্ষ্য ছাড়াই
নানান ওয়েব সাইডের মাধ্যমে সারা বছরই এত বেশি ছাড়ে পোশাক-আশাক বিক্রি করে, শুধু বিক্রিই
করে না, একেবারে বাড়ি অবধি পৌঁছে দেয়, এবং তার গুণগত মান এত ভাল আর তার ডিজাইনও এমন
চোখ ধাঁধানো যে, কেউ আর চৈত্রসেলের জন্য বসে থাকে না।
আগে এই দিনেই একেবারে আলোর রোশনাইয়ে ঝলমল করত চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। গ্রামগঞ্জ
থেকে নায়েবরা এসে আগাম টাকা দিয়ে বুক করে যেতেন নতুন এক-একটা পালা। এই একদিনেই এত টাকার লেন-দেন হত যে, যাত্রাদলগুলোর প্রায় সারা বছরের
খরচা উঠে যেত। এ দিন পালাকারদের বরাদ দেওয়া হত নতুন পালা লেখার। টানা এক বছরের জন্য
চুক্তিবদ্ধ হতেন যাত্রাপালার রথী-মহারথী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সবাই নজর রাখতেন কোন
অপেরায় রুপোলি পর্দার কোন তারকা নাম লেখালেন।
কিন্তু এখন! সরকারি উৎসব বাদ দিলে আর কোথায় হয় একটানা সাত দিন, দশ দিন ধরে যাত্রাপালা!
বিভিন্ন চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো গিলে নিয়েছে বাঙালিদের সেই সব সোনালি দিন।
এক সময় এই পয়লা বৈশাখেই বেশির ভাগ বাংলা ছায়াছবির
শুভ মহরত হত। এখনও হয়। তবে তা একেবারেই হাতে গোনা। সেটাও যে কত দিন চলবে কে জানে!
শুধু এ দেশেই নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি কলোনি আছে, সেখানেই পয়লা বৈশাখ উৎযাপনের
ধুম চোখে পড়ে। সেটা সিডনি হোক কিংবা লস ভেগাল। আমেরিকা হোক কিংবা লন্ডন। তবে সব চেয়ে
বেশি চোখে পড়ে বাংলাদেশের লোকজনদের উৎসাহ।
ওখানকার বিভিন্ন জেলা-উপজেলার স্কুল-কলেজে সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় বর্ণাঢ্য
শোভাযাত্রা, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর যেহেতু ওটা নদীমাতৃক দেশ, তাই বিভিন্ন
জেলায় এই উৎসবের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে উঠেছে নৌকো বাইচ প্রতিযোগিতা। জেলা-উপজেলার দেখাদেখি
তার রেশ এসে পড়েছে শহরতলি তো বটেই, এমনকী খোদ শহরেও। বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকার হাতিরঝিলেও
এ দিন আয়োজন করা হচ্ছে নৌকা বাইচের।
তবে মুন্সিগঞ্জের সেই বিখ্যাত ঘোড়ার দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, পায়রা ওড়ানো, বহুরূপীর
সাজ, মোরগের ঐতিয্যবাহী লড়াই আগের মতো আর হয় না। যেটুকু হয় তা উল্লেখ করার মতো নয়।
তার জায়গায় এখন আয়োজন করা হচ্ছে অন্য রকম নতুন নতুন মনোজ্ঞ প্রতিযোগিতা।
আর শহরের কথা বলতে গেলে সবার আগে বলতে হয় ঢাকার রমনার বটমূলের কথা। জায়গাটা
বটমূল নামে পরিচিত হলেও আসলে যে গাছের তলায় মঞ্চ তৈরি করে অনুষ্ঠান হয়, সেটা কিন্তু
বটগাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছের তলায় খুব
ভোরে ছায়ানটের শিল্পীরা একসঙ্গে গান গেয়ে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান করেন। সেই আবাহনের
সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় বর্ষবন্দনা।
এর পাশাপাশি রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকেশ্বরী
মন্দির, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর-সহ গোটা নগর জুড়ে চলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সর্বত্র বসে বৈশাখী মেলা। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের
পায়রাবন্দ, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেটের জাফলং, বরিশালের ব্যাসকাঠি,
টুঙ্গিপাড়া, মমুজিবনগরের মেলা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই সব মেলায় আর পাঁচটা মেলার মতো বাচ্চাদের খেলনা, মেয়েদের সাজার জিনিসপত্র
পাওয়া গেলেও মূলত থাকে কৃষিশিল্প, কারুশিল্প, লোকশিল্প, কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প।
সার্কাস, নাগরদোলার পাশাপাশি মঞ্চ আলো করে
থাকে যাত্রা, পালাগান, কবিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গান, লোকসঙ্গীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাচিয়ালি। পরিবেশিত
হয় লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণের আখ্যান। বাদ যায় না পুতুল নাটকও। তাই এটাকে
কেউ কেউ বৈশাখী মেলা না বলে সর্বজনীন লোকজ মেলাও বলেন।
এই দিন ঘরে ঘরে সকাল থেকেই চলে খই, মুড়ি,
বাতাসা খাওয়ার ধুম। দুপুরে থাকে পান্তাভাতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, কাঁচামরিচ,
মানে লঙ্কা, আর জিভে জল আনা ইলিশ মাছের নানা রকম পদ। এ দিন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কিন্তু
ইলিশ মাছ মাস্ট। সঙ্গে থাকে রসগোল্লা। এই মেনুই এখন নববর্ষ উৎযাপনের একটা ওতপ্রোত অঙ্গ
হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে।
এ দিন বাংলাদেশে এত ইলিশ মাছ বিক্রি হয় যে,
২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলগুলো দেশের বড় বড় ইলিশের আড়ৎ ও পাইকারি বাজার থেকে সরাসরি
সম্প্রচার করে জনগণকে জানিয়ে দেয় ইলিশের সেই মুহূর্তের বাজার দর।
এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষঙ্গর আয়োজনে হাজার হাজার নারী-পুরুষ
ঘটা করে পা মেলান বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রায়। হাতে হাতে থাকে বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী
শিল্পকর্ম। বাংলার ঐতিয্যবহনকারী বিভিন্ন রকমের কুলো, নানান রঙের মুখোশ, বিভিন্ন প্রাণীর
প্রতিকৃতি। এই শোভাযাত্রা গোটা পৃথিবী জুড়ে এতটাই সাড়া ফেলেছে যে, ২০১৬ সালের ৩০
ডিসেম্বর ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিয্য' হিসেবে ঘোষণা
করেছে।
ঢাকার সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুকরণে ইদানিং
কলকাতাতেও শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যাদবপুরের সুকান্ত সেতু থেকে ঢাকুরিয়া অবধি।
এই পদযাত্রার আয়োজন করছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা কলকাতা'। কলকাতার বাংলাদেশ হাই কমিশনও বেশ
কয়েক বছর ধরে ঘটা করেই আয়োজন করছে মঙ্গল শোভাযাত্রার।
পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে কোনও বছর ১৪ এপ্রিল আবার কোনও
বছর ১৫ এপ্রিল নববর্ষ পালন করা হলেও বাংলাদেশে কিন্তু তা হয় না। ওখানে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি
অনুসারে প্রত্যেক বছর ১৪ এপ্রিলই নববর্ষ পালন করা হয়। আসলে আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে
বাংলা আকাডেমিই এই দিনটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলাদেশের কেউ অবশ্য
পয়লা বৈশাখ বলে না, বলে--- পহেলা বৈশাখ।
এই পহেলা বৈশাখে শুধু কঁচিকাচারাই নয়, অনেক বড়রাও ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে দল বেঁধে
নেমে পড়েন ঘুড়ি ওড়াতে। কেবল রং-বেরঙেরই নয়, নানান মাপের এবং বিচিত্র সব আকারের ঘুড়ি।
ওড়ানোর পাশাপাশি চলে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতাও। তাই সাত দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে
যায় সুতোয় মারকাটারি মাঞ্জা দেওয়ার প্রস্তুতি।
এই নববর্ষকে আহ্বান করার জন্যই সাফসুতরো করা হয় ঘরবাড়ি। লেপা হয় মাটির ঘরদোর।
পোকামাকড়ের উৎপাত বন্ধ করার জন্য গোয়ালঘরে দেওয়া হয় বিষকাটালির ধোঁয়া। চলে নানা পুজোপার্বণ।
গ্রাম-তস্যগ্রামের আদিবাসীরা নাচগান আর মহুয়া পানের মধ্যে দিয়ে মেতে ওঠেন এই উৎসবে।
চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ উপলক্ষ্যে বছরের শেষ দু’দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিন---
মোট এই তিনটি দিনকে ঘিরে পার্বত্য জেলা--- রাঙামাটি, বান্দারবন আর খাগড়াছড়িতে শুরু হয় পাহাড়িদের সব
চেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’।
এই উৎসবকে ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমারা ‘বিজু’ বললেও
গোটা পাহাড়ি অঞ্চলে এটা কিন্তু ‘বৈসাবি' নামেই পরিচিত। বৈসুক, সাংগ্রাই আর বিজু---
এই নামগুলোর অদ্যক্ষর নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘বৈসাবি’। এই উৎসবের মূল উদেশ্যই হল, পুরনো
বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া।
নববর্ষের দিন মারমা জনগোষ্ঠী আয়োজন করে তাদের বহু পুরনো--- পানি খেলা। পানি, মানে জলকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে নিয়ে মারমার
তরুণ-তরুণীরা জল ছিটিয়ে সবাইকে পবিত্র আর শুদ্ধ করে দেয়। পাহাড়িদের মধ্যে এই পানি
খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি উৎসব। পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান একদিনের হলেও
সেটায় যাতে কোনও খামতি না থাকে, সে জন্য সারা চৈত্রমাস ধরেই চলে তার তোড়জোড়। গোটা
বাংলাদেশ জুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে যায়।
এই বৈশাখ মাসের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে চৈত্রসংক্রান্তি। গাজন উৎসব।
চরকমেলা এবং সঙ সেজে নগর পরিক্রমা।
সব স্তরের সবাই যখন এই উৎসবের আঁচ পুরোপুরি ভাবে উপভোগ করছে, তখন পিছিয়ে নেই
খেলাধুলোর জগৎও। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের মতো বড় বড় ক্লাবগুলো তাদের খেলার মাঠে এ
দিন রীতিমত পূজারি এনে ঢাকঢোল পিটিয়ে, মন্ত্রপাঠ-টাঠ করিয়ে বার পুজো করে। যে ‘বার'
বা গোলপোস্ট দিয়ে বল ঢুকলেই নির্ধারিত হয়ে যায় হার বা জিত। বছরের এই প্রথম দিনে ক্লাবের
কর্মকর্তা থেকে খেলোয়াড়রা, এমনকী সাপোর্টাররাও সবাই মিলে কামনা করেন সারা বছর যেন
তাঁরা গোল দিতে পারেন। আর অন্যদের গোল দেওয়ার চেষ্টা যেন রুখে দিতে পারেন। এটাই বার
পুজোর আসল উদ্যেশ্য।
এই সময় আকাশ জুড়ে যতই মেঘের দাপাদাপি থাকুক।
দিগন্ত কালো হয়ে জানান দিক ঝড়ের পূর্বাভাস। তবু এই বৈশাখ মাস দিয়েই কবিরা লিখতে শুরু
করেন--- ‘বারোমাস্যা’। বৈশাখ থেকে চৈত্র--- বারো মাসব্যাপী নানান ঘটনার কাহিনিভিত্তিক
এই দীর্ঘ কবিতাগুলোর প্রতি ছত্রে ছত্রে ধরা পড়ে সারা বছরের যাবতীয় শোকগাথা। যেন কবিতা
নয়, কবির কলমে আমাদের সারা বছরের সুখ-দুঃখের কাহিনিই যেন সাদা পাতায় ফুটে ওঠে কালো
অক্ষরে।
নববর্ষের পালা: তমলুকের স্মৃতিতে সেকাল ও
একাল
বাড়ি ফিরে দুপুরে থাকত গাছ পাঁঠা ইঁচড়ের কোপ্তাকারি, বড় রুই বা কাতলার কালিয়া,
আলুভাজা আর পায়েস—মায়ের হাতের রান্নার স্বাদই ছিল আলাদা। টিভিতে চলত পংকজ সাহার পরিচালনায়
দূরদর্শনের নববর্ষ বৈঠক—রবীন্দ্রসংগীত, আবৃত্তি আর পুরাতনী গান। বাবা সকালেই কিনে আনত আনন্দবাজার, যুগান্তর, আজকাল-এর নববর্ষ সংখ্যা।
আর আমি খুঁজে বের করতাম কিশোর ভারতী বা আনন্দমেলার নববর্ষ সংস্করণ।
নববর্ষ : সেকাল ও একাল
মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
বাঙালিদের কাছে বাংলা নববর্ষ হল এক আনন্দের দিন, খুশির দিন। বাংলা নববর্ষকে ঘিরে বাঙালিদের মধ্যে অনাবিল এক আনন্দের জোয়ার খেলে যায়। চলে মজা, হুল্লোড়, আড্ডা আরও সব কত কি। একসময় এই বাংলা নববর্ষের দিন বাঙালিদের মধ্যে নতুন পোশাক পরার চল ছিল। এখন সে চল অনেকটাই কমে গেছে। তবু বাড়ির মধ্যে যাঁরা বয়স্ক আছেন, যারা ব্যবসায়ী তাদের অনেকের মধ্যে এখনো সেই রীতি প্রবহমান। ব্যবসায়ীদের প্রত্যেকে এই সময়ে পুরাতন হিসাব নিকাশ শেষ করে নতুন ব্যবসার খাতা তৈরি করেন। লাল শালু দিয়ে মোড়া সে হিসাবের খাতা মনের মধ্যে এক রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে। চলে হালখাতা। ব্যবসায়ীরা এদিন খদ্দেরদের নেমতন্ন করে মিষ্টির প্যাকেট বিতরণ করেন, অনেকে আবার এদিন দুপুর বেলা বা রাত্রিবেলা ভুরিভোজের ব্যবস্থা করেন। আগে এই ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন সেই রেওয়াজ অনেকটাই কমে এসেছে। তবে একেবারে কমে গেছে বলা যাবে না। এখনো বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাংলা নববর্ষ পালনের ধুম পড়ে যায়। আমশাখা, নিমশাখা দিয়ে বাড়ির প্রাঙ্গণ সাজানো হয়। মা লক্ষ্মী কিংবা গণেশের ঘট বসিয়ে পুজো দেন তারা। সারা বছরের সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করেন। একসময় কলকাতার বইপাড়া অঞ্চলে এই বাংলা নববর্ষের দিনটিতে দেখা যেত রমরমা ব্যাপার। নতুন বই প্রকাশের সাড়া পড়ে যেত। লেখকরা নতুন বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের কাছে ছুটে যেতেন। প্রকাশকরা লেখকদের এদিন নেমন্তন্ন করতেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও থাকত। বাংলা পাঁজি এই সময়েই তৈরি হয়ে যায়। প্রায় প্রত্যেক বাঙালি তা কিনে সযত্নে রাখেন। আর সারা বছরের তিথি, নক্ষত্র, ক্ষণ, তারিখ দেখেন। এই পাঁজির মর্যাদা এখনো কিন্তু কোনও অংশেই ক্ষুণ্ণ হয়নি।
বাংলা নববর্ষকে ঘিরে আপামর বাঙালি নব আনন্দে জেগে উঠে। এখন তো আবার এই উত্সবের
সঙ্গে মিশে গেছে সবার প্রিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। সারা বৈশাখ মাস ধরেই
চলে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনের কত সব কর্মসূচি। বাংলা নববর্ষ বাঙালিদের কাছে তাই ঐতিহ্যের-গর্বের-অহঙ্কারের
পুষ্প সাঁতরা
“নব
আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে
শুভ্র
সুন্দর প্রীতি উজ্জ্বল নির্মল জীবনে
উৎসারিত
নব জীবননির্ঝর উচ্ছাসিত আশাগীতি
অমৃত পুষ্প গন্ধ বহে আজি এই শান্তিপবন’’।
----- রবীন্দ্রনাথ
হালখাতা আবার নতুন ফসলের ও সূচনা করে এই নববর্ষ কে কেন্দ্র করে।আসলে হালখাতা
হল বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি।নববর্ষ- হালখাতা যেন
একই অঙ্গে দু'রূপ! রাজা বা নবাব গন মিষ্টান্ন ফল বিতরণ করতেন প্রজাদের মধ্যে
এখন নববর্ষ উদযাপনের রূপ বদলেছে।হালখাতা বা পয়লা বৈশাখের দিন,সিদ্ধিদাতা গনেশ, লক্ষী
- নারায়ণের পুজা করা হয়,সিঁদুরের ছাপ দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে মায়ের পায়ে রাখা
থাকে।আমপাতায় সিঁদুর দিয়ে বাড়ির চারপাশে টাঙানো হয়।নববর্ষ উদযাপনের এই যে কৌলিন্য
তা আজ অনেক টাই ফিকে।কৃত্রিম তা গ্রাস করেছে,সব টুকু যেন দেখনদারি মনে হয়।অতি আধুনিকতায়
মোড়া হাইটেক নববর্ষ! নববর্ষ মানে সত্য নারায়ন পুজা,সিন্নি প্রসাদ, গৃহস্থ বাড়িতে
আত্মীয় স্বজনের আগমনের সাথে সাথে পুজার পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি হত,কিন্ত দিন বদলেছে
দোকানদার খেরোর খাতা নিয়ে মন্দিরে চলে যান টাকার সিঁদুরের ছাপ নিতে।এখন যৌথ পরিবার
নেই বললেই চলে,তাই নববর্ষের পুজাআচ্চা যতটা না করলে নয় ঠিক ততটাই হয়।তার থেকে বেশি আড়ম্বর দেখা যায়
ঘোরাফেরা আর কোন দামি দামি রেস্টুরেন্টের খাওয়া- দাওয়া।বাংলা নববর্ষের থেকে ইংরেজী
নববর্ষের আনন্দ বেশী উপভোগ করে।দোকানদার---
ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট সাদরে দিতে চান না,অবশ্য ব্যতিক্রম ও কিছু আছে যাঁরা পুরানো
চলনটাকে ধরে রেখেছেন। তাই নববর্ষের সেকাল আর একালের মিল খুঁজলে আর পাওয়া যাবে না--
নববর্ষের মধ্যে যে সহজ মিলনের সুরটি গাঁথা হয়ে আছে তা এখন অনেকটাই ধূসর।
বাঙালির নতুন বছরের পটপরিবর্তন
মহুয়া ব্যানার্জী
চাল কলা
সুচরিতা চক্রবর্তী
একলা বৈশাখ লিখতে বসে চড়কের কথা আসবে না তা হয় নাকি ! এই জেনারেশন জানেই না চড়কগাছ কি। ছোট ছোট কাঁচা
আমের সুবাস সজনে ডাঁটা আর পাঁঠার মাংস আমাদের একলা বৈশাখ।
আমার স্বামীর মাইনে তা প্রায় লাখ ছুঁই ছুঁই। মামার চালের দোকান শপিং মলের এড্রেস।
সারা বছর ধরেই প্রচুর কেনাকাটা করে আমার একমাত্র মেয়ে।
এখন নতুন জামায় তেমন আদুরে গন্ধ নেই ভালোবাসা নেই একলা বৈশাখের জন্য অপেক্ষা
নেই। ডি জে, পার্টি - পিকনিক আর বিরিয়ানির উজার করা হাঁড়ি, শীততাপনিয়ন্ত্রক মেশিন আর
চর্বি জমা পেট। সত্যি কথা বলতে কি প্রাচুর্যে
প্রয়োজন মূল্যহীন। দিনে দিনে কত কিছু বদলে
গেলো! হাত ধরাধরি করে মামার দোকানে যাওয়া
মামাতো বোন ক্যানাডায় থেকে ভুলেই গেছে সেই চাল কলা, কুচো করে কাটা ফলের কুচি আর তালপাতার
পাখার কথা।
ওই সামান্য পাওয়ায় কেবলই মনে হয় আগেই ভালো ছিলো। ইদানিং সম্পর্কগুলো কেমন কপালে লাগানো ভেলভেট টিপের
মতো যেকোনো সময় খসে পড়ে।
১লা বৈশাখ প্রাচুর্যে অথচ একলা।
কবিতা সামন্ত
এটি একপ্রকার কৃষিভিত্তিক উৎসব। ভারতবর্ষের যে যে প্রান্তে সৌর ক্যালেন্ডার
হিসেবে পালন হয় সে সে প্রান্ত বা অঞ্চলে বৈশাখ মাসে বিভিন্ন নামে পালিত হয়। ভারতবর্ষ
কৃষিভিত্তিক নদীমাতৃক দেশ। মানুষ উৎসব বলতে কৃষিভিত্তিক উৎসবই জানতেন। সেকালে নববর্ষ
পালিত হতো নতুন ফসল ওঠার সঙ্গে। মানুষ আনন্দে মেতে উঠত পুজো করে মিষ্টি মুখ করে।ব্যবসা
ক্ষেত্রে সারা বৎসরের হিসেবনিকেশের খাতা সেরে নতুন খাতায় তেল সিঁন্দুর দিয়ে পুজোর মধ্যে
দিয়ে। যাকে বলা হয় হাল খাতা বা নতুন খাতা। দোকানে দোকানে পুজো করা হতো। সেকালে একটি
মোটা লাল রঙের কাপড়ে জড়ানো একটি খাতা যাতে ব্যবসা বাণিজ্যিক সারা বৎসরের হিসেব থাকত
যাকে খেরোর খাতা বলা হতো।
এছাড়াও নতুন প্রজন্ম এটাকে একটা ট্রেন্ড হিসেবে
পালন করে। তারা উৎসব আনন্দ বলতে সবেতেই পার্টি মেজাজে কাটাতে চায় যা সেকালের থেকে অনেকটাই
আলাদা। ওদের চোখে রঙিন পর্দা পড়ে আছে। তাছাড়া আজকাল যৌথ পরিবার নেই বললেই চলে তাই একক
পরিবারে একটি কিংবা দুটি সন্তান এবং আধুনিকতার জোয়ারে ভেসে যাওয়া পরিবার গুলি বিভিন্ন
হোটেলে বা রিসর্টে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে সময় অতিবাহিত করে পালন করার একটা চল লক্ষ্য
করা যায়। এছাড়া সাহিত্য বা সংস্কৃতি জগতে বেশিরভাগ মানুষ নববর্ষ পালন করে থাকেন সাহিত্য
আড্ডা বা সাহিত্যচর্চা বা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করে থাকেন।
সুব্রত পণ্ডিত
তবু স্মৃতির অতলে ডুব দিতে কার না ভালো লাগে?
নববর্ষের সেকাল মানে আমার ছেলেবেলা
, কিশোর বয়েস, যৌবন । সে ছিল এক উন্মাদনার
দিন । ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। সাড়ে তিন
বছর বয়েসে । ফলে আমার যা কিছু আনন্দ - বিনোদন মায়ের সঙ্গে
। আমাদের
ছোটখাটো একটা ব্যবসা ছিল । ফটো ল্যামিনেশন
, খেলনা দ্রব্য ইত্যাদি । আমাদের হালখাতা হতো " অক্ষয় তৃতীয়ায় "। কিন্তু মহাজনদের
হালখাতা হত পয়লা বৈশাখ । মিষ্টির প্যাকেট , বাংলা ক্যালেন্ডার পাওয়া যেত। বড়ো মহাজনেরা পাতপেড়ে খাওয়াতেন , গ্রিফট
দিতেন। বাড়িতেও বাঙালিয়ানার চল ছিল । ভাত,মাছ, পায়েস মিষ্টি । মা সাত সকালে স্থানীয় মন্দিরে
পূজো দিতে যেতেন। নতুন একটা জামা হত। এই ছিল
নতুন বছরের প্রথম দিনের আনন্দ - স্মৃতি ।
এই সময় আমি প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছি ।
এখন সম্পর্ক মোবাইল
ফোনে বাঁধা । আমন্ত্রণ আসে ফোনে, সমাচার
নেওয়াটাও ফোনে। হার্দিক সংযোগ ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে। হৈচৈ , আনন্দ করার মধ্যেও কেমন নিষ্ঠুর সংকীর্ণতা । একালের নববর্ষ
মানে অণুপরিবার নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়া, খাবারে বাঙালিয়ানার ছাপ প্রায় থাকে না। নাইট ক্লাবে পার্টি । হিন্দি গান বাজে । বেহেল্লাপনা হয়। চৈত্র সেল, অনলাইনে জামা কাপড় কেনাকাটা চলে।
এখন মিডিয়া খুব সক্রিয় । বাড়িতে বসে দেখা যায়,
শোনা যায়। শুধু সেকালের রোমাঞ্চ পাওয়া যায় না। দুপুরের মেনুতে শুক্তো, বড়িপোস্ত, মুড়ি ঘন্ট ইত্যাদি
পদ মায়ের মৃত্যুর পরে বউয়ের
হেঁসেলে সে ভাবে রান্না হয় না। একালের নববর্ষে বাঙালিয়ানা তেমন করে খুঁজে পাই না।
তবু নববর্ষ আসে, নববর্ষ যায়। ভারাক্রান্ত স্মৃতি
আর আক্ষেপ নিয়ে দিনগত পাপক্ষয়
মুছে মুছে চলি। বাঙালিয়ানাহীন নববর্ষের স্বাদে অস্তিত্বের গন্ধ নেই ।
সৌগত কান্ডার
দেবব্রত গুছাইত
সুব্রতসুন্দর জানা
শঙ্কর সামন্ত
শুধু বাংলায় নয় - ত্রিপুরা, আসাম, এছাড়া অন্যান্য প্রদেশেও বিশ্বের প্রবাসী
বাঙালিরা এই দিনটি মহাসমারোহে পালন করেন।
বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়েই
পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ শুরু হয়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো - এই উৎসবকে "মানবতার
অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য" ঘোষণা করে।
সম্রাট আকবর তার শাসনকালে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই মার্চ (৯৯২ হিজরী সনে) বাংলা
সন গণনা শুরু হয়। সম্রাট খাজনা, শুল্ক, রাজস্ব আদায়ের জন্য এই দিনটিকে স্থির করেছিলেন।
যা বর্তমানে নববর্ষ হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীকালে বাঙালিরা এই দিনটি নববর্ষ হিসেবে পালন
করেন।
নববর্ষ উদযাপনে সেকাল-একালের আকাশ পাতাল ফারাক হলে ও অল্পবিস্তর সামঞ্জস্য থাকলেও,
আচার অনুষ্ঠানে মিল আছে-বিশেষত নতুন পোশাক পরিধানে মিল আছে। সেই অতীতকাল থেকে নববর্ষ
পালন নদীর স্রোতধারার সাথে প্রবাহমান, ক্রমে ক্রমে মোহনার দিকে এগিয়ে চলেছে।
সেকালের মূল অনুষ্ঠান ছিল রাজস্ব আদায়। সময় এগিয়ে চলার সাথে সাথে যুক্ত হয়
- বিভিন্ন পূজা- পার্বণ, যেমন - নীল ষষ্ঠীর ব্রত ও পূজা ইত্যাদি। সেই সঙ্গে চৈত্র সংক্রান্তির
নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ সূচিত হয়। পুরনো বৎসরের শেষ ও
নতুন বৎসর মিলিয়ে তিন দিনের জাঁকজমক আচার অনুষ্ঠান। এই দিনগুলিতে মূলত বিগত বছরের
দুঃখ-কষ্ট গ্লানি, পরস্পরের ভুলভ্রান্তি, ভেদাভেদ ভুলে নতুন বৎসরে সকলে ভালো থাকার
অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে শপথ গ্রহণ ও বর্ষবরণ করা হয়।
ওই সময় জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের মেয়েরা হলুদ রং পাড় যুক্ত লাল শাড়ি পরে
গঙ্গাস্নানে পালকিতে চড়ে বেরোতেন। আর নর্তকীরা রঙ্গিন ফিরকি, গাড়ি চড়ে বেরোতেন।
সেকালের অনুষ্ঠানে ধর্মচিন্তা, লোকগাথা, পারস্পরিক মেলবন্ধন, শোভাযাত্রায় শালীনতা,
আধ্যাত্মিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যেত - যা একালে চোখে পড়ে না।
এ কালের বর্ষবরনে আধুনিকতার প্রলেপে অন্য মাত্রা যোগ হয়েছে। লৌকিকতার বহর বেড়েছে।
আধ্যাত্মিকতাবাদের হ্রাসমান, অশালীনতার প্রাধান্য, খানাপিনা, মাত্রাধিক্য ক্যাবারে
ড্যান্স, বারে যাওয়া, দামী দামী রং-বাহারি পোশাক, পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ। বাহ্যিক
মেলবন্ধন, আন্তরিকতার অভাব - ভোগবাদের শাসন, - এসবই অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রভাবে
ভোগবাদের বহর দিন দিন ক্রমবর্ধমান।
বৈদ্যনাথ ধাড়া
কিছু বছর আগে আমরা দেখেছি গ্রামগঞ্জের খেলার মাঠের পাশে বট কিম্বা কৃষ্ণচূড়া
গাছের নিচে আনন্দঘন প্রাকৃতিক পরিবেশে একটা সামিয়ানা টাঙিয়ে বর্ষ বরণের বৈঠকী অনুষ্ঠান।
নাচ গান কবিতায়, গল্পে কেটে যেত সারা বিকেল থেকে সন্ধ্যে। দোকানে দোকানে হালখাতার বিপুল
আয়োজন। পয়লা বৈশাখের দিন দুই আগেই বাড়িতে ময়রা
ডেকে মিষ্টি তৈরির অপরূপ দৃশ্য এখনো ভুলতে পারি না। ময়রার হাতে তৈরি বোদের লাড্ডু,
নিমকি, গজার গন্ধে সারা ঘর উঠোন ম ম করতো। আত্মীয় স্বজনের আগমনে বাড়িতে যেন লেগে থাকত
উৎসবের আমেজ।সে এক আবেগঘন বাঙালির নান্দনিক আত্মিক পরিবেশ। বৈঠকী আলোচনায় বয়ে যেত মননশীলতার
ফল্গুধারা, স্বতঃস্ফূর্ত বাতাবরণের সুরেলা মধুর ছন্দ। শিকড়ের টান অনুভব হোত মনকাড়া
মাটির চেনা গন্ধে। কবির ভাষা ভেসে বেড়াত আকাশে বাতাসে। ' এসো হে বৈশাখ, এসো এসো '।
আর এখন নববর্ষ আসে চৈত্র সেলের হাত ধরে। হাটে বাজারে দোকান পাট সেজে ওঠে জামা
কাপড় আর জুতার সম্ভারে। কম দামে বিশেষ করে মহিলাদের কেনাকাটার হিড়িক পড়ে যায়। বেশ কয়েক
দিন চৈত্রসেল চলার পর মনে হয় নববর্ষ আসছে। শুরু হয় ফোনে ফোনে হোয়াটস্যাপে শুভেচ্ছা
বিনিময়। সাথে অতিরিক্ত পাওনা হিসাবে কুলোয় মাঙ্গলিক উপাচার সাজিয়ে লেখা 'এসো হে বৈশাখ,
এর সাথে এক হাঁড়ি মিষ্টির সুন্দর ছবি। তবে দোকানে দোকানে হালখাতার চল এখনো আছে। খোলা
আকাশের নিচে বর্ষ বরণের আন্তরিক অনুষ্ঠান এখন আর চোখে পড়ে না। যে দু একটি হয়, তা কিন্তু
ওই চার দেওয়ালের মধ্যে। ক্রমশ মানুষ যেন ভুলতে বসেছে বাংলা সাল তারিখ। পথ চলতি বাঙালি
যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আজকে বাংলা সাল তারিখ কত। আমি নিশ্চিত তাতে হোঁচট খাবে।
পরিশেষে কামনা করিপ্রতি বছর নববর্ষ আসুক নতুনদের সাথে তাল মিলিয়ে।
নববর্ষ: সেকাল ও একাল
ড. নীলোৎপল জানা
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পহলা বৈশাখ নববর্ষ হিসাবে পালন
করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তি থেকেই নববর্ষের ধুম পড়ে যায় বাংলার ঘরে ঘরে। এই পহলা
বৈশাখ কোনো হিন্দু বা মুসলিম ভাইয়ের জন্য আলাদাভাবে পালন করা হয় না এই নববর্ষ
উৎসবে আমরা সকল বাঙালি মেতে উঠি। এই নববর্ষ কবে সৃষ্টি হয়েছিল বা কবে থেকে পালন
করা হচ্ছে এই নিয়ে অনেক মতবাদ ও মতভেদ থাকতে পারে সেই কচকচানিতে না গিয়ে আমার
চোখে দেখা ছোটবেলার নববর্ষ পালন এবং বর্তমান সময়ে নববর্ষ পালনের মধ্যে কোথাও একটা
তফাৎ চোখে পড়ছে। সেই কারণেই এই অনু-প্রবন্ধ রচনা।
খুব ছোটবেলার কথা মনে নেই যতটা মনে পড়ে তখন আমি ষষ্ঠ বা
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। তখন থেকেই দেখে আসছি নতুন বছর শুরু হওয়ার আগে থেকেই বাবা
বাড়িতে আনতেন বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা, তার উপর বড় বড় করে লেখা থাকতো বাংলা
সাল। ওই পঞ্জিকা সযত্নে রাখা থাকত যাতে ছোটরা নষ্ট না করে ফেলে; কিন্তু মজার
ব্যাপার এই পঞ্জিকার মধ্যে তখন থাকতো নানা ধরনের ছবি যুক্ত বিজ্ঞাপন। কী করে সবজি
চাষ করতে হয় তার নিদান দেওয়া থাকতো; আরো থাকতো জ্যোতিষচর্চা, জমি বাড়ি বিক্রি,
ওষুধের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি। এইসব দেখার জন্য লুকিয়ে পঞ্জিকা বেরকরতাম। বহুদিন থেকে আর
এইসব বিজ্ঞাপন পঞ্জিকাতে তেমন দেখা যায় না। এখনো আমার বাড়িতে খুঁজলে দু-একটা
পঞ্জিকা পাওয়া যেতে পারে এই ধরনের।
পহলা বৈশাখের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল আমন্ত্রণপত্র। রং-বেরঙের
ছোট বড় নানা ধরনের আমন্ত্রণপত্র জড় হত বাড়িতে; আমরা কচিকাঁচারা সেই সকল
আমন্ত্রণপত্র গুছিয়ে রাখতাম সারা বছর ধরে। সেই আমন্ত্রণ পত্রগুলো যে কি আনন্দ দিত
যারা এগুলো সংগ্রহ করতে পারেনি তারা বুঝবে না এর মধ্যে কি গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে
ছিল।
এরপর আসি ক্যালেন্ডারের কথা। পহলা বৈশাখের দিনই বাড়িতে
প্রায় ৫০ খানা বাংলা ক্যালেন্ডার আসত, সেই সঙ্গে ছোট ছোট মিষ্টির প্যাকেট।
ক্যালেন্ডারগুলো বেশির ভাগই ছিল দেব-দেবতার ছবি দেওয়া । দুই একটা ক্যালেন্ডার
মনীষীদের ছবি থাকত এবং এই ক্যালেন্ডারগুলো সযত্নে গুছিয়ে রাখতাম। তারপর মাসের
শেষের দিকে ঘরের বারান্দার দেওয়ালে ছোট ছোট পেরেক পুঁতে সেগুলোকে টাঙাতাম। এর যে
কি আনন্দ ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। আজকালকার ছেলেরা সেই আনন্দের এক ছটাগও আশা
করতে পারে না। তার কারণ এখন তো বাংলা মাসের তেমন ক্যালেন্ডার আর আসে না। বাড়িতে
বাড়িতে যে কয়েকটি ক্যালেন্ডার আছে সবই ইংরেজি মাসের। বাঙালি যেন বাংলা
ক্যালেন্ডারের কথা ভুলেই গেছে। তবে একেবারেই যে বাংলা ক্যালেন্ডার আসে না তা বলব
না, দু একটি অভিজাত দোকানদার পহলা বৈশাখের দিন বাড়িতে ক্যালেন্ডার ও মিষ্টি পৌঁছে
দিয়ে যায়। সারা বছর ধরে নগদে বা বাকিতে যে কারবারই হোক না কেন নববর্ষে দোকানে
দোকানে গিয়ে ক্যালেন্ডার ও মিষ্টি সংগ্রহ ছিল একসময় বাঙালির আনন্দ কিন্তু আজকে
দিনে শুধু মিষ্টি সংগ্রহ হয়। দোকানে দোকানে ঘুরে কিন্তু সে সময়ের যে আনন্দ তা আর
খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো অনেকে বলবেন আজকের দিনে এন্টারটেইন অনেক বেড়ে গেছে,
যেমন বড় দোকানে গেলেই লস্যি বা কোলড্রিংস খেতে দেন, দুপুরে হয়তো মটন কষা দিয়ে
বাসমতি চালের ভাত খাওয়ান কিন্তু সে সময়ের দোকানদারদের মধ্যে যে গভীর
আন্তরিকতা ছিল তা এই সমস্ত খাবারের থেকেও অনেক বেশি স্মরণযোগ্য।
পহলা বৈশাখের দিন আমন্ত্রণপত্র অনুযায়ী দোকানে যেতে হতো। দোকানে গিয়ে পৌঁছালেই কেউ লেবুর শরবত কেউ বা প্লেটভর্তি মিষ্টি খাওয়াতেন। তারপরেই যদি টাকা বাকি থাকে তবে জমা করতে হতো না হলে নতুন বছরে কিছু টাকা আগাম খাতায় জমা করতে হতো। সেই খাতাটি খুব অদ্ভুত। সম্পূর্ণ লাল রঙের এবং লালসালু কাপড়ে জড়ানো। খাতার উপরে বড় করে স্বস্তিকা চিহ্ন থাকত লাল সিঁদুর দিয়ে আঁকা । সেই খাতাতেই সারা বছরের বকেয়া লেখা থাকতো কিন্তু আজ দোকানে দোকানে গেলে এইসব খাতার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। সবই কম্পিউটারে বা ল্যাপটপে রাখা আছে। গিয়ে পৌঁছালেই এক ক্লিকে সারা বছরের হিসাব বেরিয়ে আসে। টাকা দিন মিষ্টির প্যাকেট নিন, বাড়ি চলে যান। না আছে আন্তরিকতা না আছে দু'দণ্ড বসে কথা বলার সময়। সব কিছুই যেন কৃত্রিমাতায় ভরে গেছে। খরচ হয়তো অনেক বেড়েছে দোকানদারদের কিন্তু সেদিনের সেই আন্তরিকতা সব যেন কেড়ে নিয়েছে নেট দুনিয়া। দোকানে যতজন বসে আছে সকলের মোবাইলের দিকে চোখ, কে খরিদ্দার গেল বা এলো তা কেউ আর খেয়াল রাখে না। যাক সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর বদল ঘটুক, তবে মানুষ আনন্দে থাকুক, সুখে থাকুক এই কামনা করি।
কবিতা
পয়লা বোশেখের চিঠি
বিকাশ চন্দ
খেরোখাতায় লেখা চিরন্তন লেনা দেনা চিহ্ন
কে শোনাবে কে কোথায় বেচে জীবন কোন হাটে
কোথায় হাল খাতায় কোন হিসেবে যায় কেনা
ধুস সেই কবে ছেলে বেলা নাকে জল
কাঁচা নিম পাতা মশুর ডাল মুখে একলা বৈশাখ
আম শাখা কৃষ্ণচূড়া পূর্ণঘটের মাথায় শিক ডাব
মনে নেই শৈশবের কবিতায় কি ছিল পাণ্ডুলিপি
সকালের রোদ্দুর দেখলে এখনো জাগে শিশুকাল
কপাল ছুঁয়ে কেমন ছিল মায়ের চুমুর সবেদন স্মৃতি
নতুন বছর এসেছে এবারও কি তুমি আমি সব এক
লাল ডাক-বাক্স জানে শূন্যতায় পয়লা বোশেখের
চিঠি
অরণ্যশব্দ
অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়
একদিন সে আমাদের সাথে ছিল
মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে খুব
তাকে নিয়ে এখনও অনেক কথা
অরণ্যশব্দের মতো বলে ওঠে কেউ
মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে খুব
তাকে নিয়ে এখনও চাঁদ জোৎস্নার মত অভিমান
নদীতে ছড়ানো যেন সব চিত্রকল্প
মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে
তাকে নিয়ে যেন অনন্তকালের হাহাকার
বুকের ভেতর পাখির ডানার মতো ওঠানামা
মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে...
অমিত কাশ্যপ
কুলুঙ্গিতে গণেশঠাকুর কেমন প্রাণ পায়
তুমি শীতল তালপাতার পাখাটিকে দেখ
পাশে সুস্থির আসন পেতে বসে আছে
চৈত্র শেষ করে বৈশাখ ঢুকে আসছে
বাঙালি পার্বণের খাতায়, নববর্ষ
তুমি অগুরুর গন্ধের কথা বললে
রুপোর জলদানিতে গোলাপ জল
বনেদি বাড়ির সাজঘর ভেবে নাও
ধাক্কাপাড় ধুতির ওপর সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি
সুদর্শন রমণীরা স্বাগতম ধ্বনিতে আহ্বান জানাচ্ছে
খোলা চিঠি
এস মহীউদ্দীন
অন্তরা ডেকেছে তার খোলা চিঠিতে
অনির্বাণ, আমাকে প্রণয়ে পোড়াও,,,
বিশুদ্ধ ভাবনার ঋতুবতী শরীর জুড়িয়ে যাক
অপাপবিদ্ধ ভালোবাসার জলপ্রপাতে,,,,
আমি সমস্ত সময়ের উৎস মুখে যাযাবর প্রেমিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
এক আলোকবর্ষ আপেক্ষায় ছিলাম
আজও আছি, উদাসীন হৃদয়ের কুসুম কোমল ঘ্রাণ ভেসে যায়
মেঘদূত পাখি হয়ে অন্তরার হৃদকমল প্রাণে,,,,,
ডোরবেল
অন্তরা সরকার
সব ধার দেনা শোধ করে
সময় সংলাপ মিলিয়েছে ধূসর কুয়াশায়।
তবু
ডোরবেল বাজে,
মায়া খেলা আজও কেউ খেলছে নিঃশব্দে ,
ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখি।
যদি আবার অভিমান কামড়ে ধরে!
চোরাস্রোতে তলিয়ে যায় পরিসীমা!
যদি কেড়ে নিয়ে যাও আমার ব্যর্থ প্রেম!
তবু, রাতে হয়।
টুংটাং রিংটোনে
প্রকট হয়ে ওঠে সিক্ত শিকড়।
ছায়া শরীর
গৌতমকুমার গুপ্ত
রক্তে দেহজ পরমাণু ঈশ্বরকণা
আণবিক হই সংঘর্ষে সতেজ তীব্রতা
দানবিক হয়ে ওঠে আগুনের শীর্ষদেশ
পলকে পুড়ে যায় দয়ালু বিবেক
শরীরে নতজানু আজন্ম অতীত
মুহুর্মুহু মৃত্যু ঘটে মাইটোসিস মেয়োসিস
দেহকোষে ব্যধিজ মারণ প্রক্রিয়া
শুধু ছায়াশরীরে বেঁচে থাকার গান
গ্রীবাদেশে এ কোন প্রজন্মের বৈকল্য
গ্রথিত প্রতিবন্ধ ছায়াশরীরে
ঘাসপাতায় লেগে আছে ছায়ামানুষের অস্তিত্ব
ফিরে দেখা
বিপ্লব চক্রবর্তী
সে তখন বৃষ্টিকে ডেকেছিল অসময়ে
আমি তখন রৌদ্র হয়ে খালবিল শুষে নিচ্ছিলাম
বর্তুল স্তনের মতো গোপন অন্ধকার নেমে আসতো
শুরু হত শরীরের ভেতরে অশরীরী আক্রমণ !
প্রতিদিন খেলতে খেলতে অনেকগুলো না
উড়িয়ে দিতাম ভেজা অন্তর্বাসের অন্ধকারে।
সেইগুলো ছেলেধরা নিয়ে যেত চুরি করে ।
একদিন দেখলাম আমার সেই অসূয়াগুলো নিয়ে
বারান্দায় নেমে এসেছে বুলবুলি পাখির জোড়
আমার ছুঁড়ে দেওয়া শস্যদানা ঠোঁটে গুঁজে
কামিনী গাছের ঝোপে ছানাদের মুখে তুলে দিচ্ছে
সেই কবে আমার উড়িয়ে দেওয়া না গুলো
ছানারা মুখে নিয়ে বৃষ্টিকে ডেকে যাচ্ছে ক্রমাগত।
অশোক অধিকারী
পাতা উল্টে দিলেও সব দাগ থেকে যায়।
বেঁটে বা লম্বা ক্যালেন্ডারের স্পষ্ট তারিখ গুলো
যেন ক্ষতের নির্মাণ | যাকে ভাঙা যায় না;
আজ বাড়িতে পায়েস রান্না হয়নি। অরন্ধন -
হালখাতায় দেনার আমসর; তুমি আর আমার
হবে কি-না ভাবছ! আর এক ক্যালেন্ডার অপেক্ষা
করো মেয়ে |জমিয়ে রাখো তোমাকে লেখা যত চিঠি,
এখন দুটো রাত নিয়ে শুয়ে থাকব আমি।
তুমি জানো ক্যালেন্ডার আমার স্বপ্ন বৈদূর্যে
কোনো পাপ ছিল না!
সুরমা লাগানো চোখ
আবু রাইহান
আবহমান
কালে জুড়ে চাঁদের সাথে উৎসবের অক্ষয় সম্পর্ক
মহাজাগতিক রহস্যের কাছে হার মেনে যায় সব যুক্তিতর্ক
প্রতিদিন সকালে সূর্য উঠলে জেগে ওঠে আলোকিত
নতুন ভোর
অথচ চাঁদের বেলায় মায়াবী জোৎস্নায় কিছুতেই
পুরনো হয় না স্মৃতির ঘোর
তবুও কেন যে এখন আনন্দের উৎসব এলে অব্যক্ত
বেদনায়
ঝাপসা হয়ে ওঠে সুরমা লাগানো চোখ
বিশুদ্ধ হৃদয়ে শুধু তোমার কাছে নতজানু হই,
আর মোনাজাতে বলি মায়াময় এ পৃথিবীতে সকলের
ভালো হোক।
ঝুল বারান্দার বিলাপ
নরেশ দাস
তাই বুঝি দূরে সরে গেলে --
উন্মুক্ত বিকেল বাতাসে ভেসে !
বালিয়াড়ি ঘেষা সমুদ্র কিনারে
এক ঝিণুক ভালবাসা রেখে
দু'হাতে বসন্ত মেখে
দ্রুত পায়ে দূরে সরে গেলে !
সন্ধ্যার ঝাউপাতা বিষন্নতায় ভিজে
দুয়ারে দুয়ারে বিলাপ তুলছে ওই,
তোমার প্রেমের প্রতিমা রেখে
চলে গেলে তুমি বিকেল বাতাসে ভেসে !
তোর জন্যে আদর মাখি
বিধানেন্দু পুরকাইত
হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় থেকে দূরে
একলা যখন একা সমুদ্দুরে
কেমন যেন মৌসুমী এক বাতাস
নিচু স্বরে ডাকে আদর ক’রে।
বেহায়াভাবে এতবার ডেকে
বিঘ্নিত বিশ্রাম
সোনালী সবুজ পাতার আড়ালে
কুহু ডাক অবিরাম।
একটুখানি থাকতে দে তুই
একলা হতে দে
ঘরের ভেতর ফুটন্ত ফুল
সৃষ্টি আনন্দে।
দ্যাখ ভেতরে ওলোটপালট
যন্ত্রণা উৎসব
তোর জন্যে ঘরে আকাল
বসন্ত সংলাপ।
আর একটু আয় কাছাকাছি
আদর মাখি গায়
তোর জন্যে বসন্ত সুর
বিবাগী সন্ধ্যায়।
বিশ্বাস
দীপক শেঠ
চারটি অক্ষরে সীমাবদ্ধ
শব্দ তুমি বিশ্বাস।
তোমারই দীপ্ত চেতনায়
ব্রহ্মাণ্ড স্থিতির আশ্বাস।
যেটির উল্লঙ্ঘনে প্রকাশিত
মূল্যবোধের নিদারুণ পরিহাস।
বিশ্বাস হল বিমূর্ত
চেতনাদীপ্ত মূল্যবোধেই জাগ্রত।
পাওয়া যায় না দেখা
করা যায় না ছোঁয়া।
তবুও সেটির প্রামাণ্য অনুভূতি
চিরন্তন এক মধুকরী প্রতীতি।
জটিল-কুটিল বিশ্বাসের প্রশয়
সম্পর্কের বন্ধন হয় সংশয়
সমাপন হয় -
মধুর হৃদ্যতার প্রত্যয়।
অন্ধবিশ্বাসের কালো ছায়া
পেল না রূপ দর্শনে
সুঠাম কায়া।
পার্থিব জীবন কন্টকাদীর্ণ
হয়ে সরল বিশ্বাসে অবতীর্ণ।
তবুও... তবুও...
বিশ্বাসই জাগায় মনে আশা
নবদিগন্তের সুউচ্চ প্রত্যাশা।
বিশ্বাসেই সৃষ্টি হয় দৃঢ়চেতনা
অমোঘ শক্তিতে পাই কর্মপ্রেরণা।
ক্ষণিক মিলনের বিশ্বাস
জন্ম দেয় আগামীর অভিলাষ।
ধুলোর আগুন
গোবিন্দ বারিক
শূন্য-পথ ভেঙ্গে কবি চলেছেন বৈশাখে
চৈতন্য-রোদ মাখতে অভ্যস্ত কৃষক ধান জমিতে
ছড়িয়ে দেয় নিষাদ-ঘাম ক্লান্তি। বোরোর-বোঝা উঠোনে ঠেকিয়ে দুপুরে গামছার মত অমল-চুম্বন
দিলে আস্ত একটা বেড়ার ফাঁকে কেউ ধরিয়ে দেয় এক গ্লাস জল, জীবন যেন সাত্বিক কাঠামো।
ঢালাই পথ রোগা হতে হতে আশ্চর্য রকম বাঁক নিয়ে
খালের সেতু জুড়ে গেলে অসমাপ্ত সরকারি বাড়ি।দালাল ও দেনা, ঘাম ও অশ্রু, যোগ্য ও অযোগ্য
মিশে আছে ইট কাঠ বালি সিমেন্ট ও আগোছালো বিকেল জুড়ে , ভাষা যেন ঠুঁটো জগন্নাথ।
ইচ্ছে হয় এরকমই প্রতি আবছায়া সন্ধ্যা জড়িয়ে
আমাদের আগামী মুঠোয় জ্যোৎস্না তরী ভাসিয়ে মিশে যাই উঠোনে --- পেতে রাখা ধুলার আগুন।
ইচ্ছেঘুরি
কাকলি গুহ রক্ষিত
উড়ালপুলের উপর দিয়ে চলে যাওয়া
প্রতিটি
গাড়ির মাথায় বৈদূর্য রহস্য
বনেটে
বৈভবের অঙ্গার
বড়
বড় চোখ,হা মুখ
মুক্তির
আনন্দে উত্তাল
তবুও
মন জুড়ে বিষণ্ণতার গল্প
প্লট খুলে খুলে জল গড়িয়ে পড়ে শূন্যতার
কথা বলে মিনিয়েচার রাত
পশ্চিমে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজটি
স্বপ্ন দেখায়
আয়,
আয় ,ওই দেখ চাঁদের পাহাড়
নববর্ষ
রাজাশিস দাস
আজও বসন্ত বিদায় বেলায়
ডেকে দিয়ে যায় গ্রীষ্ম,
আজও বৈশাখ বয়ে নিয়ে আসে
সেই পরিচিত দৃশ্য।
আজও পয়লায় মন্দিরে ভিড়
আজও হয় হালখাতা,
গরমে ভিজে পাঞ্জাবি গায়ে
মাথায় সিদ্ধিদাতা।
আজও বৈশাখী আড্ডা বসে
কিছু কথা কিছু গান,
আজও সন্ধ্যায় সপরিবারে
এ দোকান, সে দোকান।
নববর্ষের শুভেচ্ছা খানি
রাত পোহালেই শেষ,
পরদিন ভোরে ‘সুপ্রভাত’ও
বলে না বঙ্গদেশ।
পয়লার পর দোসরা, তেসরা
হিসেব বড় কঠিন,
সেকালে ছিল একটি বর্ষ
একালে একটি দিন।।
আকাশী
অণিমা গুছাইত।
খুব খানিকটা কাঁদল আকাশী
যাকে বলে ডাক ছেড়ে কান্না।
সে কান্নাতে গ্রাম শহর উজাড় হল কিনা জানিনা।
কিন্তু আভাস পেয়েছে অনেকেই।
নদী
নালা ভরাট হয়ে জল রাস্তায় উঠলো।
সেই জলে এঁদো ডোবা ভর্তি হল।
সবুজ মাঠ জলে ডুবে জলমগ্ন।
বাতাসি দের পুকুরের চারটে পৈঠা ডুবে জল ভিটার
ধারে।
সবাই জানে এই জল একদিন গড়িয়ে যাবে।
শুধু, কেউ জানবে না বুকের ভেতর ঢেকে রাখা
ক্ষতস্থান থেকে নিরন্তন রক্তক্ষরণ।
এসো হে নববর্ষ
নবকুমার মাইতি
নববর্ষ এলে মনটা স্মৃতির সরণিতে হাঁটতে শুরু
করে
তুলে আনে শৈশবের ভাঙা আধুলি আর যৌবনের
ধুন্ধুমার দিনগুলো। মাথার উপরে শূন্যতা, তলায়
রুগ্ন মাটি
ভুলুন্ঠিত
নারীর সম্ভ্রম।ক্ষতবিক্ষত সমাজ শরীর
কিছুক্ষণ আলো আঁধারির মধ্যিখানে এসে ভাবতে
বসি
কি
দেখেছি কালের করাল গ্রাসে, কি পেয়েছি?
শূন্যতার গায়ে জামা পরাতে পরাতে ভারে ভারে
শূন্য হয়ে যাচ্ছি
মুল্যবোধ
নেই: দুঃখ, যন্ত্রণা, নৈরাশ্য
শুধু দাও দাও। মানুষ আজ উৎকণ্ঠায়
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কিছুই নেই: আমি নেই,
আমরা নেই
তুমি নেই, ওরাও নেই। নেই ভুবনডাঙার পাকুড়
গাছগুলো
চারিদিকে
নিরস্তিত্বের অস্তিত্ব, শুধুই ফসিল
এই চরম দুঃখে বড় সাধ জাগে মানুষের পাশে বসি
ওদের মুখে তুলে দিই বৈশাখী পরমান্ন
আমার দৃষ্টি চলে যায় পাশের গাঁয়ে, ডুলুং,
ইরাবতী
নদীর
পাড়ে, দুলে-বাগদি পাড়ায়। তাদের নিরন্তর
অভাব
শূন্যতা দেখে দু'চোখে অশ্রুর বান ডাকে
ঈশ্বর
ও আল্লার উদ্দেশে বলি, ওদের শক্তি দাও, বাঁচতে দাও
মনে পড়ে ডারউইনের 'অরিজিন অব্ স্পেসিস', অস্তিত্বের
লড়াই
সামাজিক
ও মানবিক অবক্ষয়; রুদ্ধশ্বাস পথচলা
চরম অভাব ও অস্থির সময়ে নিরবধি প্রতীক্ষায়
বসে রই
নতুন বছরে দেখে যাব এক আলোকিত সুসময়
রাম ও রহিমের ছেলে লাটাই হাতে ঘুড়ি ওড়ায় উন্মুক্ত
মাঠে
ওদের পরনে বহু প্রতীক্ষিত নতুন পোশাক, হাতে
দুটো লজেন্স।
ভাঙাচোরা কবিতা
পলাশ পোড়েল
বাউণ্ডুলে ভালোবাসা নেমে আসে একা একা
ভিজে যায় রোজ রোজ কিশোরী শ্রাবণে ,
বিষাদ এল অজানা দু'মুঠো বালি উড়িয়ে
বড় বেশি অভিমান রেখে যায় কথোপকথনে ।
অভিমানী চোখ মাঝে মাঝে কুলভাসায়
উজানে একলা চিনেছি সবুজ বন,
ভাঙে শস্য ভরা মাটি ... অবুঝ মন
ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাল্টে যায় স্বপ্ন - বোনা
জীবন।
কখনো জেগে থাকে স্মৃতি মাটির বুকে
সোঁদা
সোঁদা গন্ধ ছুঁয়ে জাগে জোছনা রাত ,
শুধু একবার দাঁড়াও আমাদের স্বজন ডাঙায়
দেখো ফুলে ফলে ফসলে ভরে যাবে হাত।
মনের মানুষ
নীলাংশু অধিকারী
পুকুর পাড়ের সরু পথ দিয়ে চলেছে
এক বৈষ্ণবী চরণদাসী -----
ললাটে রসকলি, ডান হাতে একতারা,
তনুর উপত্যকায় সংযমের বাঁধ।
পুকুরের নিথর জলে তার ছায়ারূপ
থিক থিক করে গেয়ে যায় বৈরাগী।
কোথায় চলেছ বৈষ্ণবী চরণদাসী
অমন করে পায়ের মল বাজিয়ে
ভৃঙ্গবল্লভের কলি খোঁপায় গুঁজে
গৌড়ীয় নৃত্যের তালে তালে?
ব্রজের পথে না কি দ্বারকার দিকে?
কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছ? বল না গো--
একটি বার বলে যাও ও বৈষ্ণবী!
বৈষ্ণবী নিরুত্তর, আপনাতেই মজে।
আমি আবারও একই প্রশ্ন করলাম---
এবার থমকে গিয়ে দেখল আমায়,
উষসী অধরে মৃদু হেসে উদাসভাবে
গৈরিক বুকের আসমানে বাম হাত দিয়ে
কোনো অদৃশ্য শক্তির ইশারা করল সে।
মনের মানুষের সন্ধান এভাবেই হয়---
আমার বুঝে নিতে আর দেরি হল না।
আলো
মালা ঘোষ মিত্র
অজস্র শব্দরাশি বেগে এসে যায়,
চোখদুটো
দেখার জন্য প্রস্তুত,
সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো এগিয়ে চলি,
হারিয়ে যায় এক শূন্যতায়,
দেহজুড়ে কস্তুরীর সুবাস
অস্তরাগের আলোয়
বিলাবলের সুরে স্তব্ধতা ভাঙছে
মায়াবী অবদানের গভীরতা
ঘূর্ণি ওঠে নদীর স্বচ্ছ জলে,
অপূর্ব মুদ্রায় পদ্মবনে গোখরো
সম্মোহনে ক্ষতচিহ্ন গোপন থাকে
কান্না খুব ঘনিষ্ঠ হয়।।
বৈরাগ্য সুলভ
রূপক চট্টোপাধ্যায়
গড়িমসি করে করেই জীবন গড়িয়ে গেল
সূর্য সীমান্ত থেকে মরুভূমির দিকে
দূর জলাধারের কাছে দু'দণ্ড বসতে চাইছি।
জলাধার, তোমার চোখের কোনায়
নীলাভ রাজহাঁস দেখতে চাইছি,
এলোকেশী হাওয়ায় পালতুলে
কয়েক জন্ম নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
বনসাই বুকে, রেখো আমার জন্য।
এর বেশি কিছু চাইতে পরি কি?
কলজে খুলে গাবগুবি বানিয়েছি
বাউল বয়স আমার
এর বেশি কি আর চাইবে তোমার কাছে!
ছাতা
বিরথচন্দ্র মণ্ডল
একদিন মাটির সংসারে
বৈঠা বাওয়ার মতো
ছলাত ছলাত শব্দে
হেসে খেলে বৃষ্টি নামতো ছাউনির উপর।
এখন অলকানন্দায় ভেসে যাচ্ছে শুকনো পাতা,
বিবর্ণ ফল , বায়বীয় অভিমান আর
তাল তাল স্বপ্ন। বায়ু নিস্কাশনের তীব্র
আকুতি নিয়ে অসাড় হয়ে যাচ্ছে কোষ ও স্নায়ু
।
স্বপ্নেরা কখনো নেতিবাচক হয় না..
পাখিটা এক ছাতা হতে চেয়েছিল।
0 মন্তব্যসমূহ